যুদ্ধের পরের গ্রীষ্ম

গল্পঃ যুদ্ধের পরের গ্রীষ্ম

লেখকঃ কাজুও ইশিগুরো

 

The Summer After The War
Written by Kazuo Ishiguro

 

Bengali translation by Amitabha Chakrabarti

 

ছেঁড়া ন্যাকড়ার মত কিছু – সন্ধ্যার অন্ধকারে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল না – ঐ উঁচুতে একটা গাছের মগডালে আটকা পড়ে হাল্কা হাওয়ায় লতপত করে উড়ছে। ওদিকে আরেকটা গাছ উল্টে গিয়ে ঝোপের উপর পড়ে আছে। চারপাশে ছড়ানো ছিটানো ভাঙ্গাচোরা ডালপালা আর পাতার স্তুপ। আমার যুদ্ধের কথা মনে হচ্ছিল। ধ্বংস আর অপচয়। জীবনের শুরু থেকেই প্রায় দেখে আসছি। বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি, কোন কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। ঠাকুরমা বলে যাচ্ছিল কিভাবে কাগোশিমায় সেই সকালে একটা টাইফুন এসে সব তছনছ করে দিয়ে গেছে।

কয়েকদিনের মধ্যেই বাগানটা পরিষ্কার করে ফেলা গেল। ভাঙ্গা গাছটাকে মরা পাতা আর সমস্ত ডালপালাসমেত পাঁচিলের একদিকে জড়ো করে রাখা হল। আর এই পরিস্কার করতে গিয়েই পাথরের সারিটা নজরে এল আমার, একট পথকে ঘিরে আছে। ঝোপঝাড়ের মাঝখান দিয়ে পথটা বাগানের পিছনের গাছগুলোর দিকে চলে গেছে। ওই ঝোপঝাড়গুলোর গায়ে সদ্য বয়ে যাওয়া ঝড়ের কিছু কিছু চিহ্ন এখনও রয়েছে। ভরভরন্ত গাছ সব। অজস্র পাতায় কত যে বিচিত্র রংয়ের বাহার – লাল, কমলা আর বেগুনীর নানান স্তর, টোকিওতে কখনো এমনটা দেখিনি। সব মিলিয়ে, এখানে প্রথম যেদিন আসি সেদিন যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ছবিটা চোখে পড়েছিল বাগানটাকে এখন আর সেরকম লাগছিল না।

পাথরের সারি-পথ যেখানে শুরু হয়েছে সেইখানটা আর বারান্দার মাঝের এলাকাটায় রয়েছে এক টুকরো সমতল ঘাসজমি। সূর্য পুরোপুরি উঠে পড়ার আগে আমার ঠাকুরদা প্রতিদিন সেখানে তার খড়ের মাদুরটা বিছিয়ে তার উপরে ব্যায়াম করতেন। বাগান থেকে আসা শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত, চটপট পোশাক বদলে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম আমি। ঠাকুরদার চেহারাখানা দেখতে পেতাম, ঢিলেঢালা একটা কিমোনো পরা, ভোরের আলোয় নড়াচড়া করছেন। শরীরটা বাঁকিয়ে তারপর তেজের সঙ্গে টানটান করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন দৌড়চ্ছেন, পা পড়ছে হালকা ছন্দে। প্রতিদিনকার এই নিয়মিত লাফ-ঝাঁফের সময় আমি শান্ত ভাবে অপেক্ষা করতাম। এক সময় সূর্য যখন যথেষ্ট উপরে উঠে যেত, পাঁচিল টপকে তার আলো এসে পড়ত আমাদের বাগানের ভিতরে, আমার চারপাশে। বারান্দার পালিশ করা কাঠের তক্তাগুলো জায়গায় জায়গায় সূর্যের আলোয় ভেসে যেত। এইবার অবশেষে আমার ঠাকুরদার মুখটা কঠিন হয়ে উঠত। শুরু হত তাঁর জুডো চর্চা। ঝট করে ঘুরে যাওয়া তারপর থেমে থাকা। আর সবচেয়ে চমৎকার ছিল হাত-পা ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিগুলো। প্রত্যেকবার ছোঁড়ার সময় ছোট্ট করে একটা আওয়াজ করতেন। ঠাকুরদার দিকে তাকিয়ে সেই সব অদৃশ্য শত্রুদের আমি পরিষ্কার দেখতে পেতাম যারা চারিদিক থেকে তার দিকে এগিয়ে আসছে আর তার অসামান্য বীরত্বের সামনে অসহায় ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে।

ঠাকুরদা পোশাক বদলানোর জন্য ঘরে যাওয়া মাত্রই আমি বাগানে ঢুকে পড়তাম আর এইমাত্র দেখা কসরৎগুলো মক্সো করার চেষ্টা করতাম। কসরতের বিভিন্ন ভঙ্গীগুলোকে ব্যবহার করে নানা বিস্তারিত দৃশ্যকল্প সাজানোর মাধ্যমে কাজটা শেষ হত। দৃশ্যকল্পরা সংখ্যায় অনেক হলেও মূল ছবিটা একই থাকতো। সেটা শুরু হত রাতে কাগোশিমা রেলওয়ে স্টেশনের পিছনের গলিটা ধরে ঠাকুরদা আর আমি একসঙ্গে বাড়ি ফেরা দিয়ে। অন্ধকারের মধ্য থেকে মূর্তিগুলো বেরিয়ে আসত। আমাদের তখন না থেমে উপায় থাকতো না। দলের নেতা কয়েক পা সামনে এগিয়ে আসতো – কথাবার্তা জড়িয়ে যাওয়া মাতাল একটি লোক – দাবি জানাতো, আমাদের টাকা পয়সাগুলো তার হাতে তুলে দিতে হবে। ঠাকুরদা শান্ত ভাবে তাদের সাবধান করে দিতেন, তারা যেন সরে দাঁড়ায় না হলে তাদেরই মুশকিল হবে। এই কথার পর অন্ধকারে আমাদের চারপাশে হা হা করে হাসির রোল উঠত। ঠাকুরদা আর আমার মধ্যে নিরুদ্বেগ চোখাচোখি হত। তারপর আমরা পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে প্রস্তুত হতাম। এরপর তারা আসত, সমস্ত দিক থেকে অগণিত সংখ্যায়। এবং সেই বাগানের ভিতর আমি তখন তাদের ধ্বংসকার্য সম্পন্ন করতাম; আমি এবং ঠাকুরদা, দুটি মানুষের মসৃণ বোঝাপড়ার একটি দল, একের পর এক ধরাশায়ী করে দিতাম তাদের। সবশেষে আমরা চারপাশে তাকিয়ে পড়ে থাকা শরীর গুলো ভালো করে জরিপ করে নিতাম। ঠাকুরদা একবার মাথাটা ঝুঁকিয়ে নিতেন এবং আমরা আমাদের গন্তব্যের দিকে রওনা হয়ে যেতাম। অবশ্যই এ নিয়ে আমরা কোন রকম উত্তেজনা দেখাতাম না এবং সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না করে বাড়ির পথ ধরতাম।

কখনো, কখনো এরকম যুদ্ধের মাঝ পথে ঠাকুরদার বাড়ির কাজের মহিলা নরিকো এসে আমায় সকালের জলখাবারের জন্য ডেকে নিয়ে যেত। তা না হলে অর্থাৎ বাদ বাকী দিনগুলোয় আমিও ঠাকুরদার মত পুরো কাজটা শেষ করে তবে ছাড়তাম। গাছটা পর্যন্ত যেতাম, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সেকেন্ড তার সামনে চুপ করে দাঁড়াতাম, তারপর যেমন করা উচিত, হঠাৎ করে সেটাকে চেপে ধরতাম। কোন, কোন দৃশ্যে আমি কল্পনা করতাম, ঠাকুরদাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যিই আমি গাছটাকে তুলে ঝোপঝাড়ের উপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু গাছটা ছিল অসম্ভব রকম অচল, অনড়, একেবারেই ঝড়ে ভেঙে যাওয়া গাছটার মত নয়। তাই আমার মতন সাত বছরের বাচ্চাছেলেও মেনে নিয়েছিল যে বাদবাকি দৃশ্যগুলোর তুলনায় এই ছবিটা বাস্তবে ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম।

আমার মনে হয় না আমার ঠাকুরদা খুব বড়লোক কেউ ছিলেন। কিন্তু টোকিওর যা অবস্থা দেখে এসেছি তার সাথে তুলনা করলে ওনার বাড়িতে থাকাটা অনেক আনন্দের, আরামের ছিল। মাঝে মাঝে নরিকোর সঙ্গে কেনাকাটার অভিযানে যাওয়া হত, খেলনা, বইপত্র, নতুন জামা কাপড়, আর ছিল খাবার, নানা রকমের – আজ হয়ত সে সব যে কোনো জায়গায় পাওয়া যায়, কিন্তু আমার জীবনে সেই প্রথম ওই সব খাবারের স্বাদ পাওয়া। বাড়িতে থাকার জায়গাও মনে হত অঢেল রয়েছে, যদিও বাড়িটার গোটা একটা ধার এমনভাবে ভেঙ্গেচুরে গিয়েছিল যে সেদিকটায় আর যাওয়া যেত না। আমার পৌঁছানোর পরে পরেই ঠাকুরমা একদিন আমায় পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে ছিল, ঘরে ঘরে রঙিন ছবি আর কত যে কারুকাজ! যখনই আমার কোন ছবি দেখে ভালো লাগল, ঠাকুরমাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ঠাকুরদা এঁকেছে এটা?’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য অজস্র ছবির প্রত্যেকটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পরেও এমন একটা ছবি পাওয়া গেল না যেটা ঠাকুরদার আঁকা ছিল।

‘কিন্তু আমি ত ভেবেছিলাম ঠাকুরদা একজন খুব বড় শিল্পী,’ জানতে চাইলাম আমি, ‘ঠাকুরদার আঁকা ছবিগুলো কোথায়?’

