ঈশপের গল্প – ১২১ থেকে ১২৫

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(১২১)
The Fawn and the Mother

হরিণ-ছানা আর তার মায়ের গল্প

বাচ্চা এক হরিণ-ছানা একদিন তার মাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মা, তুমি ত কুকুরগুলোর চেয়ে কত বড়, কত চটপটে আর, ছুটতেও পারো ওদের থেকে অনেক জোরে; তা হলে মা গো! কেন তুমি সবসময় ওদের থেকে এত ভয়ে ভয়ে থাক?” মা-হরিণ হেসে বলল, “বাছা রে, আমি ভালো মত জানি, তুই যা বলছিস তা ঠিক, পুরোপুরি ঠিক! যা যা বললি, আছে, ঐ সমস্ত গুণগুলো আমার আছে। হলে কি হবে, যেই মুহুর্তে আমি কোন কুকুরের ডাক শুনতে পাই, সেটা যদি একটামাত্র কুকুরেরও হয়, আমার মনে হয় এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব।”

প্রাচীন বচনঃ যুক্তি-তর্ক দিয়ে আর যাই হোক, ভীতুকে সাহসী বানানো যায়না।

আমি বলিঃ আজকের ভীতুরা পালাবে ত বটেই, পালিয়ে সে বাঁচুক চাই না বাঁচুক, সেই সাথে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে পালনোটাই সঠিক হয়েছে।

(১২২)
The Lark and her Young Ones

এক মেঠো পাখী আর তার ছানারা

সবুজ ধানক্ষেতে বাসা বেঁধেছে এক মেঠো পাখী। বাসায় তার ছানাপোনারা প্রায় বড় হয়ে এসেছে। এমন সময় একদিন মাঠে এল ক্ষেতের মালিক। ক্ষেতভর্তি ফসল দেখতে দেখতে সে বলে উঠল, “এক্ষুনি যতজনকে পারি খবর দিয়ে দিই, এই বিশাল পরিমাণ ফসল তুলতে অনেকে মিলে হাত লাগান দরকার।” লোকটার এই কথা শুনে কচি ছানাগুলোর একটা তার মার কাছে জানতে চাইল যে বাঁচতে হলে এখন ত কোথাও চলে যাওয়া দরকার, তা কোথায় যাবে তারা? মা বলল, “এখনও কোথাও যাওয়ার সময় আসেনি, বাছা।” কিছুদিন বাদে জমির মালিক আবার এসেছে। এবার সে বলল, “কাল আমি নিজেই এসে ফসল তোলা শুরু করে দেব।” এই শুনে মা-পাখী তার বাচ্চাদের বলল, “অন্য কারো উপর ভরসা না রেখে এ-লোক এখন নিজেই কাজে নেমে পড়বে বলছে। চল, চল, আর দেরী নয়, এইবার আমাদের সরে পড়া দরকার।”

প্রাচীন বচনঃ নিজের উপর ভরসা করাই সবচেয়ে ভালো।

আমি বলিঃ ঈশপ যাই বলুন, আমরা জানি, কঠিন কাজগুলো অন্যদের দিয়েই তোলা দরকার, তাই না? তাতে কাজ হলে হবে, না হলে না হবে!

(১২৩)
The Bowman and the Lion

শিকারি আর সিংহ

এক দক্ষ শিকারি একদিন পাহাড়ে গিয়েছে শিকারের খোঁজে। তাকে আসতে দেখেই সব জন্তু-জানোয়ার ছুটে পালিয়ে গেছে। শুধু এক সিংহ তার পথ আটকে দাঁড়াল। শিকারি সঙ্গে সঙ্গে সিংহর দিকে এক তীর চালিয়ে দিয়ে বলল, “এই পাঠালাম আমার দূত, এইটা থেকেই বুঝতে পারবি, আমি নিজে যখন তোকে হাতে পাব কি হাল করব তোর।” সিংহ ত ঐ তীরের চোট খেয়ে কাৎরে উঠে, ভীষণ ভয় পেয়ে দিল ছুট। পথে এক শেয়াল তাকে থামিয়েছে। খুব করে তাকে সাহস দিয়ে সে বলল যে এইরকম প্রথম চোটেই পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক নয়। সিংহ তখন তাকে উত্তর দিল, “যতই বড় বড় সাহসের কথা বল, আমি ফিরছি না। যার দূত এত ভয়ঙ্কর, সে নিজে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লে আর কোন রক্ষা থাকবে আমার?”

প্রাচীন বচনঃ যে লোক দূর থেকেই চোট দিতে পারে, সে ধারেকাছে না থাকাই ভালো।

আমি বলিঃ আমি না, বড়রা বলছে, মাটিতে সৈন্য না পাঠিয়ে আকাশ থেকে বোমা ফেলে যুদ্ধ জেতাটাই দক্ষতা।

(১২৪)
The Boy and the Filberts

এক ছেলে আর এক বয়াম বাদাম

একদিন এক ছেলে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে বাদাম ভর্তি বয়ামে। মুঠো ভরে বাদাম নিয়েছে ইচ্ছে মত। কিন্তু তার পর? মুঠোর চেয়ে বয়ামের গলা সরু। আর ত হাত বের করতে পারে না। এদিকে সে বাদাম কমাবে না, ওদিকে মুঠোও বার করতে পারছেনা। জোর কান্নাকাটি জুড়ে দিল সে। পাশ দিয়ে যেতে যেতে একজন তখন তাকে বলল, “অর্ধেক নিয়ে খুশী থাক, তা হলে অনায়াসে মুঠো বার করে নিতে পারবে।”

প্রাচীন বচনঃ একবারে বেশী নিতে নেই।

আমি বলিঃ শয়তান মহা ওস্তাদ, বয়ামের গলা যত সরু, সে তার মুঠো তত ছোটো করে নেবে কিন্তু বাদাম সে নিয়েই ছাড়বে। বয়াম বন্ধ করে না রাখলে তার হাত থেকে নিস্তার মিলবেনা।

(১২৫)
The Woman and her Hen

এক মহিলা আর তার মুর্গী

এক মহিলার একটা মুর্গী ছিল। মুর্গীটা রোজ একটা করে ডিম দিত। সে মহিলা প্রায়ই ভাবত, কি করে মুর্গীটার কাছ থেকে একটার বদলে রোজ দুটো করে ডিম পাওয়া যেতে পারে। শেষে একদিন সে মুর্গীটার রোজের খাবার দ্বিগুণ করে দিল। সেইদিন থেকে বেশী খেয়ে খেয়ে মুর্গীটা মোটা আর চকচকে হয়ে উঠল খুব, কিন্তু তার ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল পুরোপুরি।

প্রাচীন বচনঃ লোভ নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে।

আমি বলিঃ ডিম নেই, গতরে বেড়েছে, এবারে ত মুর্গীটা গেল! মুর্গীর মালিকের লোভের চোটে মুর্গীর সর্বনাশ হয়ে গেল।