ঈশপের গল্প – ৯৬ থেকে ১০০

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(৯৬)
The Laborer and the Snake

একটি লোক আর একটা সাপ।

[ইংরেজী রূপটিতে শিরোনামে Laborer কথাটি থাকলেও গল্পের ভিতর ঐ শব্দটির আর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। সেখানে লোকটিকে উল্লেখ করা হয়েছে Cotteger হিসেবে। হয়ত Laborer বলতে গরীব মজুর যার ঝুপড়ির পাশে সাপের গর্ত থাকতে পারে এবং Cotteger বলতে ঐ ঝুপড়িবাসী লোকটিকে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। গল্পের জন্য দরকারী মনে না হওয়ায় আমার অনুবাদে আমি ঐ খুঁটিনাটিতে ঢুকি নি]

একটি বাড়ির উঠানের ঠিক পাশেই এক গর্তে একটি সাপ থাকত। বাড়ির মালিকের শিশু সন্তানটি একদিন সাপটার তীব্র ছোবলে মারা গেল। এই ভয়ানক ঘটনায় শিশুটির বাবা মার দুঃখের সীমা রইল না। শিশুটির বাবা ঠিক করল যে সাপটাকে সে মেরে ফেলবে। পরের দিন খাবারের খোঁজে যেইমাত্র সাপটা গর্ত থেকে বেরিয়েছে, সে লোক তার কুড়ুল দিয়ে সাপটার মাথায় দিল এক কোপ। কিন্তু, তাড়াহুড়োয় কোপটা পড়ল গিয়ে সাপের লেজের দিকে। কাটা পড়া লেজ ফেলে সাপ পালিয়ে গর্তে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ বাদে লোকটার মনে হল, এই রে, সাপটা ত এইবার তাকেও দংশাবে। তখন সে সাপটার সাথে একটা বোঝাপড়ায় আসতে চাইল। ক্ষুধার্ত সাপটার খাওয়ার জন্য একটা রুটি আর খানিকটা নুন নিয়ে গিয়ে সে ঐ গর্তটার সামনে রেখে দিয়ে এল। কিন্তু কোন লাভ হল না। সাপটা তাকে বলল, “তোমার আমার মধ্যে কোনদিনই আর কোন সমঝোতা হবে না। তোমাকে দেখলেই আমার মনে পড়বে আমার লেজ কাটা যাওয়ার ব্যাথা। আর আমায় দেখলেই তোমার মনে পড়ে যাবে তোমার ছেলেটির মৃত্যুর কথা। “

প্রাচীন বচনঃ যার কারণে কোন যন্ত্রণা পেতে হয়েছে, তার উপস্থিতিতে সেই যন্ত্রণার কথা ভোলা একান্তই কঠিন।

আমি বলিঃ রাজাকার সাপেরা জানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ-এর সাথে তার কোন দোস্তি নেই। সে শুধু ধান্দায় থাকে কি করে আবার ছোবল মারা যায়। সমঝোতা, বিনির্মাণ ইত্যাদি নানা কিসিমের তত্ত্ব আউড়ে যারা সেই সত্যটা আড়াল করতে চেষ্টা করে তারা খুনী ধর্ষক ঐ সব সাপেদের-ই সঙ্গী, মানুষের নয়।

(৯৭)
The Bull and the Calf

ষাঁড় আর বাছুর

একদিন একটা ষাঁড় শরীরটাকে অনেক চাপাচাপি করেও একটা সরু গলি দিয়ে কিছুতেই আর এগোতে পারল না। একটা কচি বাছুর সেই দেখে এগিয়ে এল। সে বলল যে সে আগে আগে গিয়ে ষাঁড়টাকে দেখিয়ে দিতে পারে কেমন করে এই সরু চিপার মধ্যে থেকে বের হওয়া যাবে। “থাক, তোর আর খাটাখাটনি করার দরকার নেই” ষাঁড়টা জবাব দিল তাকে, “তোর জন্মের অনেক আগে থেকেই ঐ সব কায়দা কসরৎ আমার জানা আছে।”

প্রাচীন বচনঃ বড়দের জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমি বলিঃ যে যত কম জানে তার তত বড় বড় তত্ত্ব আউড়াতে ইচ্ছে করে। বিপদ বাধে যখন এই কম-জানারাই পরিচালকের ভূমিকা নেয়।

(৯৮)
The Goat and the Ass

ছাগল আর গাধা

একটি লোকের পোষ্যদের মধ্যে ছিল এক ছাগল আর এক গাধা। গাধাটার বড়সড় চেহারা, খেতেও পেত বেশী। তার খাবারের পরিমাণ দেখে ছাগলটা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যেত। আর থাকতে না পেরে একদিন সে একটা ফন্দী আঁটল। গাধাটাকে ডেকে বলল, “ছি ছি, কি খাটুনিটাই না তোমাকে দিয়ে খাটায় এরা! এই পেষাই করার যন্ত্রে জুড়ে দিচ্ছে ত এই আবার কাঁড়ি কাঁড়ি বোঝা টানাচ্ছে।” সে পরামর্শ দিল যে গাধাটা বরং মৃগীরোগীর ভান করুক। তারপর একটা কোন খাদে পা হড়কে নেমে গিয়ে খানিক বিশ্রাম নিয়ে নিক। ছাগলের পরামর্শ গাধার খুব মনে ধরল। কিন্তু খাদে গড়িয়ে পড়তে গিয়ে চোট লেগে নানা জায়গায় কেটে-ছড়ে গেল তার। গাধার মালিক খবর পাঠাল সেখানকার হাতুড়ে চিকিৎসককে, পরামর্শ চাই। সেই লোক হুকুম দিল ছাগলের রক্ত যোগাড় করার জন্য – গাধার ক্ষতের উপর ঢালতে হবে। ঐ ছাগলটাকেই তখন সবাই কেটেকুটে গাধাকে সারিয়ে তুলতে লেগে গেল।