‘তোমার নিশ্চয়ই কিছু খেতে ইচ্ছে করছে এখন, কি বলো, ইচিরো-মশাই?’

‘ঠাকুরদার নিজের আঁকা ছবিগুলো কোথায়? এক্ষুনি চাই ওগুলো।’

ঠাকুরমা আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল। ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে,’ বলল সে, ‘ইচিরোর পিসি তাকে তার ঠাকুরদা সম্পর্কে এই সব জানিয়েছে।’

ঠাকুরমার বলার ভঙ্গীতে এমন একটা কিছু ছিল যা আমায় চুপ করিয়ে দিল।

‘ভাবছি,’ বলল সে, ‘ইচিরোর পিসি আর কি কি বলেছে তাকে, সত্যিই ভাবছি।’

‘সে শুধু বলেছে – ঠাকুরদা একজন নামকরা চিত্রশিল্পী। তার আঁকা ছবিগুলো দেখছি না কেন?’

‘আর কী বলেছে সে, ইচিরো-বাবু?’

‘ঠাকুরদার আঁকা ছবিগুলো এখানে নেই কেন? আমাকে সেই উত্তরটা দাও আগে।’

ঠাকুরমা হাসল, ‘আমার ধারণা ওগুলো সব পরিষ্কার করে গুছিয়ে তুলে রাখা হয়েছে। অন্য কোন এক সময় সেগুলোর খোঁজ করা যেতে পারে। কিন্তু তোমার পিসি আমায় বলছিল, তুমি নিজেও ছবি আঁকতে ভালোবাসো খুব। দারুণ প্রতিভা আছে তোমার – বলেছিল ও। তুমি যদি তোমার ঠাকুরদাকে বলো, বুঝলে ইচিরো-বাবু, উনি নিশ্চয়ই খুশি মনে তোমায় আঁকা শেখাতে রাজি হয়ে যাবেন।’

‘আমার কারো কাছ থেকে কিছু শেখার দরকার নেই।’

‘ঠিক আছে, আমি শুধু আমার কথাটা জানালাম। তা, এখন ত মুখে কিছু দিতে হবে, তাই না?’

যা হওয়ার তাই হল, আমার কোন কথা বলার অপেক্ষা না করেই ঠাকুরদা আমায় ছবি আঁকা শেখাতে শুরু করে দিলেন। এক গরমের দিনে আমি বারান্দায় বসে জলরঙে একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলাম। ছবিটা কিছুতেই হচ্ছিল না। রাগের চোটে আমার ইচ্ছে হচ্ছিল ওটাকে নষ্ট করে ফেলি। তখনই ঠাকুরদা বারান্দায় এসে একটা গদি টেনে নিয়ে আমার পাশে বসে পড়লেন।

‘আমার জন্য কাজ থামানোর দরকার নেই ইচিরো।’ বললেন ঠাকুরদা, আর তারপর ছবিটা দেখবার জন্য ঝুঁকে এলেন। কিন্তু আমি ছবিটা হাত দিয়ে আড়াল করে রাখলাম। ‘ঠিক আছে’, হাসতে হাসতে বললেন ঠাকুরদা, ‘তুমি আঁকা শেষ করার পরেই আমি ছবিটা দেখব।’

নরিকো চা করে এনেছিল, কাপে ঢেলে সামনে রেখে চলে গেল। ঠাকুরদা খুশি খুশি মুখে বসে রইলেন; মাঝে মাঝে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে বাগান দেখছেন। ঠাকুরদার এসে বসে থাকাটা আমাকে কিছুটা চাপে ফেলে দিয়েছিল। ফলে, ছবিটা আঁকা নিয়ে আমি খুব কায়দা করছিলাম। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার হতাশা এসে আমায় পেড়ে ফেলল। তুলিটা বারান্দায় ছুঁড়ে দিলাম আমি। ঠাকুরদা আমার দিকে ঘুরে তাকালেন।

‘ইচিরো,’ বেশ শান্ত গলায় বললেন ঠাকুরদা, ‘তুমি সমস্ত জায়গাটা রঙ দিয়ে মাখামাখি করছ। নরিকি-মাসি দেখলে তোমার উপর খুব রেগে যাবে।’

‘আমার তাতে বয়েই গেল।’

ঠাকুরদা হাসলেন, আর আরো একবার আমার ছবির উপর ঝুঁকে এলেন।

আমি ছবিটা আড়াল করতে চেষ্টা করলাম কিন্তু ঠাকুরদা আমার হাতটা একদিকে টেনে রাখলেন।

‘তেমন কিছু খারাপ নয়। তুমি এটার উপর এমন রেগে যাচ্ছ কেন?’

‘আমার ছবি আমায় ফেরত দাও। আমি ওটা ছিঁড়ে ফেলবো।’

ঠাকুরদা ছবিটা আমার নাগালের বাইরে ধরে রেখে মন দিয়ে দেখলেন। ‘আদৌ খারাপ হয়নি,’ বেশ ভেবে চিন্তে বললেন তিনি।

‘এত সহজে তোমার হাল ছেড়ে দেওয়া ঠিক না। শোনো, এই বুড়ো ঠাকুরদা তোমায় সাহায্য করবে। তারপর একটু চেষ্টা করলে তুমি নিজেই ছবিটা শেষ করে ফেলতে পারবে।

তুলিটা মেঝে বরাবর অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল। ঠাকুরদা সেটা কুড়িয়ে আনার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। যখন তিনি তুলিটা কুড়িয়ে নিলেন, এমন আলতো করে আঙুলের ডগা দিয়ে তুলির মাথাটা ছুঁলেন যেন তিনি ওটার ব্যথা সারিয়ে দিচ্ছেন। তারপর ফিরে এসে আমার পাশে বসে পড়লেন। ঠাকুরদা এক মুহূর্ত ছবিটা ভালো করে দেখলেন। তুলিটা জলে ভিজিয়ে দু’তিনটে রঙে ছোঁয়ালেন। তারপর একটা মসৃণ টানে রং ঝরতে থাকা তুলিটাকে আমার ছবির উপর দিয়ে বুলিয়ে দিলেন। আর ছবিটা জুড়ে ছোট ছোট পাতারা সারি দিয়ে ফুটে উঠল – কোথাও উজ্জ্বল, কোথাও ঘন, কোথাও স্তরে স্তরে বিন‍্যস্ত, কোথাও ঝোপড়া, সবটাই একটা মসৃণ টানে।

‘এই নাও। এইবার তুমি এটা শেষ করে ফেলো।’

আমি যতটা পারলাম ভাব দেখালাম যেন আমার বিশেষ কিছু যায়-আসেনা কিন্তু ব্যাপারটা এমনই অসাধারণ হয়েছে যে আর একবার ছবিটা আঁকার চেষ্টা না করে পারা গেল না। ঠাকুরদা যখন আবার চায়ে চুমুক দিতে দিতে বাগান দেখতে থাকলেন আমি তুলিটা রঙে আর জলে ডুবিয়ে নিয়ে এইমাত্র যেটা ঘটতে দেখেছি সেটা নিজে করবার চেষ্টা করলাম।

আমি যা করে উঠতে পারলাম সেটা হচ্ছে পাতা জুড়ে পুরু করে কয়েকটা ভেজা ভেজা দাগ টানা। ঠাকুরদা দেখছিলেন আমি কি করছি। মাথা নাড়লেন তিনি। বোধহয় ভেবেছিলেন আমি ছবিটা মুছে ফেলতে চাইছি।

