ক্যালিডোস্কোপে দেখি – ১৪

ক্যালিডোস্কোপ-৮ || ইকড়ি মিকড়ি

*** ***

উপরে যে কড়িটা ছুঁড়ে দিয়েছি সেটা নেমে আসার আগেই যেগুলো মাটিতে পড়ে আছে তার থেকে দুটোকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিতে হবে। উপরেরটাকেও মাটি ছুঁতে দেওয়া যাবে না, নিয়ে নিতে হবে সেটাকেও। এটা পারলে এর পর মাটিতে ছড়িয়ে থাকা গুলোর থেকে তিনটাকে নিয়ে মোট চারখানাকে মুঠোর মধ্যে নিতে হবে। সেইটা আমি হেরে যাবো বলেই মনে হয়। কিন্তু মেয়েরা যে কেউ সব কটা কড়ি-ই অনায়াসে মুঠোর মধ্যে নিয়ে নেবে। এইটা যদিও বা পারি, উপরে ছুঁড়ে দিয়ে হাতের উল্টোপিঠে ধরে নেওয়াটা আমি দুটোর বেশী কখনোই পারি না – সে কড়ি দিয়েই খেলি, কি খোয়ার টুকরো দিয়ে।

কড়িগুলো হারিয়ে গেছে কোন কালেই, অন্য গুটিগুলোও নেই। নেই সেই খেলার সঙ্গী-সঙ্গিনীরাও। আমি এখন একা একাই খেলি অদৃশ্য কড়ি নিয়ে, গুটি নিয়ে, একই রকম অদক্ষতার সাথে। খেলতে খেলতে দেখি মেয়েরা অনায়াসেই ধরে রাখে কঠিন গুটিগুলিকে এমনকি হাতের উল্টোপিঠ দিয়েও। তাদের মুঠোর মধ্যে তারা চাইলেই নিয়ে নেয় যতগুলি খুশী কড়ি। আর, ভীষণ দর্পিত পৌরুষ মেরে-পিটিয়ে তাদের মুঠো খুলে সেই কড়িগুলি নিয়ে চলে যায়।

একসময়ে কড়ি ছিল বিনিময়-মাধ্যম। ফেলো কড়ি মাখো তেল – বাংলার পুরান প্রবচন। সম্ভবতঃ ইংরেজ রাজত্বের ফলে কড়ি হারিয়েছিল তার সেই সোনার সিংহাসন। আমার শৈশবের দিনগুলিতে তাকে দেখেছি আমাদের খেলাঘর আলো করে থাকতে। সব বাড়িতেই দেখা মিলত তার। কত আকারের, কত যে রূপের! কোথায় গেল তারা!

খুব অল্পেই জমে উঠত আমাদের খেলা। এমন কি কড়িও লাগত না, কুচো কুচো ইঁট-পাথরের টুকরো, খেজুরের বীচি, এতেই হয়ে যেত। তাও যদি না জুটত, তাতেও আটকাত না। দুই হাতের পাতা মেঝের উপর ছড়িয়ে বসে গেছি দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় জন, যখন যেদিন যেমন জোটে। তারপর একজন ছড়িয়ে থাকা আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে গোনার মত করে বলে যাচ্ছে ছড়া –
ইকড়ি মিকড়ি
চাম চিকড়ি
চাম কাটে মজুমদার*
ধেয়ে এলো দামোদর
দামোদরে হাঁড়িকুঁড়ি
দুয়ারে বসে চাল কাঁড়ি
চাল কাঁড়তে হ’ল বেলা
ভাত খাবি আয় এই বেলা
ভাতে পড়লো মাছি
কোদাল দিয়ে চাঁছি
কোদাল হলো ভোঁতা
খা শিয়ালের মাথা।।
কার লেখা এ ছড়া জানা নেই। বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথের রচনায় কিছুটা ভিন্ন রূপে পেয়েছি একে।
ছড়ার শেষ পংক্তির শেষ শব্দ ‘মাথা’ বলতাম আমরা ভেঙ্গে ভেঙ্গে, মা আর থা আলাদা আলাদা আঙ্গুলে। যে আঙ্গুলে থা বলা হল, সে আঙ্গুল গুটিয়ে নেওয়া হল। এই করতে করতে শেষ যার হাতে না গুটানো আঙ্গুল পড়ে রইল, হার হত তার।

