টুকরো বাগান – Done

শক্ত খোলা ভেদ করে উঠে আসছে নরম, সবুজ কচি পাতা। সে যে কি বিপুল উত্তেজনা, কি অপূর্ব আনন্দের ঘটনা! আসার ও কত রকমফের! কেউ উঠে আসে বীজের ভিতর থেকে ছোট্ট শরীরটি বার করে। কেউ আবার মাথায় মুকুটের মত করে বীজের খোলাটিকেই ধরে থাকে। কেউ আসে জোড়া পাতা নিয়ে, কেউ আসে সরু ছুঁচলো নলের মতো হয়ে। কেউ আসে এখানে ওখানে একটি-দুটি, কেউ আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। ঠাকুমা যত্ন করে একটুখানি বীজতলা বানিয়েছে, রান্নাঘরের দেয়ালের পাশে। পুঁতে দিয়েছে লাউ কি কুমড়োর বীজ। বাবা সে জমিতে প্রথমে কয়েকটি পাটকাঠি গেঁথে তারপর সেই পাটকাঠি থেকে দড়ি টেনে দিয়েছে রান্নাঘরের ছাদের উপর। টালির ছাদ। সময় মত লাউ-কুমড়োর লতা পৌঁছে গেছে টালির উপর। তারপর ঢালু ছাদ জুড়ে তাদের ছড়িয়ে পড়া, দৌড়ে চলা। আমার কাছে পরম বিস্ময়ের ছিল লতানো গাছের আঁকশিগুলো। কি সার্থক কৌশল! ডাল থেকে বেরিয়ে এসে প্যাঁচানো স্প্রিং-এর মত আঙ্গুলে জড়িয়ে নিয়েছে কাঠি, দড়ি, টালির খাঁজ, যা পেয়েছে, যেমন পেরেছে! অবাক হয়ে ভাবতাম, কি করে বোঝে তারা – সামনে আছে কেউ নির্ভর করার মত, আঁকড়ে ধরার মত! কি করেই বা আঁকড়ে ধরে? উদ্ভিদ-বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় এ সব ধাঁধার সমাধান কিংবা তার দিকনির্দেশ আছে হয়ত। কিন্তু, আমার জ্ঞান ত সামান্যই। আমার বিস্ময় আজো যায়নি। বেড়েছে। দেখেছি আরো, শুধু গাছ নয়, মানুষও আঁকড়ে ধরে। একটু স্নেহ, একটু ভালবাসা। কাঙ্গাল প্রাণ আঁকড়ে ধরে তাকে। সোজা-উল্টো, ছোট-বড় নানান ঘেরের সে বন্ধনে কি যে টান, কি যে যাদু! বিপুল শক্তি সে মায়ার বাঁধনে। ছিন্ন যারে করতে হয় সে বোঝে বিস্তারিতে।

আমাদের বাড়িতে ফুল-ফলের চাষ ছিল নিতান্তই শখের, জীবিকার নয়। বৈচিত্র্য ছিল, তবে সবই হত অল্প পরিসরে। উঠানের একধারে, লম্বায় চওড়ায় কাছাকাছি কিন্তু পুরো সমান নয় তাই আয়তাকার এক খন্ড জমিতে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গাছের জায়গা হত। আবার সব বছর সবার জায়গা জুটতনা। কখনো সেখানে শসার মাচা, কখনো ঢেঁড়সের সারি, কখনো লাল শাকের গাছেরা দাঁড়িয়ে আছে দল বেঁধে। আর একদিকে, বেড়ার ধার ঘেঁষে সরু এক ফালি জায়গা জুড়ে কখনো পিঁয়াজকলিরা গল্প করছে, কখনো আবার শটিবনে কে জানে কাহাদের ছায়া পড়িয়াছে। ভিতর-বারান্দার ধার ঘেঁষে এক টুকরো লম্বাটে চৌকো জমিতে সর্ষের দানা ছড়িয়ে দেওয়া হত। এক সময় সেখানে মাথা তুলত সর্ষে গাছের ঝাঁক। তারপর তাতে ফুল ধরত। সবুজ জমিতে হাওয়ায় দুলতো হলুদ-এর ঢেউ। আজ দেখলে হয়ত তেমন কিছু মনে হত না। কিন্তু সে কৈশোরে সেই ঢেউ বিরাট ছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। সারি সারি হলুদ ফুলেরা – একজনে মন দিলে বাকিরা একটু ঝাপসা। হাওয়ায় হাওয়ায় দুলছে, সকলে মিলে একটাই অবয়ব। অলস দুপুরের কল্পনায় সেই ঝাপসা অবয়ব আদিগন্ত বিস্তৃত হয়ে যেত। ফুলের গাছেরাও আকারে কিছু বড় হয়ে যেত। অনেকদিন বাদে সেই কল্পনাকে প্রায় অনুরূপ একটি ছবিতে দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তফাত ছিল, ফুলের রং হলুদ নয়, লাল। সে ফুল হলুদ বরণেরও হয়। তবে লাল-এই এ বেশী পরিচিত। শিল্পীও লাল ফুল-ই এঁকেছেন। পোস্ত ফুল। শিল্পী – ক্লদ মনে। Coquelicots, La promenade (Poppies)। সে ছবির একটি প্রতিলিপি টাঙ্গিয়ে নিয়েছি ঘরের দেয়ালে। ও ছবির দিকে তাকিয়ে আমি লালের পাশাপাশি চরাচর ছেয়ে থাকা হলুদ ফুলের ক্ষেতও দেখতে পাই। ফিরে যাই উত্তরবঙ্গের সেই দিনগুলোয় এক কিশোরের মগ্নচৈতন্যে। তাই আরও অনেকদিন পরে, আন্তর্জাল-এর সুবাদে, ফ্লিকার-ফটোগ্রাফির জগতের দক্ষ শিল্পী বাখেটনির ছবিতে, যখন দেখি উঠে এসেছে সেই রকম ঝাপসা হলুদ ফুল, চমকে উঠি আমি। আমাকে দিয়ে সে ফুলেরা তখন লিখিয়ে ন্যায় নীচের পংক্তিগুলি।