আমি প্রথমে ভেবেছিলাম বাড়িটার ক্ষয়ক্ষতি যা হয়েছে সব ঐ টাইফুনের জন্য। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম বেশীরভাগ ভাঙ্গচুরই শুরু হয়েছিল যুদ্ধের ফলে। ঠাকুরদা বাড়ির পাশের দিকটা সারাই করছিলেন। দেয়াল সারাইয়ের জন্য যে ভারা বাঁধা হয়েছিল টাইফুন এসে সেটা ভেঙ্গে দেয়। ফলে গত এক বছর ধরে যা কাজ হয়েছিল তার অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ঠাকুরদা কিন্তু খুব একটা বিচলিত হননি। আমি আসার পর দেখলাম রোজ দু-তিন ঘণ্টা ধরে স্থির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। কখনো কখনো মিস্ত্রিরা এসে হাত লাগাচ্ছে কিন্তু বেশির ভাগ সময় ঠাকুরদা নিজেই হাতুড়ি পেটাচ্ছেন, করাত চালাচ্ছেন – একাই কাজ করে চলেছেন। পুরো কাজটায় কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো নেই। বাড়ির বাকি অংশে ঘরের কোন কমতি ছিল না। সত্যি বলতে কি, কাজের দেরী যেটুকু ঘটছিল সেটা সময় মত জিনিসপত্র না পাওয়া যাওয়ার কারণে। কখনো কখনো দিনের পর দিন অপেক্ষা করতেন এক বাক্স পেরেক কিংবা একটা বিশেষ কোনো কাঠের টুকরো জোগাড় করার জন্য।

ভাঙ্গাচোরা অংশে স্নানঘরটাই শুধু ব্যবহার করার উপযুক্ত ছিল। খুবই সাদাসিধে ব্যবস্থা। কংক্রিটের মেঝে। নালা কাটা আছে জল বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে ভাঙ্গাচোরা ইঁট-পাথরের স্তুপ আর দেয়াল সারানোর ভারাটা দেখা যায়। স্নানঘরটায় ঢুকলে মনে হয় যেন বাড়ির ভিতরে নয়, বাইরের কোন একটা অংশে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু ঘরটার কোণায় ঠাকুরদা একটা কাঠের চৌবাচ্চা বানিয়েছিলেন যেটায় তিন চার ফুট গভীর গরম জল ধরে রাখা যেত। প্রত্যেক রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমি স্নানঘরের বাইরে থেকে ঠাকুরদাকে ডাকতাম। তারপর দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দরজাটা আবার টেনে বন্ধ করে দিতাম। দেখতাম ঘরটা বাষ্পে ভরে আছে। কেমন একটা শুকনো মাছের মত গন্ধ। আমার মনে হত ঠিক-ই আছে, একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষের গায়ের গন্ধ এই রকম-ই হওয়ার কথা। ঠাকুরদা ওই চৌবাচ্চায় গরম জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতেন এবং প্রতি রাতে সেই বাষ্পে ঠাসা ঘরে দাঁড়িয়ে আমি ঠাকুরদার সাথে গল্প করে যেতাম। বেশির ভাগ সময়ই এমন সব বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হত যা আমি বাইরে আর কারো কাছে বলতে পারতাম না। ঠাকুরদা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, তারপর ঐ বাষ্পের মেঘের পিছন থেকে থেমে থেমে প্রত্যেকটি শব্দ জোরের সাথে উচ্চারণ করে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেন।

‘এখন থেকে এটাই তোমার বাড়ি, ইচিরো,’ বলতেন তিনি। ‘যত দিন বড় না হবে, এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই তোমার। এমনকি তখনও চাইলে এখানেই থাকতে পারো তুমি, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, কোনই কারণ নেই।’

এই রকমই এক সন্ধ্যায় সেই স্নানঘরে আমি ঠাকুরদাকে বললাম, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে জাপানি সেনারাই সবার চেয়ে বড় যোদ্ধা ছিল।’

‘লেগে থাকার ব্যাপারে আমাদের সেনারা অবশ্যই সবার চেয়ে সেরা ছিল’, বললেন ঠাকুরদা। ‘সবচেয়ে ভয়ডরহীন, হয়ত। অত্যন্ত সাহসী সেনা সব। কিন্তু কখনো কখনো সবচেয়ে দক্ষ সেনারাও যুদ্ধে হেরে যায়।’

‘কারণ শত্রুরা সংখ্যায় অত্যন্ত বেশি।’

‘কারণ শত্রুরা সংখ্যায় অত্যন্ত বেশি এবং শত্রুদের হাতে অনেক বেশি অস্ত্র।’

‘এমনকি সাংঘাতিক জখম অবস্থাতেও জাপানি সেনারা যুদ্ধ করতে পারত। তাই না? কারণ তারা ছিল কিছুতেই হাল-না-ছাড়া।’

‘ঠিক আমাদের সেনারা অত্যন্ত আহত অবস্থাতেও যুদ্ধ করে যেতে পারত।’

‘ঠাকুরদা, দেখো, এই রকম।’

সেই স্নানঘরে তখন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরা শত্রুদের সাথে এক নিরস্ত্র সেনার যুদ্ধের দৃশ্য রচনা করতাম আমি। যখনই আমার শরীরে একটা বুলেট এসে বিঁধত, একটু থমকাতাম আমি, আর তারপর আবার যুদ্ধ চালিয়ে যেতাম। ‘ইয়াহ! ইয়াহ!’

ঠাকুরদা হাসতেন, জল থেকে হাত দুটো তুলে হাততালি দিতেন। উৎসাহ পেয়ে আমিও যুদ্ধ চালিয়ে যেতাম। আটটা, নটা, দশটা বুলেট ঢুকে যেত। মাঝে মাঝে দম নেওয়ার জন্য যখন একটু থামতাম আমি, ঠাকুরদা তখনও হাততালি দিয়ে যেতেন আর নিজের মনে হাসতে থাকতেন।

‘ঠাকুরদা, তুমি কি জানো আমি কে?’

ঠাকুরদা চোখ বন্ধ করতেন আবার, তারপর জলের মধ্যে আরও একটু ঢুকে যেতেন। ‘একজন সেনা। খুব সাহসী একজন জাপানি সেনা।’

‘ঠিক, কিন্তু কে সে? কোন সেনা? ভালো করে দেখো ঠাকুরদা। তুমি ঠিক ধরতে পারবে।’

আমি অত্যন্ত ব্যথার সাথে আমার ক্ষতের উপর হাত চেপে ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতাম। বুকে আর পেটে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট বিঁধে যাওয়ায় আমার দুরন্ত সমরকৌশল কমিয়ে আনতে বাধ্য হতাম আমি। ‘ইয়াহ! ইয়াহ! কে আমি, ঠাকুরদা? ভাবো, ভাবো, আন্দাজ করো।’

তখন আমি দেখতাম ঠাকুরদার চোখ খুলে গিয়েছে, ঘন বাষ্পের ভিতর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন যেন আমি অতীত থেকে উঠে আসা কোন এক প্রেতমূর্তি। আমার ভিতর দিয়ে একটা ঠান্ডা শিহরণ বয়ে যেত। এবার আমি থেমে গিয়ে ঠাকুরদার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাতাম। ঠাকুরদার মুখ আবার হাসিতে ভরে উঠত কিন্তু তার চোখে সেই অদ্ভুত দৃষ্টিটা লেগে থাকত।

‘এখনকার মত এই থাক,’ জলের মধ্যে আরেকটু ঢুকে গিয়ে বলতেন ঠাকুরদা। ‘বড় বেশি শত্রু। বড় বেশি।’

আমি স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

‘কি হল ইচিরো?’ জিজ্ঞাসা করতেন ঠাকুরদা, হেসে ফেলতেন তারপর। ‘হঠাৎ একেবারে চুপচাপ।’

আমি উত্তর দিতাম না। ঠাকুরদা আবার চোখ বন্ধ করে নিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।

‘যুদ্ধ যে কি খারাপ জিনিস, ইচিরো,’ ক্লান্তস্বরে বলতেন ঠাকুরদা। ‘যাচ্ছেতাই ব্যাপার একটা। কিন্তু সেসব নিয়ে ভেবো না তুমি। এখন এখানে এসে গেছ তুমি, এইটাই তোমার বাড়ি। দুশ্চিন্তার কোন দরকার নেই আর।’

ভরা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় দেখলাম খাবার টেবিলে আরও একজন লোকের জায়গা করা হয়েছে। ঠাকুরমা নীচু গলায় বলল: ‘আজকে তোমার ঠাকুরদার একজন অতিথি এসেছেন। খুব শিগগিরই এখানে এসে পড়বেন তিনি।’

বেশ কিছুক্ষণ ঠাকুরমা, নরিকো আর আমি টেবিলে বসে রইলাম। যখন আমি অস্থির হয়ে উঠলাম, নরিকো আমায় গলা নামিয়ে কথা বলতে বলল। ‘ভদ্রলোক সবেমাত্র এসেছেন। একটু ত সময় দেবে তাকে।’

