ঈশপের গল্প – ৩৬ থেকে ৪০

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(৩৬)
The Shepherd and the Wolf

রাখাল আর নেকড়ে

এক রাখাল একবার এক নেকড়ের বাচ্চা কুড়িয়ে পেল। বাচ্চাটাকে সে বড় করল। তারপর একসময় ওটাকে সে পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে ভেড়া চুরি করতে শেখাল। সময়ের সাথে সাথে নেকড়েটা এক ওস্তাদ চোর হয়ে উঠল। তখন সে একদিন রাখাল-কে ডেকে বলল – “আমাকে তো খুব করে চুরি করতে শিখিয়েছ। এবার আমার উপরে ভাল রকম নজর রাখতে ভুলো না। তা না হলে কোনদিন দেখবে তোমার নিজের ভেড়াই কমে গেছে।”

প্রাচীন বচনঃ কাউকে খারাপ কাজ করতে শেখালে সেই কুশিক্ষা একদিন নিজের উপরেই ফিরে আসতে পারে।

আমি বলিঃ শয়তানদের যারা কাজে লাগায় শয়তানদের হাতেই তারা একসময় লুট হয়। লোভী আমজনতা থেকে উচ্চাকাঙ্খী রাজনৈতিক – বারে বারে এই ফাঁদে আটকা পড়ে তবু আবারো একই কাজ করে!

(৩৭)
The Dove and the Crow

ঘুঘু পাখি আর কাক

খাঁচায় বন্দী এক ঘুঘুপাখি খুব লম্বা-চওড়া কথা বলছিল। সব্বাইকে সে ডেকে ডেকে জানাচ্ছিল যে তার পরিবারের আয়তন বিশাল – অনেক বাচ্চা-কাচ্চা আছে তার। সে সব শুনে এক কাক তাকে বলল, “দোস্ত, এই সব খামখা বড় বড় কথা বলা এবারে বাদ দাও। পরিবার বড় হওয়া মানে খাঁচায় আটক-এর সংখ্যা আরো বেড়ে যাওয়া। আর তার মানে, তোমার দুঃখের পরিমাণ-ও বাড়ল ততটাই!”

প্রাচীন বচনঃ স্বাধীনতা না থাকলে আনন্দ উপভোগ করা যায় না।

আমি বলিঃ স্বাধীন না থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে যাদের, নানা রকম প্রাপ্তির বড়াই-এর ঢাক পিটিয়ে তারা আসলে ক্রমাগত নিজেদের দৈন্য আর দুর্দশাকে আড়াল করার বিফল চেষ্টা করে চলে।

(৩৮)
The Old Man and the Three Young Men

এক বৃদ্ধ আর তিন যুবক

এক বৃদ্ধ একদিন একটা চারাগাছ লাগাচ্ছিলেন। তিন যুবক সেই সময় সেখানে এসে পড়ে। তারা তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা শুরু করে দিল, “এই বয়সে আপনি গাছ লাগাচ্ছেন! কি বোকামি, কি বোকামি! ! এই গাছে ফল ধরতে কে জানে কত বছর লেগে যাবে। কিন্তু, আপনার নিজের দিন তো আর বিশেষ বাকি নেই! নিজে চলে যাওয়ার বহু বছর বাদের লোকজনদের সাথে খুশী বাঁটবেন বলে এখনকার সময়টা নষ্ট করছেন আপনি। কোনো মানে হয় এর?” বৃদ্ধ কাজ থামিয়ে উত্তর দিলেন, “আমার আগে যাঁরা এই দুনিয়ায় এসেছিলেন তাঁরা আমার খুশীর ব্যবস্থা করে গেছেন। এখন আমার কাজ আমার পরে যারা আসবে তাদের খুশীর ব্যবস্থা করা। আর জীবনের কথা যদি বলো, কেউ কি নিশ্চিত করে জানে কখন কি ঘটে যাবে? হয়ত আমার আগেই তোমরা সবাই মারা যাবে, কে জানে!” বৃদ্ধের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছিল। তিন যুবকের একজন সমুদ্রযাত্রায় গিয়ে সাগরে ডুবে গেল। একজন যুদ্ধে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা পড়ল। আর, তৃতীয় জন গাছ থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙ্গে মারা গেল।