ঝাপসা হলুদ ফুল

হলুদ, ঝাপসা হলুদ ফুল
চেতনার প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে,
তুমি দুলতে থাকো
আমার স্বত্ত্বার গভীরে।
ধরিত্রীর আবহমান প্রাণের উল্লাস
বাতাসে বয়ে আনে
মুক্তির গান।
মুছে যায়
বাস্তবের দুঃসহ সীমারেখা

তোমার মায়াবী সবুজ
বোঁটায়
ডাঁটায়
পাতায়
অস্তিত্বের
নিবিড় অনুভব
অমোঘ অনতিক্রম্য রেখার
সমস্ত শাসন
আর অনুশাসনের
জলাঞ্জলি দিয়ে
আমাকে ফিরিয়েই দেয়
কল্পনার অপার বিস্তার।
সৌন্দর্যের অন্তহীন আহ্লাদ
আমাকে অপ্রকৃতিস্থ করে।

ফিরে আসি
আরও একবার –
অনিবার্য আত্মলুপ্তি থেকে।

প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগের সেই দিনগুলিতে আমার মা-ঠাকুমাদের ভাঁড়ারে আজকের যুগের সার-কীটনাশকদের সমাহার ছিল না। যতদূর মনে পড়ে, গোবর, ছাই, নিম, হলুদ, চুন এই রকমের সব সামগ্রী দিয়েই চলত পুষ্টি আর প্রতিরক্ষার কাজ। বাড়িতে চাপাকল থাকায় জলের অভাব হতনা। আমাদের বাড়িতে মা-ঠাকুমার পাশাপাশি বাবাও তার ব্যস্ত সময়ের মধ্য থেকেই অবকাশ বার নিয়ে গাছেদের পরিচর্যা করত। সকলের বড় যত্ন ছিল। গাছেদের যত্ন করা অবশ্য আমাদের তিন ভাইয়ের যত্ন নেওয়ার থেকে সহজ ছিল। তারা কেউ দুষ্টুমি করে বেড়াতনা। আমরাও করতে চাইতামনা। কিন্তু করা হয়ে যেত। খেলতে খেলতেই খেলাগুলো কিভাবে, কি করে যেন ঝামেলা ডেকে আনত!

যাই খেলি না কেন, যেখানেই যাই না কেন সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসতে হত। আর, উঠানে ঢোকার দরজাটা সব সময় বন্ধ রাখতে হত। না, কোন চোর-ডাকাতের ভয়ে নয়। সে সব আমরা ভাবতাম-ই না। ঐ দরজায় কখনওই কোন তালা পড়ত না। যে কোন লোক যে কোন সময় ঐ পলকা দরজার আগল খুলে ঢুকে আসতে পারত, আসতও। কিন্তু দরজা আগল না দিয়ে রাখা যেত না। কারণ – ছাগল। কোথা দিয়ে কোথা থেকে যে তারা চলে আসত! রাস্তার ধার ধরে বাড়ি বাড়ি ঢুঁ মারতে মারতে ঘুরে বেড়াত তারা। দরজা খোলা থাকলে আর রক্ষা নেই। মুড়িয়ে গাছ খেয়ে চলত। তাড়া দিয়ে বার করতে করতে গাছের পর গাছের দফা রফা হয়ে যেত। ছাগলের মতই দু’-এক সময় গরু-বাছুর-ও ঢুকে এসেছে। কিন্তু তাদের নিয়ে বাড়ির লোকের অতটা চিন্তা ছিল না, যতটা ছিল ছাগল নিয়ে। ঠাকুমা বলত, গরুতে মুখ দিলে গাছের স্থায়ী ক্ষতি হয়না। কিন্ত ছাগলে মুখ দিলে আর রক্ষা নেই, সে গাছের বাঁচা কঠিন হয়ে যায়।

শক্ত খোলা ভেদ করে উঠে আসছে নরম, সবুজ কচি পাতা। সে যে কি বিপুল উত্তেজনা, কি অপূর্ব আনন্দের ঘটনা! আসার ও কত রকমফের! কেউ উঠে আসে বীজের ভিতর থেকে ছোট্ট শরীরটি বার করে। কেউ আবার মাথায় মুকুটের মত করে বীজের খোলাটিকেই ধরে থাকে। কেউ আসে জোড়া পাতা নিয়ে, কেউ আসে সরু ছুঁচলো নলের মতো হয়ে।…