ঈশপের গল্প – ৮৬ থেকে ৯০

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(৮৬)
The Vine and the Goat

আঙ্গুর আর ছাগল-এর গল্প

আঙ্গুর ক্ষেতে তখন আঙ্গুর তোলার সময় এসে গেছে। গাছে গাছে ঝুলে আছে রসে টসটসে আঙ্গুরের থোকা। ক্ষেতের ধার দিয়ে যেতে যেতে এক ছাগল খপ করে একটা আঙ্গুর লতায় মুখ দিয়ে কিছু পাতা আর আঁকশি ছিঁড়ে নিয়ে কচমচ করে চিবাতে লাগল। আঙ্গুর লতা তখন তাকে বলল, “এইভাবে আমায় ব্যথা দিলি কেন তুই? কেন আমার পাতাগুলো শেষ করছিস? কোথাও কোন কচি ঘাস কি নজরে পড়ল না তোর? মনে রাখিস, সে দিন কিন্তু বেশী দূরে নয় যেদিন আমি এর ঠিক ঠিক প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়ব। আমার পাতা গুলো ধ্বংস করেছিস তুই, শেকড় ও বের করে ফেলেছিস প্রায়। ঠিক আছে, ক’দিন বাদেই তোকে বলি চড়ানোর সময় তোর গায়ে ঢালবার পানীয় বানাতে যে আঙ্গুরগুলো লাগবে, আমিই তার যোগান দিয়ে দেব।”

প্রাচীন বচনঃ কৃতকর্মের সাজা মিলবেই।

আমি বলিঃ একটা-দুটো লতার আঙ্গুরে ত আর পানীয় তৈরী হয় না। ক্ষেত ভর্তি আঙ্গুর লতার থেকে আঙ্গুরের যোগান লাগে তার জন্য। সংখ্যায় যখন অনেক, তখন নিরীহ আঙ্গুর লতারও প্রতিশোধের সুযোগ আসতে পারে। কিন্তু সংখ্যালঘু যারা, তাদের জন্য প্রতিশোধ দূরে থাক, অস্তিত্ব রাখার-ও অধিকার হারিয়ে যায়।

(৮৭)
The Mouse and the Boasting Rat

এক নেংটি ইঁদুর আর এক দাম্ভিক ধাড়ি ইঁদুর-এর গল্প

এক নেংটি ইঁদুর একটা ধানের গোলায় নিজের আস্তানা বানিয়েছিল। কোথা থেকে একদিন এক বিড়াল এসে হাজির সেই এলাকায়। ঐ ধানের গোলাটা হয়ে উঠল তার বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। অবস্থা দেখে ভয়ে নেংটির মুখ শুকিয়ে গেল। কি করবে, কি ভাবে বাঁচবে ভাবতে গিয়ে তার মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। একসময় তার মনে পড়ল কাছাকাছিই থাকা এক ধাড়ি ইঁদুরের কথা। সেই ধাড়ি ইঁদুর এর আগে বহুবার নেংটিকে বলেছে যে সে কোন বিড়ালের পরোয়া করে না। নেংটি ঠিক করল ঐ ধাড়ির কাছে গিয়ে তাকেই অনুরোধ করবে বিড়ালটাকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ধাড়ির সাথে গিয়ে দেখা করল সে। ধাড়ি তখন নিজের গর্তেই ছিল। নেংটি ধাড়িকে নিজের অবস্থার কথা জানিয়ে তার সাহায্য চাইল। “ফুঃ”, বলল সেই ধাড়ি ইঁদুর, “আমায় দেখ, আমার মতন তোর-ও মনে সাহস আনতে হবে। যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়াবি তুই, কোন বেড়ালকে কোন রকম পাত্তা দিবি না। আমি খুব তাড়াতাড়ি-ই আসছি তোর কছে। এসেই ঐ বিড়ালটাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেব ওখান থেকে।” নেংটি চলে যাওয়ার পর ধাড়ি ইঁদুর ভাবল, এত যে বড় বড় কথা বলে দিল সে, এইবার কিছু একটা করে দেখাতেই হবে। সে তার এলাকার সমস্ত ধাড়ি ইঁদুরদের ডেকে আনল, তারপর সবাই মিলে চলল সেই বিড়াল-এর কাছে। মতলবটা হচ্ছে গায়ের জোরে না হোক, সংখ্যার জোরেই বিড়ালকে তারা ভয় পাইয়ে দেবে। কিন্তু গোলার কাছে হাজির হয়ে তারা দেখে যে বিড়ালটা এর মধ্যেই বোকা নেংটিটাকে পাকড়ে ফেলেছে। এরপর বিড়ালটা একবার শুধু একটা হুঙ্কার ছাড়ল। ব্যাস, মুহূর্তের মধ্যে সব কটা ধাড়ি ইঁদুর পড়ি কি মরি করে ছুট লাগিয়ে যার যার গর্তে গিয়ে ঢুকে পড়ল।

প্রাচীন বচনঃ অহঙ্কারী লোকের উপর নির্ভর করতে নেই।

আমি বলিঃ এ এক আশ্চর্য মজা! বার বার ঠকার পরেও লোকেরা তার উপরেই বেশী আস্থা রাখে যে নিজের ঢাকটা বাকীদের থেকে জোরে বাজাতে পারে!

