ফাউ – Done
আমাদের ছোটবেলায় একটা দৃশ্য খুব সাধারণ ছিল। রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালা হেঁটে যেত রকমারী বিচিত্র হাঁক দিতে, দিতে। বাংলা সাহিত্যে নানা লেখায় এই ফেরিওয়ালারা অমর হয়ে আছেন। অচেনা, অজানা মানুষেরা ক্ষতি করে রেখে যাবে – এমন আশঙ্কায় জীবন কাটাতেন না আমাদের মা-ঠাকুমারা। এত হরেক কিসিমের ভয়ে বাঁচার জীবন ছিল না তখন! অনায়াসে এই ফেরিওয়ালারা ঢুকে আসতেন বাড়ির অন্দর মহলে। মা-ঠাকুমারা বিনা-দ্বিধায় কেনা কাটা করতেন তাদের থেকে।
এই কেনাকাটার অতি আবশ্যিক অঙ্গ ছিল দরদাম করা। আমার সেই ঘোর শৈশবের একটিমাত্র দরদাম আমার মনে আছে – যেন কয়েকটি স্থিরচিত্রর সমন্বয়ে একটা ছোট্ট ভিডিও – তিনটি ছোট ছোট মানুষকে নিয়ে। আর দুটি পূর্ণ-বয়স্ক মানুষ – একজন মুড়িওয়ালা, আর দ্বিতীয়জন আমার সাদা থান পড়া, ছোট ছোট চুলের বালবিধবা ঠাকুমা। কেনাকাটায় ঠাকুমার কথাই শেষ কথা। মুড়িওয়ালাও সেটায় ভালমতই অভ্যস্ত। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। মুড়িওয়ালা শুরু করত এই দিয়ে যে এবার আর সম্ভব নয় – বাকিটা সে কী বলত সেটা অনুমান করা যেতে পারে কিন্তু সেটা আমার বোধের আওতার মধ্যে পড়ত না, মনেও নেই তাই। আমার শুধু মনে আছে যে, সে মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছে উঁচু বস্তাটার ও পাশে দাঁড়িয়ে। আর এদিকে একটা ইয়া বড় সড় খালি কৌটো হাতে নিয়ে ঠাকুমা দাবি করে যাচ্ছে যে আগে তার দাবি পূরণ করতে হবে তার পর বেচাকেনা।
কী সেই দাবি? ঐ যে – মুড়ির বস্তা আর ঠাকুমার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে তিন মানবক। সবচেয়ে ছোটটি, বছর দেড়-দুয়েক-এর, দু হাতে ধরে আছে একটি বাটি তার মুখের উচ্চতায়। মেজটির হাতের বাটিটি আর একটু উঁচুতে ধরা। আমি সবচেয়ে বড়টি, বছর পাঁচেক-এর, বাটি ধরে রেখেছি এক হাতে আমার মাথা ছাড়িয়ে। ঠাকুমা বলে যাচ্ছে “আগে অগ বাটিতে ফাউ দাও, তারপর তোমার পাল্লা বাইর কইর।” প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত মুড়িওয়ালা বাটিগুলি হাতে নিয়ে তাতে মুঠোয় করে মুড়ি তুলে দিত। ঠাকুমা আবার দেখে নিত সেই দেওয়ার পরিমাণ ঠিক হল কি না। ফাউয়ের হিসাব মিটলে তবে শুরু হত আসল কেনা কেটা।
বাবার একেবারে পছন্দ ছিলনা এ ব্যাপারটা। আশ্চর্যের হচ্ছে, মুড়িওয়ালা কখনোই বাবা ঘরে থাকলে বাড়িতে আসতনা। তার বোধহয় ভয় ছিল যে বাবা দরাদরিতে বিরক্ত হলে তার এবাড়িতে মুড়ি বেচাটাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই, সংগ্রামী ঠাকুমা আর আমাদের জন্য ঐ কষ্টার্জিত ফাউয়ের আকর্ষণ চালু রেখেই সে ধরে রেখেছিল আমাদের বাড়িতে তার মুড়ির ব্যবসা যতদিন না বাবা তাঁর চাকরির কারণে সেখানকার পাট উঠিয়ে আমাদের নিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন।