মাথা নাড়ল ঠাকুরমা, ‘এত বছর বাদে দেখা হয়েছে। একে অপরকে কত কথা বলার আছে ওদের।’

শেষ পর্যন্ত ঠাকুরদা অতিথিকে নিয়ে ঘরে এলেন। বয়স দেখে মনে হল চল্লিশ মতন হয়েছে। বড়দের বয়স সম্পর্কে তখন আমার তেমন কোন ধারণা ছিল না। শক্তপোক্ত লোক, চোখের ভুরু এত কালো যে দেখে মনে হয়, কালি দিয়ে আঁকা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার পুরো সময়টা জুড়ে ঠাকুরদা আর তার অতিথি পুরনো দিনের গল্প করে গেলেন। অতিথি কোন একটা নাম বলছেন, ঠাকুরদা আবার সেই একই নাম বলে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ছেন। ঘরের মধ্যে আবহাওয়া আস্তে আস্তে গম্ভীর হয়ে উঠল। ঠাকুরমা অতিথিকে তার নতুন চাকরি নিয়ে অভিনন্দন জানাতে চাইলেন কিন্তু অতিথি তাকে গোড়াতেই থামিয়ে দিলেন।

‘না, না, ম্যাডাম, আপনি অনেক নরম মনের লোক, কিন্তু একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলছেন। চাকরিটা আদৌ এখনও নিশ্চিত নয়।’

‘কিন্তু তুমি যেমন বললে,’ ঠাকুরদা যুক্তি দিলেন এবার, ‘তোমার তো সত্যিকারের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এই চাকরির জন্য তুমিই যোগ্যতম লোক।’

‘আপনারা অনেক ভালো মানুষ, মাস্টারমশাই,’ অতিথি বললেন, ‘কিন্তু সত্যিই এখনও কোন কিছু নিশ্চিত নয়। আমি শুধু আশা আর অপেক্ষা করতে পারি।’

‘কয়েক বছর আগে হলে,’ বললেন ঠাকুরদা, ‘আমি তোমার সম্পর্কে কিছু ভাল ভাল কথা লিখে দিতে পারতাম। কিন্তু এখনকার দিনে আমার কথার কোন দাম আছে বলে মনে হয় না।’

‘এইটা কিন্তু মাস্টারমশাই,’ বললেন অতিথি, ‘আপনি নিজের প্রতি খুবই অবিচার করছেন। যা, যা করেছেন আপনি, তার জন্য আপনার সব সময়ই সম্মান পাওয়ার কথা।’

এইবার আমার ঠাকুরদা একটু খাপছাড়া মতন হাসলেন।

রাতের খাওয়া মিটে যাওয়ার পর আমি ঠাকুরমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘উনি ঠাকুরদাকে মাস্টারমশাই বলছেন কেন?’

ভদ্রলোক এক সময় তোমার ঠাকুরদার ছাত্র ছিলেন। সেরা ছাত্রদের একজন।

‘যখন ঠাকুরদা ছবি আঁকত?’

ঠিক। এই ভদ্রলোক খুব বড় শিল্পী। তোমার ঠাকুরদার সেরা ছাত্রদের একজন।

বাড়িতে অতিথি থাকায় আমি আর ঠাকুরদার মনোযোগ পাচ্ছিলাম না। ফলে আমার মেজাজ বিগড়ে থাকছিল। পরবর্তী দিনগুলোয় আমি অতিথি ভদ্রলোককে যথাসম্ভব এড়িয়ে চললাম। প্রায় কোন কথাই হত না ওনার সাথে। তারপর এক বিকালে বারান্দায় যে আলোচনা হচ্ছিল সেটা শুনে ফেললাম।

ঠাকুরদার বাড়ির একেবারে উপরতলায় একটা ঘর ছিল পশ্চিমী ধাঁচের – টেবিল আর উঁচু চেয়ারওয়ালা। ঘরটা থেকে একটা ব্যালকনি বাগানের দিকে বেরিয়ে আছে আর বারান্দাটা তার থেকে দুটো তলা নীচে। আমি ঘরের ভিতরে খেলা করছিলাম এবং কিছুক্ষণ ধরে নীচে যে কথাবার্তা চলছিল সেটা শুনতে পাচ্ছিলাম। তারপর কিছু একটাতে আমার মনোযোগ আটকে গেল – বিশেষ করে কথাবার্তার সুরটায়। ভালো করে শোনার জন্য আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। যা ভেবেছি তাই, ঠাকুরদা আর অতিথির মধ্যে কিছু একটা নিয়ে বনিবনা হচ্ছে না। যা বোঝা গেল ঘটনাটা ঘটছে একটা চিঠি নিয়ে যেটা ঠাকুরদার অতিথি চাইছেন ঠাকুরদা সেটা লিখে দিন।

‘অবশ্যই, মাস্টারমশাই,’ বলছিলেন ভদ্রলোক, ‘আমি একেবারেই কোন অযৌক্তিক কিছু চাইছি না। আমি ত সেই কবে থেকেই ধরে নিয়েছিলাম যে আমার আর চাকরীতে কোন উন্নতি হওয়ার আশা নেই। দেখুন, অতীতে যা ঘটে গেছে তার মাশুল দিতে গিয়ে আমায় আটকে যেতে হবে,
আমার মাস্টারমশাই, নিশ্চয়ই সেটা চাইবেন না।’

কিছুক্ষণের জন্য সব চুপচাপ। তারপর আবার অতিথির গলা শোনা গেল – ‘অনুরোধ করছি মাস্টারমশাই, আমায় ভুল বুঝবেন না। আপনার কাজের সাথে আমার নাম যুক্ত থাকায় আমি বরাবরের মত আজও গর্ব বোধ করি। এখনকার এই ব্যাপারটা নিতান্তই কমিটির লোকদের খুশি করার জন্য। আর কোনো কারণ নেই।’

‘তাহলে এই জন্যই তুমি আমার কাছে এসেছ।’ ঠাকুরদার গলায় রাগের থেকেও যেন ক্লান্তি বেশি শোনা গেল। ‘এই জন্যই এত দীর্ঘ কাল বাদে আমার কাছে এসেছ তুমি। কিন্তু নিজের সম্পর্কে তুমি মিথ্যা কথা বলতে চাইছ কেন? তুমি যা করেছিলে দুর্দান্ত করেছিলে, গর্বের সাথে করেছিলে। ভুল হোক, ঠিক হোক, একজন মানুষের নিজের সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলাটা উচিত নয়।’

‘কিন্তু মাস্টারমশাই, আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন। কোবেতে সেই সন্ধ্যার কথা আপনার মনে পড়ে? মিস্টার কিনোসিটার জন্য দেওয়া ব্যাংকোয়েটের পরে যা ঘটেছিল? আপনি আমার উপর রেগে গিয়েছিলেন কারণ আমি আপনার কথার বিরোধিতা করেছিলাম। আপনার মনে পড়ছেনা, মাস্টারমশাই?’

‘কিনোসিটার জন্য দেওয়া ব্যাংকোয়েট? কিছু মনে পড়ছে না। কি নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল আমাদের?’

আবার সব চুপচাপ।

‘ও হ্যাঁ,’ ঠাকুরদার গলা শোনা গেল এক সময়, ‘এখন মনে পড়ছে আমার। চীন অভিযান চলছিল তখন। জাতির জন্য এক কঠিন সময় সেটা। আগের মত একই ভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়াটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা হত তখন।’

‘কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে কখনোই একমত ছিলাম না, মাস্টারমশাই। এবং এই নিয়ে আমার অনুভূতি এতই তীব্র ছিল যে আমি আপনার মুখের উপর সেটা জানিয়েও দিয়েছিলাম। আমি এখন আপনার কাছ থেকে যেটা চাইছি সেটা এই যে আপনি কমিটির কাছে সেদিনের ঘটনাটা ঠিক যা ঘটেছিল সেইটা জানান। শুধু এইটা জানান – প্রথম থেকেই আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা কি ছিল। সেই সাথে এটুকুই বলুন, আমি এতদূর পর্যন্ত গিয়েছিলাম যে সকলের সামনে আপনার মতের বিরোধিতা করেছিলাম। এটা নিশ্চয়ই কোন অযৌক্তিক চাওয়া নয়, মাস্টারমশাই।’

আবার একটি বিরতি, তারপর ঠাকুরদার গলা শোনা গেল – ‘যখন আমার নামের দাম ছিল তখন সেটা থেকে অনেক ফায়দা তুলেছ তুমি। এখন আমার সম্পর্কে দুনিয়ার মত পাল্টে গেছে, এবার এর দায়টাও তোমায় সামলাতে হবে।’

কিছুক্ষণের জন্য সব চুপচাপ, তারপর পায়ের শব্দ এবং দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শোনা গেল।

রাতের খাওয়ার সময় আমি ভালো করে নজর করছিলাম ঠাকুরদা আর তার অতিথির মধ্যে কোন গণ্ডগোলের চিহ্ন চোখে পড়ে কিনা, কিন্তু তারা পরস্পরের প্রতি একই রকম ভদ্র ব্যবহার করলেন। সেই রাতে বাষ্পে ভরা সেই স্নানঘরে আমি ঠাকুরদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঠাকুরদা তুমি আর ছবি আঁকো না কেন?’