প্রাচীন বচনঃ অন্যের ক্ষতি করতে চাইলে নিজের আরো বড় ক্ষতি হয়ে যায়।

আমি বলিঃ ঈর্ষায় জ্বলে-পুড়ে যাওয়া মানুষেরা অন্যদের টেনে নামানোর জন্য যে দুষ্কর্মগুলি করে তাতে গোটা সমাজের নানা ক্ষতি ত হয়ই, শেষ পর্যন্ত তার নিজের ক্ষতিও কিছু কম হয় না। তবু সেটা করাটাই যে কেন রাজনীতির স্বাভাবিক রূপ হয়ে দঁড়িয়েছে এ এক আশ্চর্য বিষয়! (কিন্তু, গল্পের আর একটা দিক ছিল কি? সন্দেহ হয়, ছাগলটার মাংসেই ঐ হাতুড়ে চিকিৎসকের পারিশ্রমিকের বন্দোবস্ত হয়েছিল! এক্কেবারে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবুদ্ধির ছাপ-মারা কারবার!)

(৯৯)
The Boasting Traveller

দাম্ভিক পর্যটক

একটি লোক বিদেশে গিয়েছিল। দেশে ফিরে এসে সে বলে বেড়াত যে বিদেশে থাকার সময় তাকে হরেক রকমের বীরত্বের কাজ করতে হয়েছিল। এই সব গল্প শুনিয়ে সে প্রচুর ডাঁট দেখাত। গল্পগুলোর মধ্যে একটা ছিল তার রোডস্ দ্বীপে বেড়ানোর গল্প। সেখানে সে নাকি এমন এক লাফ মেরেছিল যে তার ধারে কাছে পর্যন্ত আজ অবধি কেউ লাফাতে পারেনি! সে বলত রোডস্ দ্বীপের গাদা গাদা লোক তার ঐ লাফ দেখেছিল। সে ডাকলেই তারা এসে সাক্ষীও দিয়ে যাবে। এই সব শুনতে শুনতে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি লোক একদিন আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে বলে উঠল, “সাক্ষী ডাকার দরকার কি! আপনি গুণী লোক, মনে করুন এই জায়গাটাই রোডস্ দ্বীপ। দিন, এবার একটা লাফ দিয়ে দিন ত! আমরা নিজেরাই দেখে নিই আপনার লাফানোর ক্ষমতা।”

প্রাচীন বচনঃ বড় বড় কথা বলার রোগ সারানোর দাওয়াই হচ্ছে, যে যা বলছে, তাকে তা করে দেখাতে বলা।

আমি বলিঃ নিজের সামর্থ্য নিয়ে বড় বড় কথা বলবে, আর, করে দেখানোর সময় এলে করে উঠতে পারবে না। তারপরেও আবার বড় বড় কথা বলে যাবে – প্রেমে আর রাজনীতিতে এ রোগ চলতেই থাকে, সারে না।

(১০০)
The Ass, the Cock, and the Lion

এক গাধা, এক মোরগ আর এক সিংহ

এক গাধা আর এক মোরগ এক সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। খাবারের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে এক সিংহ সেখানে এসে হাজির। ক্ষুধার্ত সিংহ যেই গাধাটার উপর লাফিয়ে পড়তে গেল, ঠিক তখনই মোরগটা বিকট চিৎকার দিয়ে কোঁকর-কোঁ করে ডেকে উঠল। লোকে বলে, সিংহ মোরগের ডাক একেবারে সহ্য করতে পারে না। হ’লও তাই, মুহূর্তে মুখ ঘুরিয়ে সিংহটা সেখান থেকে পালিয়ে গেল। তুচ্ছ এক মোরগের ডাকেই সিংহটাকে এমন কেঁপে যেতে দেখে গাধার খুব সাহস এসে গেল। সিংহটাকে আক্রমণ করার জন্য সে ওটার পিছু ধাওয়া করল। বেশীদূর যাওয়ার আগেই অবশ্য সিংহটা ঘুরে দাঁড়িয়ে গাধাটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলল।

প্রাচীন বচনঃ ফালতু সাহস প্রায়ই বিপদ ডেকে আনে।

আমি বলিঃ দল-ই হোক, কি ব্যক্তি, কোন কারণে এখনকার মত পিছিয়ে গেছে মানেই সেই শয়তান হেরে গেছে, তার আর আগের মত ক্ষমতা নেই এইটি ধরে নিয়ে তার মোকাবিলা করতে গেলে ভীষণ দাম দিয়ে সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে লাগে।