আমার মায়ের কাছে এই ফাউ-এর জন্য হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা, হাফপ্যান্ট বা পায়জামা পরা, কখনো-জামা-কখনো-নিমা গায়ে (তখন আমাদের বাড়িতে ছোটদের জন্য গেঞ্জি অত সচল ছিল না। সেলাই-জানা মায়ের বানান গেঞ্জি-কাটিং-এর নিমা পড়তাম তিনজনেই) প্রায় ভিখারির মত তিন সন্তানের ছবি মোটে পছন্দ ছিল না। প্রবল প্রতাপের ঠাকুমার মুখের উপর কথা বলতে পারত না বলে মেনে নিতে হত। বেচারী মা! জানত না দুনিয়া চলে ফাউয়ে।
আমার ছোটবেলার প্রথম স্কুলে (আমার প্রায় মিলিটারী বাবার রাজত্বে স্কুল-কে কিছুতেই ইস্কুল বলা চলত না), আমার সবচেয়ে প্রিয় দিনটি ছিল ১৫-ই আগস্ট। সকালবেলায় স্কুলে যাওয়া হত। কিন্তু তারপর কোন ক্লাস হত না। ছোট ছোট পতাকা হাতে নিয়ে ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে-মিশে বেড়িয়ে পড়তাম মিছিল করে। প্রভাতফেরী। আশপাশের আরো নানা স্কুল-এর ছেলেমেয়েরাও একই ভাবে বেড়িয়ে পড়ত। এ-রাস্তা ও-রাস্তা ঘুরে আমরা যখন আবার স্কুলে ফিরে এসে লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়তাম, তখন আসত সেই শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত – আমাদের প্রত্যেককে দেওয়া হত দুটি করে জিলিপি। কি যে অপূর্ব স্বাদ সেই জিলিপির – অমন আর কোথাও খাইনি, হ্যাঁ- অ্যা – অ্যা – অ্যা!
আমার তৃতীয় বর্ষ, মেজভাইয়ের প্রথম। মেজোভাইয়ের থেকে দু বছরের ছোট, কনিষ্ঠতমটি তখনো স্কুলে ভর্তি হয় নি। কিন্তু তা বলে সে কি জিলিপির মিছিলে যোগ দেবে না! আমাদের কাউকে না জানিয়ে সেই পনের-ই আগস্টে সে হাজির হয়ে গেল আমাদের স্কুলে আর বাড়ি ফিরে এসে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল – তার দু হাতে দু-টি জিলিপি! ছোট্ট একেকটি হাতে একটির বেশি আঁটে নি। আমি নিশ্চিত – জিলিপি দিচ্ছিলেন যে দিদিমনি তিনি এই অছাত্রটিকেও জিলিপি দিতে একটুও দ্বিধা করেন নি। তখনকার মানুষগুলি এমনই ছিলেন। তবে হ্যাঁ, আমরা গলে জল হয়ে গিয়েছিলাম। আমি আজও নিশ্চিত যে সেখান থেকে চলে না গেলে আমাদের কনিষ্ঠতমটিও ঐ স্কুলেই ভর্ত্তি হত। ফাউ জিলিপির শক্তিকে খাটো করে দেখার কোন কারণ নেই।