প্রথমটায় ঠাকুরদা চুপ করে রইলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘কখনো কখনো, তুমি যখন ছবি আঁকো এবং সেটা ঠিকমতো হয় না, তোমার রাগ হয়, হয় না? তোমার ইচ্ছে করে ছবিটা ছিঁড়ে ফেলতে এবং ঠাকুরদার তখন তোমাকে থামাতে লাগে। তাই না?’

‘ঠিক,’ বললাম আমি, তারপর একটু চুপ করে থাকলাম। ঠাকুরদা চোখ বন্ধ রেখেই কথা বলে গেলেন, গলার স্বর মৃদু এবং শ্রান্ত। ‘তোমার ঠাকুরদার জন্য অবস্থাটা সেই রকমই ছিল। কাজটা সে তেমন গুছিয়ে করে উঠতে পারেনি। তাই সে সেটা সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’

‘কিন্তু তুমি যে আমায় বলো কক্ষনো ছবি ছিঁড়ে না ফেলতে। সব সময় আমাকে দিয়ে তুমি ছবিটা শেষ করাও।’

‘সেটা ঠিক। কিন্তু তুমি এখনো অনেক ছোট, ইচিরো। কত বড় হবে, অনেক ভালো করবে তুমি।’

পরদিন সকালে আমি যখন বারান্দায় ঠাকুরদাকে দেখতে গেলাম, বেলা ততক্ষণে অনেক বেড়ে গেছে। আমি গিয়ে আমার জায়গায় বসার একটু পরেই পিছনে একটা শব্দ হলো, অতিথি বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে, একটা গাঢ় রঙের কিমোনো পড়েছিলেন তিনি। আমায় সুপ্রভাত জানালেন এবং আমি যখন কোনো উত্তর করলাম না, আমার পাশ দিয়ে লম্বা পা ফেলে হেঁটে বারান্দার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঠাকুরদা ওনাকে দেখতে পেয়ে ব্যায়াম থামিয়ে দিলেন।

‘আরে! খুব তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে যে! আশা করি আমি তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাই নি।’ ব‍্যায়ামের মাদুরটা গুটিয়ে নেওয়ার জন্য নীচু হলেন ঠাকুরদা।

‘একেবারেই না মাস্টারমশাই। চমৎকার ঘুমিয়েছি আমি। দয়া করে আমার জন্য আপনার ব্যায়াম থামাবেন না। নরিকো-মাসি আমায় বলছিলেন, কি শীত, কি গ্রীষ্ম, আপনি প্রত্যেক সকালে নিয়মিত এই ব্যায়াম করেন। খুবই প্রশংসা করার মত ব্যাপার। না, না, সত্যি বলছি। শুনে আমি এত মুগ্ধ হয়েছিলাম যে আমি ঠিক করেই রেখেছিলাম, আজ সকালে আমি নিজের চোখে দেখব আপনার ব্যায়াম করা। আমার জন্য মাস্টারমশাইয়ের রোজকার নিয়মের ব্যাঘাত ঘটলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। মাস্টারমশাই, সত্যি বলছি।’

ঠাকুরদা শেষ পর্যন্ত আবার ব্যায়াম শুরু করলেন। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছুটছিলেন তিনি, একটু গা-ছাড়া ভাব। শুরু করার প্রায় সাথে সাথেই দৌড় থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধৈর্য্য ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ তোমায়। ঠিক আছে, আজ সকালের পক্ষে এই যথেষ্ট।’

‘কিন্তু মাস্টারমশাই, এই ছোট্ট ভদ্রলোকটির সেটা একেবারেই ভালো লাগবে না। আমি শুনেছি উনি আপনার জুডো-চর্চা দেখতে খুব ভালবাসেন। কি ইচিরো-বাবু, তাই ত?’

আমি ভান করলাম যেন কিছু শুনতে পাইনি।

‘আজ সকালে সেটা বাদ গেলে তেমন কিছু ক্ষতি হবে না। চলো, ভিতরে গিয়ে দেখি সকালের খাবারের কত দূর।’

‘কিন্তু, আমারও যে খারাপ লাগবে, মাস্টারমশাই। আমি আশা করেছিলাম, আপনার সেই পরাক্রমের দিনগুলো আবার আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠবে। আপনার মনে আছে, এক সময় আপনি আমাকে জুডো শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন?’

‘তাই? হ্যাঁ, সেরকম কিছু একটা মনে পড়ছে বটে এখন।’

‘মুরাসাকি সেই সময় আমাদের সাথে ছিল। এবং ইশিডা। ইয়োকোহামা ক্রীড়া-কেন্দ্রের সেই ঘরটায়। আপনার মনে পড়ছে মাস্টারমশাই? আপনাকে ছুঁড়ে ফেলার জন্য যত বার চেষ্টা করতাম, চিত হয়ে আমি-ই মাটিতে ছিটকে পড়তাম। শেষ পর্যন্ত ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। আপনি থামাবেন না মাস্টারমশাই – ইচিরো আর আমি, আমাদের দুজনেরই আপনার জুডো চর্চা দেখতে খুব ভালো লাগবে।’

ঠাকুরদা হেসে হাত দুটো তুলে ধরলেন। মাদুরের মাঝখানে একটু অদ্ভুত ভাবেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ‘কিন্তু, সত্যি বলতে কি, ঠিকমত চর্চা আমি অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছি।’

‘আপনি জানেন মাস্টারমশাই, যুদ্ধের সময় আমি নিজেও বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলাম। নিরস্ত্র যুদ্ধের ভালো রকম শিক্ষা নিয়ে ছিলাম আমরা।’ এই কথাগুলো বলার সময় অতিথি একবার আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিলেন।

‘আমি নিশ্চিত, সেনাবাহিনীতে তোমাদের খুব ভালো ভাবেই সব শেখানো হয়েছিল,’ বললেন ঠাকুরদা।

‘যে কথা বলছিলাম, এই বিদ্যাটা আমি বেশ ভালো রকমই আয়ত্ত করেছিলাম। কিন্তু আজও যদি আমায় মাস্টারমশাইয়ের সাথে লড়তে হয়, আমি জানি আমার ভাগ্যে একই ঘটনা ঘটবে, ছিটকে মাটিতে পিঠ রেখে চিৎ হয়ে পড়ব আমি।’

তারা দুজনেই হেসে উঠলেন।

‘আমি জানি, খুব চমৎকার তালিম পেয়েছিলে তোমরা,’ বলল ঠাকুরদা।

অতিথি আবার আমার দিকে ঘুরলেন এবং আমি দেখলাম ওনার চোখ দুটো একটা অদ্ভুত ভাবে হাসছে। ‘কিন্তু, মাস্টারমশাই এর মত অভিজ্ঞ মানুষের সামনে সেই তালিম কোন কাজে লাগবে না। আমি নিশ্চিত, ক্রীড়া কেন্দ্রের সেই ঘরে যা ঘটত, আমার ভাগ্যে এখনও সেটাই ঘটবে।’

ঠাকুরদা মাদুরের উপর স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অতিথি তখন বললেন, ‘মাস্টারমশাই, আমার অনুরোধ, আমার জন্য আপনার চর্চা থামাবেন না। ধরে নিন আমি এখানে নেই।’

‘না, না, সত্যিই বলছি, আজ সকালের জন্য এই ঠিক আছে।’ ঠাকুরদা একটা হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মাদুরটা গুটোতে শুরু করলেন।

বারান্দার থামটায় কাঁধের ভর রেখে অতিথি মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন।

‘মুরাসাকি, ঈশিডা … এখন সেসব মনে হয় অন্য কোন যুগের কথা।’ অতিথি ভাব করছিলেন যেন নিজের মনে কথা বলছেন কিন্তু যথেষ্ট জোরেই বলছিলেন তিনি, যাতে ঠাকুরদার কান পর্যন্ত পৌঁছায়। আমাদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে ঠাকুরদা একমনে মাদুরটা গুটোতে থাকলেন।

‘সবাই চলে গেছে,’ বললেন অতিথি, ‘শুধু আমরা দু’জন, মাস্টারমশাই, আমি আর আপনি, সেই সময়ের লোক যারা এখনো টিঁকে আছি।’

ঠাকুরদা একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, ‘ঠিক,’ আমাদের দিকে মুখ না ফিরিয়েই বললেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের।’

‘ঐ যুদ্ধটা একেবারে অর্থহীন ছিল। কি যে বিরাট ভুল।’ ঠাকুরদার পিঠের দিকে তাকিয়েছিলেন অতিথি।

‘হ্যাঁ, খুবই কষ্টের ব্যাপার,’ ঠাকুরদা আবারও বললেন, শান্ত ভাবে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, মাটিতে একটা নির্দিষ্ট জায়গার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি, মাদুরটা সামনে আধা গোটানো।

সেদিন সকালের খাওয়া-দাওয়ার পর অতিথি চলে গেলেন এবং আমি আর কখনো তাকে দেখিনি। ঠাকুরদা তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে চাইতেন না। শুধু সেটুকুই বলতেন যা আমার ইতিমধ্যেই জানা আছে। আমি অবশ্য নরিকোর কাছ থেকে আরও কিছু কথা জানতে পেরেছিলাম।

সে যখন দোকানে কেনাকাটা করতে যেত আমি প্রায়ই তার সঙ্গে জুটে যেতাম এবং এই রকমই এক ঘুরে বেড়ানোর সময় আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা নরিকো, চীন অভিযানের ব্যাপারটা কি ছিল বলতে পারো আমায়?’

