কিছুমিছু – ১

হার না মানা জীবন

নির্দিষ্ট করে কোন কিছু নয়। কিছু একটা নিয়ে – যা হঠাৎ করে জলের অতল থেকে উঠে এসে ঘাই মেরে গেল অথবা নিরন্তর কুট কুট করে কামড়ে যাচ্ছে । সেই খুচরো হাসি-কান্নাগুলো ভাগ করে নেওয়া। প্রধান স্রোতের খবরদারী কি খবর্দারী করা মাধ্যমে হলে বলতাম ভাগ করে দেওয়া। সেখানকার মহাজনেরা দিয়েই খুশী। নিতে হলে তারা লেখার কি অর্থ পড়ুয়া করল তার থেকে লেখার অর্থ প্রকাশক কি করল সেটা যে অর্থ সকল অনর্থের মূল বলে প্রচারিত সেই অর্থে নিতে পছন্দ করেন। ব্লগের লেখা সেই মিনারবাসীর নয়, সাগরতীরের, মিলাবে-মিলিবে, যাবে না ফিরে।

কিছু-মিছু। কিছু একটা নিয়ে এগোতে এগোতেই মনে হয় – ধূস! হাবিজাবি, ফালতু সব, মিছামিছি টানাহ্যাঁচড়া। যা কিছু, সবই মিছু। ঐ একরকম। কিছু-মিছু। বাংলাব্লগের দুনিয়ায় আমি হাজির হয়েছিলাম গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল দিনগুলির সময়ে। মনে হচ্ছিল কিছু একটা হতে যাচ্ছে। কতকগুলি পিশাচকে শেষ পর্যন্ত হিসাব-নিকাশের আওতায় নিয়ে আসার লড়াই ত বটেই, কিন্তু সেখানেই থামা নয়, আরও বড় কিছু। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার পুনরুত্থানের দিন সমাগত। একগুছ সাহসী মানুষ জোট বেঁধেছে। তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে নানান মূলধারার শক্তিগুলিও। আমি এক তুচ্ছ মানুষ। এ আন্দোলনে আমার থাকা না থাকায় কারো কিছু যায় আসে না। তবে আমার নিজের আসে-যায়। সেই কোন যুগের ‘বাংলা’ এই কথাটায় রোমাঞ্চময় শিহরণের অনুভূতিটা ফিরে আসে, আর, স্বপ্নভঙ্গের কিছু বেদনারা চলে না গেলেও দূরে হটে। সে কিছুরা মিছু হতে শুরু করল মাত্র কয়টা মাসের ভিতরেই। আন্দোলন ঘোলা জলে মার খেয়ে গেল। আসলে, এই বোধ হয় আমাদের জীবনকাহিনী, কিছু-মিছু নিয়ে মেখে-মুখে যা হোক করে দিনগুলো পার করে দেওয়ার বারোমাস্যা।

তবু, কারো কারো অসহ্য হয়ে ওঠে কিছু-মিছুর দিন। শাস্তি নামে তাদের উপর। এরকম এক মানুষের হাতের পাঞ্জা কেটে নেয়া হয়েছিল, এক দেশে, তার এগিয়ে চলাকে থামানোর কাজে নিশ্চিত হবার জন্য। পাঞ্জা না কি থাবা? সেই থাবার নীচে এখন মাথা নামিয়ে নিয়েছে কর্তক-এর চালিকা শক্তি, তার বাণিজ্য-দুনিয়া। কেন তাকে নিয়ে বাণিজ্যকরণ সফল হয়? যাকে মারা হল তাকেই বুকে-পিঠে নিয়ে চক্রযানের সওয়ার হতে ভালোবাসল হন্তারক-এর উত্তরপ্রজন্ম! আর, সওয়ার কি সে শুধু দ্বিচক্রযানেরই হবে? সময়ের নয়? সে নিহতের হাতের রাইফেল গিয়েছে অনেককাল। তার ডায়েরী অমর। হাত বড় শক্তিশালী, একবার যদি সে অক্ষরের সাথে দোস্তি করে নেয়। কলম বলো কলম, কী বোর্ড বলো কী বোর্ড। সাপলুডু কি ক্ল গেম, যা খুশী খেলুক, একবার তার হাত থেকে অক্ষরেরা নেমে এসে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলে, একবার কুচকাওয়াজ করে নিলে, তারা কালজয়ী, ঘৃণায় বলো ঘৃণায়, প্রেমে বলো প্রেমে। চাপাতিরা ত নামবেই, ছিন্ন করবে হাত, হাতের চালক মাথাকে। কিন্তু ঐ হাতের থেকে নেমে আসা অক্ষরেরা খুঁজে নেবে নূতন মাথা, আরও অনেক মাথা। সে মাথারা হাতে তুলে নেবে কলম বলো কলম, কী বোর্ড বলো কী বোর্ড। সৃষ্টি করবে আরও তীব্র, আরও বিপুল অক্ষরের সমারোহ, যুক্তির পর যুক্তির আলোয় তারা হেঁটে যাবে অন্ধকাররের মধ্য দিয়ে, আলোর দিকে। লাগাতার বীভৎস আক্রমণ চালিয়ে গেলেও কিছুতেই সমস্ত কিছুরা মিছু হয়ে যাবে না, যায় না। আঙ্গুল কেটে নিলে, হাত কেটে নিলে, মুণ্ডু কেটে ঘিলু বার করে দিলেও না।

ইতিহাসের খাতায় এই সময়টা চিহ্নিত হয়ে থাকবে একটা ক্রান্তিকাল হয়ে। নাম দেগে দেওয়া একদল এগিয়ে থাকা চেতনার মানুষ আর তাদের সহযোগী অগ্রপথিকেরা। যারা চেয়েছিল মানুষ মানুষ হয়ে উঠুক। একজন একজন করে তারা খুন হচ্ছে আর ভবিষ্যতের পাল্লা আরও একটু একটু করে হেলে পড়ছে তাদেরই দিকে। এ ক্রান্তিকালে যারা পিছনের যুগটাকেই টেনে হিঁচড়ে আগামীর মাথায় চাপিয়ে দেয়, তারা ক্ষমতার কুমীর-ডাঙ্গার উঠানে যে যেখানেই খেলুক, নিতান্ত অসম্মানের, কুমীরের পেটে যাওয়ার নিয়তিটাই ইতিহাস তাদের জন্য বরাদ্দ করে রেখে দেবে। কোন না-ছুঁই-পানিই তাদের সময়ান্তে মনে রাখবে না, রাখে না।

 

নির্দিষ্ট করে কোন কিছু নয়। কিছু একটা নিয়ে – যা হঠাৎ করে জলের অতল থেকে উঠে এসে ঘাই মেরে গেল অথবা নিরন্তর কুট কুট করে কামড়ে যাচ্ছে । সেই খুচরো হাসি-কান্নাগুলো ভাগ করে নেওয়া।