যত বড় হলাম, দেখলাম দুনিয়া জুড়ে ফাউয়ের ছড়াছড়ি! দেখলাম, দুনিয়া ফাউয়ের বশ! সিঙ্গাড়া পাওয়া যেত দশ পয়সায় চারটা। হিসাব মত বিশ পয়সায় হত আটটা আর চার আনায় দশটা। আর এইখানেই আমরা দাবী করতাম আরো একটা পাওয়ার জন্য। এবং পেয়েও যেতাম। সব সময় যে একই জিনিস ফাউ জুটত তা নয়। এক টাকার সন্দেশ কিনলে একটা গুজিয়া মুফ্ত। আর যে দোকানে গেলে দুই বাচ্চার হাতে দুটো গুজিয়া তুলে দিত – সে দোকানে তো বার বার যাওয়া ছিল – সন্দেশ ছোট হোক আর বড় হোক। আরো একটু বড় হতে এসে গেল – বাটার নতুন জুতো! উৎসবের সময় কিনলে সাথে ফাউ মিলবে অসাধারণ সব মুখোশ কিংবা রঙ্গিন চশমা।
একেবারে হাল আমলে প্রযুক্তির অসামান্য বিকাশে সমাজ মাধ্যমে সমাজের বিপুল অংশের নিরন্তর অংশগ্রহণ ফাউয়ের নতুন মাত্রা হাজির করেছে। তাদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকার দাবির সাথে তাল মেলানোর তাগিদে খবরের সাথে ফাউ খবর তথা গুজব আর বিনোদনের যোগান দিতে দিতে খবর নিজেই ফাউ হয়ে যাচ্ছে।
ছোট ফাউ, বড় ফাউ। এক ১৫-ই আগস্টে শাসকের কমনওয়েলথে, শাসকের-ই সেনাপতির অধীনে থেকে যাওয়া স্বাধীনতার সাথে দেশভাগ ফাউ। পাশের দেশে আরেক ১৫ই অগাস্টে সে দেশের স্বাধীনতার রূপকারকে হত্যা করে তার সব চিহ্ন মুছে ফেলে মৌলবাদের হাতে দেশকে তুলে দিতে পারলে মসনদ লাভের পাশাপাশি সংখ্যালঘু বিতাড়ন ফাউ। দেশকে উদারনীতির পথ থেকে ফিরিয়ে মধ্যযুগের দিকে ঠেলে দিতে পারলে অবশ্য সব দেশেই, সংখ্যালঘু বিতাড়নের আর নিষ্পেষণের আনন্দটা ফাউ পাওয়া যায়।
অপছন্দের শাসনের অবসান ঘটলে বিভিন্নজনের নানা সামান্য-অসামান্য প্রাপ্তি ফাউ হিসেবে জুটে গেলে, আরও যা যা জুটে যেতে পারে, যাওয়ার কথা ছিল, যাওয়া উচিত-ই ছিল ইত্যাকার বিষয়ে প্রচুর গবেষণা নিরন্তর হতে থাকে, আমজনতা থেকে বিদ্দ্বজ্জন, কপাল চাপড়ানো ভুক্তভোগী বা ঢেকুর তুলতে থাকা লাভের কারবারি, করে থাকেন, করবেন সে সব। আমি স্বভাবতই প্রগাঢ় আলোচনার হকদার নই। আমি শুধু জানি, ফাউয়ের গল্প চলতেই থাকে, সর্বাধিনায়ক মনের মত পাওয়া গেলে বিচারব্যবস্থাকে নিজের মত করে সাজিয়ে তোলাটা ফ্রি, হাতে গরম ফাউ। কত রকমের ফাউ! যাদের যাদের পছন্দ নয়, সব দূর করে দেব দেশ থেকে, লকআপে ঢুকিয়ে দেব, চেপে রেখে দেব হাঁটুর নীচে, জনতার হাতে মৃত্যু, পালাতে গিয়ে মৃত্যু। একেক দেশে একেক রকম। সব পেয়ে যাবেন, মুফত, ফাউ, শুধু ভোটটা আমাকে দেবেন, আমার দলকে দেবেন। আমার দিকে থাকবেন। যেমন খুশী প্রবল হৈ হৈ, উল্লাস-এর মধ্যে থাকবেন। সাথে ফাউ পেয়ে যাবেন – অনাহারে কি মারি-মড়কে কি অন্য, অন্য অনিবার্য কারণে সামান্য কিছু মৃত্যু। হয়ত চলে যাবেন এমন কেঊ যিনি বেঁচে থাকলে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যেতেন আরও কয়েক পা। ও কিছু না।