স্বাভাবিকভাবেই নরিকো ধরে নিল আমি তাকে কোন ‘শিক্ষা মূলক’ প্রশ্ন করেছি। আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করতাম শীতকালে ব্যাঙরা কোথায় যায়, তখন সে যেভাবে উত্তর দিত, সেই রকম শান্ত ভাবে খুশি খুশি মুখে বলতে শুরু করল, প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধের আগে জাপানি সেনা চীনের অভ্যন্তরে কিছুটা সাফল্যের সাথে একটা অভিযান চালিয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যুদ্ধের ব্যাপারে কোনো কিছু ভুল ছিল কিনা। এইবার সে প্রথম আমার দিকে একটু কৌতূহলী হয়ে তাকাল। না, যুদ্ধ নিয়ে ভুল কিছু ছিল না, তবে এ নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছিল সেই সময়। এবং এখন কেউ কেউ বলছে যে আমাদের সেনা যদি তখন চীনের সঙ্গে জোর করে লাগতে না যেত তবে যুদ্ধটা হতই না। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম যে চীন আক্রমণ করাটা আমাদের সেনার জন্য ভুল ছিল কিনা। নরিকো বলল, না ভুল সেই ভাবে কিছু ছিলনা, তবে প্রচুর লোক এই নিয়ে তর্কাতর্কি করেছিল। যুদ্ধটা যে কোনো ভালো জিনিস নয় সেটা ত এখন আমরা সবাই জানি।

গরমের দিনগুলো যত এগিয়ে চলল ঠাকুরদা আমার সাথে বেশি করে সময় কাটাতে লাগলেন – এতটাই, যে বাড়ি সারানোর কাজটা প্রায় বাদই পড়ে গেল। ঠাকুরদার উৎসাহে রঙিন ছবি আঁকা এবং স্কেচ করা দুটোতেই আমার একটা সত্যিকারের উৎসাহ জন্মাল। ঠাকুরদা আমাকে কোন কোনদিন বেড়াতে নিয়ে যেত এবং গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আমরা রোদের উজ্জ্বল আলোয় বসে পড়তাম আর রঙিন ক্রেয়ন দিয়ে আমি ছবি এঁকে যেতাম। সাধারণত আমরা লোকজনের ভিড় থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতাম – হয়ত লম্বা-লম্বা ঘাসে ছাওয়া আর চমৎকার দৃশ্যের কোন পাহাড়ের ঢালে। অথবা কোনো জাহাজ বানানোর জায়গায় কিংবা নূতন তৈরী হওয়া কোন কারখানায়। তারপর ট্রামে করে বাড়ি ফেরার সময় সারাদিনে আমি যেসব স্কেচ করেছি সেই সব দেখা হত।

আমাদের দিন অবশ্য শুরু হত সেই একই ভাবে – আমার বারান্দায় গিয়ে বসে ঠাকুরদার জুডো চর্চা দেখতে থাকা দিয়ে। কিন্তু ততদিনে আমরা রোজকার সকালের ছকে একটা নতুন বিষয় যোগ করে নিয়েছি। মাদুরের উপর তার নিজের চর্চা যখন মিটে যেত, ঠাকুরদা ডাক দিতেন, ‘চলে এস। দেখা যাক, আজকে তুমি আরো ভালো লড়তে পারছ কিনা।’ আমি বারান্দা থেকে নেমে মাদুরের উপর গিয়ে দাঁড়াতাম এবং ঠাকুরদার কিমোনোটা ধরতাম, যেমন ভাবে উনি দেখিয়েছিলেন – এক হাত কলারে, আরেকটা হাত কনুই এর কাছে। কয়েক বারের চেষ্টায় তাঁকে পিঠে ধরে তুলে ফেলতাম আমি। বুঝতে পারতাম যে ঠাকুরদা নিজেই আমায় তাঁকে ওঠাতে দিচ্ছেন, তবু শেষ পর্যন্ত যখন তাকে ছুঁড়ে ফেলতাম, তখন গর্বে আমার মন ভরে যেত। ঠাকুরদা অবশ্য এইটা নজর রাখতেন যে প্রতিবারই যেন সাফল্য পাওয়ার জন্য আমাকে আগের বারের চেয়ে আরেকটু বেশি চেষ্টা করতে হয়। তারপর এক সকালে আমি যতই চেষ্টা করি না কেন ঠাকুরদা কিছুতেই আর আমাকে কাজটা করতে দিলেন না।

‘লেগে থাকো ইচিরো, হাল ছেড়ো না। কিমোনোটা ঠিক ভাবে ধরছ না তুমি, ধরছ কি?’

আমি মুঠোটা ঠিক করে নিলাম।

‘বেশ। আবার চেষ্টা করো এখন।’

আমি ঘুরে গিয়ে আরো একবার চেষ্টা করলাম।

‘অনেকটা হয়েছে। তোমার পুরো পিছনটা দিয়ে জোর লাগাতে হবে। ঠাকুরদার চেহারা তোমার থেকে বড়। শুধু তোমার দুই হাত দিয়ে কাজটা হবে না।’

আমি আরও একবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঠাকুরদা কিছুতেই মাটি ছেড়ে উঠলেন না। মন খারাপ করে হাল ছেড়ে দিলাম আমি।

‘কি হলো ইচিরো, চালিয়ে যাও। এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। আর একবার চেষ্টা করো। সব ঠিকমতো করছ তুমি। সব ঠিক হচ্ছে। এই ত, আর আমার কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই এখন। এবার ছুঁড়ে ফেলো আমায়।’

এইবার ঠাকুরদা আর আমায় কোনো বাধা দিলেন না এবং আমার পায়ের কাছে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন। চোখ বন্ধ করে মাদুরে পড়ে রইলেন তিনি।

‘তুমি আমায় করতে দিলে, তাই,’ রাগ-রাগ গলায় বললাম আমি।

ঠাকুরদা চোখ খুললেন না। আমি হেসে ফেললাম। আমার মনে হল, ঠাকুরদা ভান করছেন যে তিনি মরে গেছেন। ঠাকুরদা তাও কোন সাড়া-শব্দ করলেন না।

‘ঠাকুরদা?’

এইবার ঠাকুরদা চোখ মেলে আমার অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন। ধীরে ধীরে উঠে বসলেন তিনি, মুখে একটা হতভম্ব ভাব। ঘাড়ের পিছন দিকটায় হাত বোলাচ্ছিলেন। ‘’বাঃ বাঃ,’ বললেন তিনি, ‘এইবার একেবারে ঠিকঠাক ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।’ আমার হাতের উপর দিকটা ধরলেন এবার, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই হাত সরিয়ে নিয়ে নিজের ঘাড়ের পিছনটা ছুঁলেন। তারপর একটা হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘সকালের খাবার খেতে যাওয়া যাক এখন।’

‘গাছের কাছে যাবে না তুমি?’

