ঈশপের গল্প – ১১১ থেকে ১১৫

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(১১১)
The Dog Invited to Supper

নিমন্ত্রণ পাওয়া কুকুরের গল্প

এক ভদ্রলোক বাড়িতে এক বিরাট ভোজের আয়োজন করেছিলেন। তাঁর এক বন্ধুকেও নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। বন্ধুর সাথে সাথে বন্ধুর কুকুরটাও এসে হাজির হ’ল সেই ভোজে। সেই ভদ্রলোকের নিজের কুকুর তখন মালিকের বন্ধুর কুকুরকে দেখে এগিয়ে এল। “এসো দোস্ত” বলল সে, “আমাদের সাথেই আজ খেয়ে নাও।” নিমন্ত্রণ পেয়ে সে কুকুরের ত মহা আনন্দ হল। ভোজের আয়োজন দেখে সে মনে মনে বলল, “বিরাট ব্যাপার, কোন সন্দেহ নেই এতে, সত্যি বলতে কি খুবই সৌভাগ্য আমার। যা যা মন চায় খাব আজকে, ভাল করে খেয়ে নেওয়া দরকার আজ রাতে, কে জানে কাল আবার কতটুকু খাবার জুটবে।” নিজের মনে এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে মহা খুশীতে সে তার লেজ নাড়াতে থাকল। এক ফাঁকে নিজের বন্ধুর দিকে তাকিয়ে চতুর একটা হাসিও দিয়ে দিল সে। কিন্তু তার এই লেজ নাড়ানো পাচক মশায়ের নজরে পড়ে গেল। অচেনা অজানা এক কুকুর দেখে সে সোজা সেটার ঠ্যাং ধরে জানালা দিয়ে নীচের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। মাটিতে পড়ার পর কঁকিয়ে উঠে সেই কুকুর রাস্তা ধরে হাঁটা দিল। তার আওয়াজ শুনে রাস্তা থেকে অন্যান্য কুকুররা ছুটে এল তার কাছে। তারা তাকে জিজ্ঞেস করল কেমন ভোজ খেল সে। “আমার মনে হয়,” বলল সে, একটা দুঃখের হাসি মুখে ঝুলিয়ে, “আসলে আমি ঠিক মত জানিই না, তরল পানীয়তে ডুবেছিলাম তো, কোথা দিয়ে কি ভাবে যে ও বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি সেটা পর্যন্ত ধরতে পারিনি।”

প্রাচীন বচনঃ পিছনের দরজা দিয়ে যারা ঢোকে, জানালা দিয়ে তাদের ছুঁড়ে ফেলা হলে সেই নিয়ে তাদের কোন অভিযোগ করা সাজে না।

আমি বলিঃ বড়লোকের সাঙ্গ-পাঙ্গদের অনুগ্রহের কোন ভরসা নেই, একজন ডেকে নেবে ত আরেকজন তুলে আছাড় মারবে। বাঁচতে হলে এদের দূরে থাকাই ভাল।

(১১২)
The Frogs Asking for a King

ব্যাঙেদের রাজা চাই

ব্যাঙেদের খুব দুঃখ, তাদের কোন রাজা নেই। তারা দেবরাজ জুপিটারের কাছে আবেদন জানাল তাদের জন্য রাজা পাঠাতে। জুপিটার দেখলেন, এই ব্যাঙেরা নিতান্তই সহজ সরল। তিনি একটা বিরাট কাঠের গুঁড়ি তাদের মাঝখানে ফেলে দিলেন। কাঠের গুঁড়ির ঝপাং করে জলে পড়ল। সেই পড়ার চোটে ভীষণ ভয় পেয়ে ব্যাঙেরা গভীর জলে লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু যেই তারা দেখল যে গুঁড়িটার কোনই নড়ন চড়ন নেই, দল বেঁধে জলের উপর ভেসে উঠল সবাই। গুঁড়িটার প্রতি তাদের আর বিন্দুমাত্র ভয় নেই। এমন অবস্থা হল, তারা ওটার গা বেয়ে ওটার উপর চড়ে বসে রইল। একসময় তাদের মনে হল, এমন একটা নিষ্কর্মা রাজা পাঠিয়ে দেবরাজ তাদের প্রতি বড়ই অবিচার করেছেন। তারা জুপিটারের কাছে আবার একজন রাজা পাঠানোর জন্য আবেদন জানাল। ইন্দ্র একটা ঈল মাছ পাঠিয়ে দিলেন তাদের উপর রাজত্ব করার জন্য। ঈল নড়ে চড়ে, ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু বড়ই ভাল সে, খুবই শান্ত স্বভাব। ব্যাঙেদের মন ভরল না। তারা আরো একবার জুপিটারের কাছে রাজা পাঠানোর অনুরোধ করল। জুপিটার তাদের ক্রমাগত অভিযোগে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে একটা বককে পাঠিয়ে দিলেন তাদের রাজা করে। বকটা দিনের পর দিন ব্যাঙগুলোকে খেয়ে চলল যতদিন পর্যন্ত অভিযোগ জানানোর জন্য একটা ব্যাঙও আর পড়ে রইলনা।