পরবর্তীতে ফাউয়ের অসাধারণ খেলা দেখেছিলাম এক বই-এ। অ্যাস্টারিক্স সিরিজের ‘ওবেলিক্স অ্যান্ড কোম্পানি’-তে। ধনতন্ত্রের পাকে জড়িয়ে পিষে ফেলার জন্য সরলমতি ওবেলিক্স-কে মেনহীয়র বেচে বড়লোক হবার চক্করে নামিয়ে দেয় ধুরন্ধর এক পাজি, রোমান অর্থনীতি বিশারদ। আখাম্বা পাথরের, ধূমসো ছুঁচলো চাঙ্গড় মেনহীয়র দুনিয়ার কোন কাজে লাগে না। এমন মূল্যহীন বস্তুকেও স্রেফ প্রচারের জোরে মূল্যবান করে তোলা হল। ওবেলিক্স তার দলবল সমেত সর্বস্ব লাগিয়ে দিল এমন হতচ্ছাড়া জিনিস বানাতে আর বেচতে। ঘুচে গেল তাদের সহজ সরল জীবন-যাপন। একে একে মাঠে নেমে পড়ল গাদা গাদা প্রতিদ্বন্দী ব্যবসায়ী। অবধারিতভাবে একসময় কমতে লাগল মেনহীয়র-এর চাহিদা। শুরু হল মেনহীয়র কিনলে ফাউ মেনহীয়র পাওয়া। তারপর ফাউ হিসেবে মেনহীয়র-এর সাথে অন্য কোন আকর্ষনীয় জিনিস, একসময় অন্য জিনিস কিনলে মেনহীয়র ফাউ! শেষে মেনহীয়র আবর্জনা হয়ে গেল। ভরাডুবি ঘটল মেনহীয়র-সংস্কৃতির।
বইটি অ্যাস্টারিক্স কমেডির স্বভাবসিদ্ধ শৈলীতে ধনতন্ত্রের গন্ডদেশে বিরাশী সিক্কার থাপ্পড়। তবে ধনতন্ত্রের তাতে কিচ্ছু যায় আসে নি। আমাদের চারপাশে ফাউ-এর স্রোত। Buy-one-get-one, buy-two-get-the-third-free. সবসময় ফাউ হিসেবে জিনিস-ও দিতে লাগছে না। দাম-এর একটা অংশ, দিন বিশেষে বিক্রি বাবদ সরকারের প্রাপ্য হওয়া খাজনা-টাকেই মকুব করে ফাউ দিয়ে দিচ্ছে।
ফাউয়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে একসময় নিজেরই ফাউ হয়ে যাওয়া। তবু এও জানি, আমাদের ফাউ হয়ে যাওয়াই শেষ কথা নয়। ইতিহাস সাক্ষী থাকে, সাথে ফাউ দাও, আর ফাউ হিসাবেই দাও, বেচতে বেচতে একসময় আবর্জনা হয়ে যায় মেনহীয়র, দেউলে হয়ে যায় মেনহীয়রের বিক্রেতা, কালের ফাউ।
আমাদের ছোটবেলায় একটা দৃশ্য খুব সাধারণ ছিল। রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালা হেঁটে যেত রকমারী বিচিত্র হাঁক দিতে, দিতে। বাংলা সাহিত্যে নানা লেখায় এই ফেরিওয়ালারা অমর হয়ে আছেন। অচেনা, অজানা মানুষেরা ক্ষতি করে রেখে যাবে – এমন আশঙ্কায় জীবন কাটাতেন না আমাদের মা-ঠাকুমারা। এত হরেক কিসিমের ভয়ে বাঁচার জীবন ছিল না তখন! অনায়াসে এই ফেরিওয়ালারা ঢুকে আসতেন…
Recent Posts
Categories
- Blog
- Book Chapter
- featured
- অঞ্জলি
- অনুবাদ
- অনূদিত কবিতা
- অনূদিত গল্প
- আলাস্কা গ্লেসিয়ার বে
- ঈশপের গল্প
- কবিতা
- কিছুমিছু
- ক্যালিডোস্কোপ
- ক্রুজ
- গল্পপাঠ
- গুরুচন্ডালি
- ছোট গল্প
- টুকিটাকি
- দুকূল
- নীতিকথার অনুবাদ
- পাঠ প্রতিক্রিয়া
- ফটোগ্রাফি
- বইয়ের হাট
- বাছাই
- বেড়ানোর গল্প
- মৌলিক কবিতা
- রুট ৬৬ গ্রুপ পোস্ট
- রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০
- সচলায়তন
- স্মৃতিকথা