‘আজকে নয়। আজ সকালে ঠাকুরদার জন্য যথেষ্ট করে ফেলেছ তুমি।’

জয়ের একটা গভীর অনুভূতি জেগে উঠছিল আমার মধ্যে; এই প্রথম, ভাবলাম আমি, ঠাকুরদার কোন সাহায্য ছাড়াই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পেরেছি।

‘আমি বরং গাছের সাথে চর্চাটা সেরে আসি,’ বললাম আমি।

‘না, না,’ ঠাকুরদা তার দিকে টেনে নিলেন আমাকে, একহাত দিয়ে তখনও ঘাড়ের পিছনটা মালিশ করে চলেছেন। ‘এখন খেতে যাওয়া যাক, চলো। মানুষকে খেতে হবে ত, তা না হলে তার গায়ের জোর কমে যাবে।’

ঠাকুরদার আঁকা ছবি প্রথমবারের মত দেখার সুযোগ পেতে পেতে শরৎকাল এসে গেল। বাড়ির উপর তলায় সেই পশ্চিমের ঘরটায় কিছু বই সাজিয়ে রাখার জন্য আমি নরিকোকে সাহায্য করছিলাম। সেই সময় আমার নজরে আসে, একটা তাকে একটা বাক্স থেকে বেশ কিছু লম্বা গোল পাকানো কাগজের মাথা বেরিয়ে আছে। আমি একটাকে টেনে বার করে মেঝের উপর মেলে ধরলাম। দেখে মনে হল যেন কোন সিনেমার পোস্টার। আমি আরো ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এত কাল ধরে সেটা গোল পাকিয়ে আছে যে কিছুতেই সেটাকে মেলে ধরে রাখা যাচ্ছিল না, বারে বারে গুটিয়ে যেতে চাইছিল। আমি নরিকোকে বললাম একটা দিক ধরে রাখতে, তারপর ঘুরে গিয়ে অন্য দিকটা টেনে মেলে ধরলাম।

আমরা দুজনেই পোস্টারটার দিকে তাকালাম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন সামুরাই মাথার উপর তলোয়ার ধরে আছেন আর তার পিছন দিকে জাপানের সেনাবাহিনীর একটা পতাকা উড়ছে। ছবির প্রেক্ষাপট ঘন লাল। দেখেই আমার কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হল। সেই যখন পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম, সেই সময়ের ক্ষতটার চেহারা মনে পড়ে গেল। নিচের দিকে এক ধারে মোটা মোটা কাঞ্জি অক্ষরে কিছু কথা লেখা আছে। আমি শুধু জাপান কথাটা পড়তে পারলাম। আমি নরিকোকে জিজ্ঞাসা করলাম পোস্টারটায় কি লেখা আছে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিটার অন্য একটা অংশ দেখছিল এবং খানিকটা বিভ্রান্ত ভাবে পড়ে গেল – ‘”কাপুরুষের মত কথা বলার সময় নয় এখন, জাপানকে এগিয়ে যেতেই হবে।”‘

‘কি এটা?’

‘তোমার ঠাকুরদা বানিয়েছিলেন এটা। অনেক কাল আগে।’

‘ঠাকুরদা বানিয়েছিল এটা?’ খুবই হতাশ হলাম আমি, কারণ ছবিটা আমার একেবারেই পছন্দ হয়নি। ঠাকুরদার আঁকা ছবির সম্পর্কে একটা সম্পূর্ণ অন্য রকমের কল্পনা ছিল আমার।

‘হ্যাঁ, অনেক কাল আগে। এই যে দেখ, কোণের দিকে ওনার সই রয়েছে।’

ছবিটার নিচের দিকে আরো অনেক কথা লেখা ছিল। নরিকো মাথাটা ঘুরিয়ে সেগুলো পড়তে শুরু করল।

‘কি বলেছে ওখানে?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

খুব গম্ভীর মুখ চোখ করে সে পড়তে রইল।

‘কি বলা আছে ওখানে, নরিকো?’

নরিকো ছবিটার যে দিকটা ধরে রেখেছিল, সেটা ছেড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গেল ছবিটা। আমি আবার ওটা মেলে ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নরিকোর ওটায় আর কোনো আগ্রহ ছিল না।

‘আমি জানিনা,’ বলল সে, তারপর বই গোছানোয় ফিরে গেল। ‘এসব অনেক আগের দিনের কথা। যুদ্ধের আগে।’

আমি এই নিয়ে আর জেদ করলাম না। কিন্তু ঠিক করলাম যে ঠাকুরদাকে জিজ্ঞাসা করে আরও ভালো ভাবে সব জেনে নিতে হবে।

সেই সন্ধ্যায় আমি যথারীতি স্নানঘরের দরজার এপাশ থেকে ঠাকুরদাকে ডাকলাম। ভিতর থেকে কোন উত্তর এল না। তখন আমি আরো জোরে ডাকলাম। তারপর দরজায় লাগানো জালে কান পেতে কোন শব্দ শোনা যায় কিনা সেই চেষ্টা করলাম। ভিতরে সব কিছু মনে হলো একেবারে চুপচাপ, স্থির। আমার মনে হলো ঠাকুরদা হয়ত কোন ভাবে আমার পোস্টার দেখার কথাটা জেনে ফেলেছেন এবং আমার উপর রেগে গিয়েছেন। কিন্তু তারপর আমার মনের মধ্যে একটা অন্যরকম ভয় জেগে উঠল এবং আমি দরজাটা ঠেলে ভিতরে উঁকি দিলাম।

স্নানঘরের ভিতরটা বাষ্পে ভরে ছিল। প্রথমটায় দু এক মুহূর্তের জন্য আমি পরিষ্কার করে কিছু দেখতে পেলাম না। তারপর নজরে এল, দেয়ালের পাশে জলের চৌবাচ্চাটা থেকে ঠাকুরদা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। বাষ্পের ঘন আস্তরণের মধ্য দিয়ে তার কনুই আর ঘাড়টা দেখতে পেলাম আমি, জল থেকে শরীরটাকে তোলার চেষ্টা করছে। মুখটা ঝুলে গিয়ে চৌবাচ্চার ধারটা ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়। ঠাকুরদা পুরোপুরি নিশ্চল। যেন আর একটুও এগোনোর শক্তি নেই। শরীরটা নিজেই যেন নিজেকে আটকে ফেলেছে। আমি ঠাকুরদার কাছে দৌড়ে গেলাম।

‘ঠাকুরদা!’

ঠাকুরদা এক ভাবে পড়ে আছেন স্থির হয়ে। আমি গিয়ে তাঁকে ধরলাম। কিন্তু খুব সাবধানে। ভয় হচ্ছিল, ঘাড়টা ঝুলে যাবে আর ঠাকুরদা জলের মধ্যে তলিয়ে যাবেন।

‘ঠাকুরদা! ঠাকুরদা!’

নরিকো ছুটতে ছুটতে ঢুকে এলো ঘরে, তারপর ঠাকুরমা। ওদের কোন একজন আমাকে একধারে সরিয়ে দিল। তারপর দুজনে মিলে ঠাকুরদাকে তুলে আনবার জন্য টানা-হ্যাঁচড়া করতে থাকল। যত বার আমি সাহায্য করার জন্য এগোতে গেলাম আমাকে সরে দাঁড়াতে বলা হল। দুজনে মিলে অনেক কষ্ট করে ঠাকুরদাকে জল থেকে বার করে আনল। তারপর আমাকে বাইরে চলে যেতে বলা হল।

আমি আমার নিজের ঘরে চলে গেলাম এবং বাড়িময় চলতে থাকা ছুটোছুটিতে কান রাখলাম। কিছু কিছু গলার আওয়াজ আমি চিনতে পারিনি এবং যখনই আমি দরজাটা খুলে একটু উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছি কেউ না কেউ আমাকে খুব রাগারাগি করে বিছানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি অনেকক্ষণ জেগে শুয়ে রইলাম।

পরের দিনগুলোতে আমায় ঠাকুরদাকে দেখতে দেওয়া হয়নি এবং তিনিও ঘর থেকে বার হন নি। প্রত্যেক দিন সকালে বাড়িতে একজন নার্স চলে আসতেন এবং সারা দিন থাকতেন। আমি যতবার প্রশ্ন করতাম একই উত্তর পেতাম – ঠাকুরদা খুব অসুস্থ কিন্তু তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। আর, এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই যে অন্য যে কোন মানুষের মত তিনিও মাঝে মাঝে অসুস্থ হতে পারেন।

আমি প্রত্যেক সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় চলে যেতাম। আশা করতাম দেখতে পাবো যে, ঠাকুরদা সেরে উঠেছেন আর তার অনুশীলন শুরু করে দিয়েছেন। যখন তার দেখা পাওয়া যেত না, আমি বাগানেই থাকতাম, আশা ছাড়তাম না, যতক্ষণ না নরিকো এসে সকালের খাবারের জন্য ডেকে নিয়ে যেত।

তারপর এক সন্ধ্যায় আমাকে বলা হল, এবার আমি ঠাকুরদার ঘরে যেতে পারি। আমায় সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল যে খুব অল্প একটু সময়ের জন্যই তাকে দেখা যাবে এবং যখন আমি ভিতরে গেলাম, নরিকো আমার পাশে বসে রইল যেন আমি উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেললে সে আমাকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। দূরে এক কোনায় নার্স বসে ছিল এবং ঘরের ভিতরে রাসায়নিকের একটা গন্ধ ভাসছিল।