প্রাচীন বচনঃ পরিবর্তন আনার সময় খেয়াল রাখা দরকার যে পরিবর্তনটা ভালর দিকে হচ্ছে।

আমি বলিঃ দুর্বৃত্ত শাসক এসে যখন জান-মানের বিনাশ ঘটায় তখন বোঝা যায় কোন শাসকের বদলে কোন শাসক এসেছে। তখন বোঝা যায়, সব শাসক সমান নয়। যদিও ততক্ষণে অনেকই দেরী হয়ে যায়।

(১১৩)
The Prophet

ভবিষ্যৎ বলা দৈবজ্ঞ

বাজারের মাঝখানে বসে এক দৈবজ্ঞ পথ-চলতি লোকেদের ভবিষ্যৎ বলে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটি লোক ছুটতে ছুটতে এসে তাকে বলল যে কারা যেন তার ঘরের দরজাগুলো ভেঙ্গে ফেলেছে। আর, তার সব জিনিষপত্র তারা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এই শুনে দৈবজ্ঞটি হায় হায় করে উঠে যত জোরে পারে নিজের বাড়ির দিকে ছুট লাগাল। তার এক প্রতিবেশী তাকে এইভাবে দৌড়ে যেতে দেখে বলল, “ওঃ! আপনি! তা আপনি ত বলেন যে সব লোকেদের ভবিষ্যৎ আপনি আগে থাকতেই বলে দিতে পারেন। এইটা তা হলে কি করে হল যে নিজের ভবিষ্যৎটাই আপনি আগাম জানতে পারলেন না?”

প্রাচীন বচনঃ (এই গল্পের জন্য কোন প্রাচীন বচন পাইনি)

আমি বলিঃ দৈবজ্ঞের ক্ষমতার অসারতার বিষয় ঈশপ কবেই বলে গেছেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ-এর কথা আগাম জানতে মানুষ এতই ভালবাসে যে দৈবজ্ঞের কথা শুনতে চাওয়া লোকের সংখ্যা কমার বদলে বেড়েই চলেছে।

(১১৪)
The Dog and his Master’s Dinner

কুকুর আর তার মালিকের খাবার

এক কুকুর রোজ তার মালিকের কাছে খাবার পৌঁছে দিত। খাবারের ঝুড়ি থেকে আসা চমৎকার সব খাবারের গন্ধে সেই কুকুরের খুব লোভ হত খাবারগুলো চেখে দেখার। কিন্তু, নিজেকে সব সময় সামলে নিত সে। বিশ্বস্ততার সাথে নিয়মিত সে তার কাজ করে যেত। কিন্তু একদিন পাড়ার সব কুকুরেরা একসাথে তার পিছু নিল। চোখে তাদের তীব্র আকাঙ্খা, মুখ থেকে লোভ ঝরে পড়ছে। সমানে তারা চেষ্টা করতে থাকল ঝুড়ি থেকে খাবার চুরি করে খেয়ে ফেলার। বিশ্বাসী কুকুরটি অনেকক্ষণ তাদের থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ধাওয়া করে আসা কুকুরগুলো এক সময় এমন ভাবে তাকে ঘিরে ধরল যে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। কুকুরগুলোর সাথে তর্ক করে সে তাদের বোঝাতে চাইল যে তারা কাজটা ঠিক করছে না। চোর কুকুরগুলো ঠিক এটাই চাইছিল। তারা এমনভাবে তাকে বিদ্রূপ করতে রইল যে একসময় সে রাজী হয়ে গেল। “ঠিক আছে, তাই হোক,” বলল সে, “তবে, ভাগাভাগিটা কিন্তু, আমি নিজে ঠিক করব।” এই বলে মাংসের সবচেয়ে ভালো টুকরোটা সে নিজের জন্য তুলে নিল আর বাকিটা ঐ কুকুরগুলোকে দিয়ে দিল।