এই ছড়া কি শুধুই ছড়া? না কি কোন করুণ দিনের ছবি ধরা আছে এই ছড়ায়? যখন কিছুই জোটেনি, জোটানো যায়নি, সেই সব দিনের কান্না কি ধরা আছে এই ছড়ায়? হয়ত ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়েছে দেশে, মড়ক লেগেছে, চারপাশে মৃত পশুদের ছড়াছড়ি। যার যা কাজ ছিল, সব গেছে। পদবী যার মজুমদার কাজ করতেন নিশ্চয়ই কোন উঁচু পদে। আজ তার কাজ নেই। মৃত পশুর চামড়া কেটে দিন গুজরান হয়। এর মাঝে বন্যা এল দামোদরে। হাঁড়ি-কুড়ি যা ছিল, ভেসে গেল সব। অনেক কষ্টে হয়ত কিছু চাল জুটেছে, তা এমন আছাঁটা, এমন ধূলোয় কাঁকড়ে মেশামেশি যে না বেছে, না ঘষে, না পরিষ্কার করে খাওয়া যায়না। সেই চাল খাওয়ার উপযোগী করতে করতে অনেক বেলা হয়ে গেল। একসময় চাল ফুটিয়ে ভাত করা হল। আকাল-মড়কের সেই দিনে চারপাশে মাছি ভনভন করছে। মাছি তাড়িয়ে ভাত খেতে গিয়ে ভাত ছড়িয়ে পড়েছে খাবারের পাত থেকে মাটিতে। কিন্তু একটা দানা ভাত ও অমূল্য, নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। দরকার হলে কোদাল দিয়ে চেঁছেও সেই ভাত কুড়িয়ে আনা লাগে। ভাত কুড়ানোর ব্যস্ততায় কখন যে শিয়ালে এসে মুখ দিয়ে দিল বাকি ভাতে! তারও তো কিছু জোটে না। ছাগল-হাঁস সব মানুষ-ই খেয়ে ফেলেছে কবে! কল্পনা করি নিজেকে সেই অন্ধ রাগের মুহূর্তে। ভোঁতা কোদাল বসিয়ে দিয়েছি শিয়ালের উপর। মাথা ভেঙ্গে গেছে তার। এখন শিয়ালের মাথা ছাড়া খাওয়ার আর কিছু নেই, কিচ্ছু না।

লোককথার ছড়ায় ছড়ায় ধরা থাকে সময়ের দিনলিপি, জীবনের চালচিত্র। আজকের যুগেও কি মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত ছড়ায়-গানে ধরা থাকছে জীবনের কাহিনী? জানি না। বিপুল পরিমাণ কাহিনী এখন নির্মিত হয় অর্থ-চালিত নানা মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে। তবে এ দুনিয়াকে আমার বড়ই আশ্চর্যের লাগে। অবাক হয়ে দেখি কি ভাবে কি ভাবে যেন সাধারণ মানুষের স্বর ঠিকই তার পথ খুঁজে নেয়, শক্তিমানের চোখের সামনেই, তার নিয়ন্ত্রণের চাপকে দিব্যি সামলে নিয়ে! এ যুগের নানা ছবি ধরে রাখছে এ যুগের এক গণমাধ্যম – বিভিন্ন ব্লগরা। সাধারণ মানুষের লেখায় সেখানে ধরা থাকছে আজকের যুগের কাহিনীরা। লেখকদের মত করে, পাঠকদের প্রতিক্রিয়া সহ। সম্মেলক গান যেন। এমনি করেই কোন ব্লগে চলছে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ডুবিয়ে দেওয়ার লাগাতার প্রচেষ্টা। আবার এর বিপরীতে কোথাও থাকছে এই শয়তানীর অনুপুঙ্খ খতিয়ান। ধরা থাকছে শয়তানী বানচাল করার অদম্য লড়াইয়ের কাহিনী – দিনের পর দিন, সচলায়তনে প্রকাশিত গল্পে, প্রবন্ধে, ফটোব্লগে, আঁকায়, ব্যানারে, কবিতায়, আবৃত্তিতে আর গানের ঝর্ণাধারায়।