ঠাকুরদা একপাশ হয়ে শুয়ে ছিলেন। আমায় দেখে হাসলেন, মাথাটা একটু নাড়ালেন, কিন্তু কিছু বললেন না। আমি বুঝলাম, এখন ভদ্রলোকের মত আচরণ করার সময়, তাই শান্ত হয়ে রইলাম। শেষে একসময় বললাম, ‘ঠাকুরদা, তোমায় তাড়াতাড়ি সেরে উঠতেই হবে।’

আবারও, ঠাকুরদা হাসলেন একটু, কিন্তু কিছু বললেন না।

‘গতকাল মেপল গাছটার একটা ছবি এঁকেছি,’ বললাম আমি। ‘তোমার জন্য নিয়ে এসেছি এটা। এইখানে রেখে দিচ্ছি।’

‘দেখাও আমাকে,’ আস্তে করে বললেন তিনি।

আমি স্কেচটা বাড়িয়ে ধরলাম। ঠাকুরদা ওটা হাতে নিয়ে পিঠে ভর দিয়ে শুলেন। তিনি এই সব করায় নরিকো আমার পাশে অস্থির হয়ে উঠল।

‘ভালো হয়েছে,’ বললেন ঠাকুরদা। ‘খুব সুন্দর এঁকেছ।’

নরিকো তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে স্কেচটা নিয়ে নিল।

‘ওটা এখানেই রেখে দাও,’ ঠাকুরদা বললেন। ‘আমার সেরে উঠতে কাজে লাগবে।’

নরিকো ঠাকুরদার কাছাকাছি একটা টাটামির উপর স্কেচটা রেখে দিল আর আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। (টাটামি: এক রকমের মাদুর – অনুবাদক)

সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে গেল, আমার ঠাকুরদাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। আমি অবশ্য রোজ-ই সকালে বাগানে ঠাকুরদাকে দেখতে পাওয়ার আশা নিয়ে জেগে উঠতাম, কিন্তু তাকে সেখানে দেখা যেত না। দিনগুলো বড়ই লম্বা আর ফাঁকা লাগত।

তারপর এক সকালে, রোজকার মত সেদিনও আমি বাগানে গিয়েছি, ঠাকুরদাকে বারান্দায় দেখা গেল। ঠাকুরদা একাই সেখানে বসেছিলেন। আমি দৌড়ে ঠাকুরদার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।

‘তাহলে ইচিরো, কি করছ তুমি এখন?’

নিজের আবেগ প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় আমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আমার হিসেব মত পুরুষোচিত ভাব দেখিয়ে আমি ঠাকুরদার পাশে গিয়ে বসলাম।

‘এই, বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছি,’ বললাম আমি। ‘সকালের খাবার আগে একটু খোলা হাওয়া নিয়ে নেওয়া।’

‘বুঝলাম।’ ঠাকুরদার চোখ দুটো বাগান জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যেন প্রতিটি ঝোপঝাড় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছেন তিনি। তার দৃষ্টি অনুসরণ করছিলাম আমি। সময়টা এখন শরতের মাঝামাঝি। মাথার উপরে আকাশ ধূসর। ঝরা পাতায় গোটা বাগান ভরে আছে।

‘এবার আমায় বল দেখি, ইচিরো,’ জিজ্ঞাসা করলেন ঠাকুরদা, তখনও বাগানের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, ‘বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও?’

আমি একটু ভাবলাম, তারপর বললাম, ‘পুলিশ।’

‘পুলিশ হতে চাও?’ ঠাকুরদা আমার দিকে ফিরে হাসলেন, ‘হ্যাঁ, সেইটা একটা সত‍্যিকারের পুরুষ মানুষের মত কাজ বটে।’

‘সফল হতে গেলে আমায় অনেক অভ্যাস করতে হবে।’

‘অভ্যাস? পুলিশ হওয়ার জন্য কি অভ্যাস করবে তুমি?’

‘জুডো। আমি মাঝে মাঝে সকালে জুডো অভ্যাস করি। সকালে খেতে বসার আগে।’

ঠাকুরদার দৃষ্টি আবার বাগানে ঘুরে গেল। ‘সে তো বটেই,’ শান্ত ভাবে বললেন তিনি। ‘একজন সত্যিকারের পুরুষ মানুষের সেটাই ত কাজ।’

আমি কিছুক্ষণ ধরে ঠাকুরদাকে নজর করলাম। ‘ঠাকুরদা,’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি, ‘তোমার বয়স যখন আমার মত ছিল, কি হতে চেয়েছিলে তুমি?’

‘যখন আমার বয়স তোমার মত ছিল,’ আরো কিছুক্ষণ বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘কেন, আমি তো চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলাম। আমার মনে পড়ে না আর কোন দিন আমি অন্য কিছু হতে চেয়েছিলাম বলে।’

‘আমিও চিত্রশিল্পী হতে চাই।’

‘তাই? তুমি তো এখনই খুব ভালো ছবি আঁকো, ইচিরো। তোমার বয়সে আমি এত ভালো আঁকতে পারতাম না।‘

‘ঠাকুরদা, দেখো!’

আমি বাগানের পিছন দিকে দৌড়ে গিয়ে ঠাকুরদার গাছটার সামনে দাঁড়ালাম।

‘ইয়াহ!’ গাছটার গায়ে আমার পিছনটা ঠেকিয়ে হাত ঘুরিয়ে ওটার গুঁড়ির কাছে বেড় দিয়ে ধরলাম। ‘ইয়াহ! ইয়াহ!’

আমি মুখ তুলে তাকালাম এবং দেখলাম ঠাকুরদা প্রাণ খুলে হাসছেন। দুই হাত তুলে আমায় বাহবা দিলেন তিনি। আমিও হেসে উঠলাম। মনটা এখন আমার খুশিতে ভরে গেছে যে আমার ঠাকুরদা আবার আমার কাছে ফিরে এসেছেন। তখন আমি গাছটার দিকে ফিরে সেটাকে আরো একবার প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানালাম।

‘ইয়াহ! ইয়াহ!’

বারান্দা থেকে ঠাকুরদার জোর গলায় হাসির আর হাততালির শব্দ ভেসে এল।

********************************
লেখক পরিচিতিঃ

জাপানি বাবা-মায়ের সন্তান ব্রিটিশ নাগরিক কাজুও ইশিগুরো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ২০১৭ সালে।

ইশিগুরোর বড় হয়ে ওঠা পুরোটাই ব্রিটেনে। কিন্তু খুব ছোট থেকে তার বাবা-মা তার চেতনায় জাপানের ছবি দৃঢ় ভাবে এঁকে দিয়েছিলেন। বাড়িতে যে পরিবেশে তিনি বড় হয়ে ওঠেন তার ভাষা জাপানি, মূল্যবোধ জাপানের। তার লেখাতেও সেই প্রভাব পড়ে। প্রথম দুটি উপন্যাসের পটভূমি বেছে নেন জাপান।

বর্তমান গল্পটি প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাসের মাঝখানে প্রকাশিত। বস্তুত এটিকে দ্বিতীয় উপন্যাসের স্কেচ ধরা হয়। তার বেশিরভাগ লেখার মত এই গল্পটিও উত্তম পুরুষের জবানিতে বলা। বলছে সাত বছরের একটি বাচ্চা যে থাকতে এসেছে তার ঠাকুরদার বাড়িতে। গল্পে একই সাথে অনুপুঙ্খ বর্ণনা এবং সূক্ষ্ম আভাষের সহাবস্থান। ঠাকুরদা-নাতির কথাবার্তার মধ্যে এক বারের জন্যও মাঝের প্রজন্মের মানুষটির কথা আসে না কিন্তু খুব আলগোছে বলে যাওয়া বাক্যে সেই মানুষটিকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ট্রাজেডির সংকেত দেওয়া থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের ফলে যুদ্ধের আগের প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজের মূল্যবোধ নিয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এই চ্যালেঞ্জটাকেই ইশিগুরো এই গল্পে (এবং পরবর্তীকালে গল্প থেকে তৈরি হওয়া উপন্যাসটিতেও) ধরেছেন।

********************************

 

[প্রকাশ – গল্পপাঠ, জুলাই ২৬, ২০২১]

 

ছেঁড়া ন্যাকড়ার মত কিছু – সন্ধ্যার অন্ধকারে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল না – ঐ উঁচুতে একটা গাছের মগডালে আটকা পড়ে হাল্কা হাওয়ায় লতপত করে উড়ছে। ওদিকে আরেকটা গাছ উল্টে গিয়ে ঝোপের উপর পড়ে আছে। চারপাশে ছড়ানো ছিটানো ভাঙ্গাচোরা ডালপালা আর পাতার স্তুপ। আমার যুদ্ধের কথা মনে হচ্ছিল। ধ্বংস আর অপচয়।