প্রাচীন বচনঃ লোভের সাথে আলোচনায় বসলে লোভের হাতে পরাস্ত হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশী থাকে।

আমি বলিঃ সম্পদের অংশীদার না করে চিরকাল কাউকে দিয়ে সেই সম্পদের ভার বওয়ান যায় না। একদিন না একদিন সেই বঞ্চিত লোক ঐ ভার লুট করে নেবেই।

(১১৫)
The Buffoon and the Countryman

ভাঁড় ও স্থানীয় লোক

এক ভদ্রলোক ছিলেন, যেমন বড় ঘরের, তেমনি বিরাট বড়লোক। সাধারণ লোকেরা যাতে বিনা পয়সায় আমোদ-আহ্লাদ করতে পারে তার জন্য তিনি একটি রঙ্গমঞ্চের বন্দোবস্ত করেছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ঐ মঞ্চে কেউ যদি নুতন কোন মজাদার কিছু করে দেখাতে পারে তবে তাকে তিনি অনেক পুরস্কার দেবেন। এক ভাঁড়, রঙ্গ-রসিকতায় খুব নাম-ডাক ছিল তার, বলল যে সে এমন মজার খেলা দেখাবে যা কোন মঞ্চে আগে কেউ কখনো দেখায়নি। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল এই কথা। চারিদিকে একেবারে হৈ হৈ পড়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে নুতন মজা দেখার জন্য রঙ্গমঞ্চের সামনে প্রচুর লোকের ভীড় হল। ভাঁড়টি মঞ্চে এল এক সময়। তারপর একটা বাচ্চা শূয়োরের চিঁ চিঁ আওয়াজ নকল করে ডেকে উঠল। নকল করার কাজটা সে এত ভালভাবে করেছিল যে দর্শক-শ্রোতারা সাব্যস্ত করল, লোকটির ঝোল্লা জোব্বার নিচে নিশ্চয়ই একটা বাচ্চা শূয়োর লুকোনো আছে। তারা দাবী করল যে লোকটিকে তার জোব্বা ঝেড়ে-ঝুড়ে দেখাতে হবে। জোব্বা ঝাড়াঝুড়ি করেও যখন কিছু বের হল না, তখন তারা প্রবল হাততালি দিয়ে লোকটিকে বাহবা জানাল। স্থানীয় একজন সাধারণ লোক এইসব দেখে-শুনে বলল, সে ও আসছে কাল এই মজাটাই করে দেখাবে। পরের দিন ভীড় আরো বিরাট। দুই অভিনেতাই মঞ্চে হাজির। ভাঁড়টি আগের দিনের মতই বাচ্চা শূয়োরের ডাক নকল করল, দর্শক-শ্রোতারাও আগের দিনেরই মত তাকে প্রচুর বাহবা দিল। এবার স্থানীয় লোকটির পালা। সে এমন একটা ভঙ্গী করল যেন তার জোব্বার নীচে একটা বাচ্চা শূয়োর লুকিয়ে রেখেছে (আসলেই রেখেওছিল), তারপর যেন সে সেই শূয়োরের কান ধরে টানাটানি করল আর, শূয়োরের চিঁ চিঁ আওয়াজ শোনা গেল। লোকেরা অবশ্য সেই আওয়াজ শোনার পর রায় দিল যে একটু আগে ভাঁড়টি আরো ভালভাবে শূয়োরের ডাক নকল করে শুনিয়েছে। এইবারে এই সাদাসিধে স্থানীয় লোকটি জোব্বার ভিতর থেকে একটি বাচ্চা শূয়োর বার করে আনল। সবাই অবাক হয়ে দেখল, কি বিরাট ভুল ধারণা তারা করে বসেছিল (ভাঁড়টির ক্ষমতা বিষয়ে)।

প্রাচীন বচনঃ সমালোচকদের উপর সবসময় ভরসা করা যায় না।

আমি বলিঃ নানা রকম বুকনি শুনে যাদের যত বড় বলে মনে হয়, ভাল করে খোঁজ নিলে পর তাদের আর তত বড় বলে না মনে হওয়ার সম্ভাবনা ভালই।