* কবিতাটা নিয়ে আরো অনেক কিছু লেখার আছে মনে হয়। এটা কি আসলে সেই সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময়টাকে ধরেছে, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে যে দিনগুলোর ছবি ধরা আছে? মজুমদার-রা সম্ভবতঃ শাসকদের হিসাব রক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকত। কবিতার মধ্য দিয়ে আসলে কি তাদের অত্যাচারের কথা বলা হল? সাধারণ মানুষ খাজনা দিতে না পারলে তাদের গরু-ছাগল নিয়ে নেওয়ার পর সেই প্রাণীগুলির ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে তাই দিয়েই রাজস্ব সংগ্রহের কাহিনী কি এই ছড়া? না কি রূপকার্থে তাদের কাজের চাবুক, কিংবা সত্যি চাবুক প্রজাদের চামড়ায় কেটে বসার ছবি ধরা রইল? আমাদের লোককথাগুলি ইতিহাসের আধার – আলোর এবং আঁধারের। আমার ইচ্ছে ছিল ভবিষ্যত গবেষকদের কৌতুহল জাগিয়ে দেওয়ার জন্য একটু বিড়বিড় করে রাখা। সে’টুকুই করে নিলাম।

বাংলা আন্তর্জাল পত্রিকা Bookপকেট-এ “পদবিনামা : বাঙালি জাতির পদবি-বিবর্তন এবং পদবি-ইতিহাসের চালচলন” প্রবন্ধে অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন”
“ব্রাহ্মণগণ বর্ণভেদ প্রচলন করেছিলেন ঠিকই, তার মানে এই নয় যে বর্তমানে পদবিরাজের মহিরূহ অবস্থার জন্য ব্রাহ্মণগণদের পুরোপুরি দায়ী করা যায় ! ব্রাহ্মণগণ শুরু করলেও শেষ করেছেন সমাজের একশ্রেণির প্রতিপত্তি এবং প্রভাবশালী অব্রাহ্মণ এবং সুবিধাভোগী সম্প্রদায়। উদ্দেশ্য ব্রাহ্মণ তথা বর্ণহিন্দুদের উচ্চতায় উঠবার লিপ্সা। সমাজের যে স্তরের মানুষ যেই ক্ষেত্রে প্রভাব-প্রতিপত্তিতে বলীয়ান হলেন, সেই ক্ষেত্রেই প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন স্বজাতি হলেও সেইসব মানুষদেরকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন । যে “মজুমদার” বংশে প্রতিপত্তি বেড়ে গেল সে হল কুলীন কায়স্থ, আর বাকি পিছিয়ে-পড়া “মজুমদার” হয়ে গেল শূদ্র। শূদ্র মজুমদাররাও কম যায় না, তাদের থেকেও পিছিয়ে-পড়া এবং দুর্বল মজুমদারদের কাপালিক বলে ঘৃণ্য করে দিল।নানা সময়ে পদবির বিবর্তনের ফলে পদবি এক হলেও গোষ্ঠী এক হলেও তাদের সবারই একইরকম পেশার পরম্পরা ছিল না।” antorrjale আন্তর্জালে লেখাটির ঠিকানা পাল্টে গেছে। বর্তমান ঠিকানা (https://sanatandharmatattva.wordpress.com/2015/05/03/পদবিনামা-বাঙালি-জাতির-পদ/)

এইটি হিসেবে নিলে আমার মনে হচ্ছে, এককালের ধনী মজুমদারের অবস্থা বিপাকে মৃত পশুর চামড়া ছাড়ানোর বৃত্তি গ্রহন করে শূদ্র মজুমদার হয়ে যাওয়াকেই এই কবিতাতে ধরে রাখা হয়েছে।

[প্রকাশিত – সচলায়তন, জুন ১০, ২০১৪]

ক্যালিডোস্কোপ-৮ || ইকড়ি মিকড়ি *** *** উপরে যে কড়িটা ছুঁড়ে দিয়েছি সেটা নেমে আসার আগেই যেগুলো মাটিতে পড়ে আছে তার থেকে দুটোকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিতে হবে। উপরেরটাকেও মাটি ছুঁতে দেওয়া যাবে না, নিয়ে নিতে হবে সেটাকেও। এটা পারলে এর পর মাটিতে ছড়িয়ে থাকা গুলোর থেকে তিনটাকে নিয়ে মোট চারখানাকে মুঠোর মধ্যে নিতে হবে। সেইটা…