(৮৮)
The Dog and the Fox

কুকুর আর শিয়াল

একদল কুকুর ঘুরতে ঘুরতে দেখে একটা সিংহের চামড়া পড়ে আছে। দেখামাত্র তারা চামড়াটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে সেটাকে কুটিকুটি করতে শুরু করে দিল। একটা শিয়াল সেই সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। কুকুরগুলোর ঐ কাজ দেখে শিয়াল তাদের উদ্দেশ্যে বলল, “এই চামড়া যার ছিল, সেই সিংহটা আজ বেঁচে থাকলে, অনেক আগেই তোরা বুঝে যেতি যে তোদের দাঁতের যা শক্তি তা ঐ সিংহের এমন কি নখের জোরের-ও ধারে কাছে আসে না।”

প্রাচীন বচনঃ পড়ে থাকা লোককে লাথি মারা খুব সহজ।

আমি বলিঃ ক্ষমতাবানের ক্ষমতা চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত যারা মার খাওয়ার ভয়ে দূরে দূরে থাকে, ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর তারাই সেই প্রাক্তন ক্ষমতাবানের উপর প্রবল হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাধারণভাবে একে রাজনীতি বলা হয়ে থাকে।

(৮৯)
The Thief and the House-dog

এক চোর আর এক পাহারাদার কুকুরের গল্প

রাত্রিবেলায় এক চোর এক বাড়িতে এসে হাজির। ঐ বাড়িতে চুরির মতলব তার। কিন্তু এক কুকুর ছিল সেই বাড়ির পাহারার দায়িত্বে। কুকুরের চ্যাঁচামেচিতে মালিক হুঁশিয়ার হয়ে গেলে চোরের পক্ষে মুস্কিল। কুকুরটাকে শান্ত রাখার জন্য চোরটা তাই অনেকগুলো মাংসের টুকরো সাথে করে নিয়ে এসেছিল। এবার সে কয়েকটা টুকরো সেই কুকুরের দিকে ছুঁড়ে দিল। তাই দেখে কুকুরটা ঐ চোরকে বলল, “আপনি যদি ভেবে থাকেন যে এইভাবে মাংসের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে আমার মুখ বন্ধ রাখবেন, আমার পাহারায় ঢিলে পড়ে যাবে, আর, আপনার অনুগত হয়ে পড়ব আমি, বিরাট এক ভুল করবেন আপনি! আপনার এই হঠাৎ দয়ায় আমার সন্দেহ বরং আরো বেড়ে গেছে। এর পিছনে নিশ্চয়ই আপনার কোন মতলব আছে। এমনি এমনি আপনি আমায় উপহার বিলাচ্ছেন না। আমি নিশ্চিত, আপনি আমার মালিকের কোন ক্ষতি করার মতলবে আছেন। তাছাড়া, এখন আমার খাওয়ার সময়ও নয়। এতে আমার আরো বেশী করে সন্দেহ হচ্ছে যে আপনি নিশ্চয়ই কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছেন।”

প্রাচীন বচনঃ কোন সৎ উদ্দেশ্যে কেউ ঘুষ দিয়ে খুশী করার চেষ্টা করে না।

আমি বলিঃ ঈশপ-দাদু গো, তোমার দিন আর নেই। এখন এই হতভাগ্য তৃতীয় বিশ্বে সৎ উদ্দেশ্যর কথা বাদ-ই দিলাম, নেহাৎ বাঁচতে গেলেও যে কত সময় ঘুষ না দিয়ে কোন উপায় থাকে না সে কেবল ভুক্তভোগী-ই জানে।

(৯০)
The Sick Stag

অসুস্থ হরিণ

অসুখ করায় এক হরিণ চুপটি করে নিজের আস্তানায় শুয়ে ছিল। তার আত্মীয়-স্বজন, ইয়ার-দোস্তরা দলে দলে তাকে দেখতে এল। তার শরীরের খোঁজ-খবর নেওয়ার সাথে সাথে তারা সবাই তার সঞ্চিত খাবারেও খানিকটা করে ভাগ বসিয়ে গেল। হরিণটা যে শেষ পর্যন্ত মারা পড়ল সেটা যত না অসুখে ভুগে, তার থেকেও বেশী করে খাবারের অভাবে।

প্রাচীন বচনঃ খারাপ সঙ্গীরা ভাল করার চেয়ে অনিষ্টই করে বেশী।

আমি বলিঃ ক্ষমতাচ্যুত কি অশক্ত অবস্থার সময় যারা আহা-উহু করে ঘিরে এসেছে, ব্যক্তি-ই হোক বা গোষ্ঠী কি দল সবাই তারা বন্ধু নয়। অনেকেই এসেছে অসহায় দেখে আরো লুটে নেওয়ার জন্য, আরো ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য, সাবধান!