প্রাচীন বচনঃ শুধুই নিজেদের কথা ভাবতে নেই। আর, মনে রাখা ভাল যে জীবন নিতান্তই অনিশ্চিত।

আমি বলিঃ ঈশপ লিখে গেছেন আমাদের জন্য, আমি লিখে রাখি পরবর্ত্তীদের জন্য। জানি জীবন অনিশ্চিত, কিন্তু আমার সময় যে প্রতিদিন কমে যাচ্ছে, সেটা নিশ্চিত। তাই যা করতে চাই তার জন্য দেরী না করাই ভাল।

(৩৯)
The Lion and the Fox

সিংহ আর শিয়াল

একবার এক শিয়াল এক সিংহের সাথে জুটি বাঁধল। ঠিক হল সিংহ যেমন যেমন বলবে, শিয়াল তেমন তেমন তার কথা অনুসারে চলবে। যার যার ক্ষমতা আর গুণ অনুসারে তারা নিজেদের কাজ ভাগ করে নিল। শিয়াল শিকার খুঁজে বার করে সিংহকে দেখিয়ে দিত। সিংহ তখন জন্তুটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটাকে শিকার করত। চলছিল ভালই। কিন্তু আস্তে আস্তে শিয়ালের হিংসে হতে থাকল। শিকারের বেশীটাই সিংহের পেটে যায়। শিয়াল একদিন জানিয়ে দিল যে সে আর সিংহের জন্য শিকার খুঁজে দিতে পারবে না। আর তার নিজের শিকার সে নিজেই যোগাড় করে নেবে। পরের দিন সেই শিয়াল বেড়া টপকে এক পাল ভেড়ার ভিতর থেকে একটা ভেড়াকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ভেড়ার পাহারায় থাকা শিকারী আর তার শিকারী কুকুরদের পাল্লায় পড়ে সে নিজেই তাদের শিকার বনে গেল।

প্রাচীন বচনঃ সফল হতে গেলে নিজের সীমার মধ্যে থাকতে হয়।

আমি বলিঃ উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া উচ্চাকাঙ্খা সফল করতে গেলে কাজ তো পন্ড হয়ই, অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে।

(৪০)
The Horse and the Stag

ঘোড়া আর শিঙেল হরিণ

এক সময় এক ঘোড়া একটা গোটা মাঠ জুড়ে একাই চড়ে বেড়াত। একদিন এক শিঙ্গেল হরিণ ঘোড়াটার এলাকায় ঢুকে পড়ল আর তার খাবারে ভাগ বসাল। ঘোড়াটা ভাবল যে এর প্রতিশোধ নিতে হবে। সে একটা মানুষকে গিয়ে ধরল – যদি সেই মানুষ হরিণটাকে শাস্তি দেওয়ার কাজে ঘোড়াটাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক হয়। লোকটা বলল যে ঘোড়াটা মুখে লাগাম লাগিয়ে তাকে পিঠে তুলে নিলে সে হরিণটার দিকে ঠিকঠাক অস্ত্র চালাতে পারবে। ঘোড়াটা রাজী হল। লোকটাকে তার মুখে লাগাম লাগিয়ে পিঠে জিন চড়াতে দিল। আর তারপরই সে বুঝতে পারল, কিসের প্রতিশোধ, কিসের কি! সে এখন থেকে মানুষের সেবাদাস হয়ে গেছে।

প্রাচীন বচনঃ অন্যের ক্ষতি করতে গেলে সাধারণতঃ নিজেরই ক্ষতি হয়ে যায়।

আমি বলিঃ কি পাড়ায়, কি বিশ্ব-বাজারে প্রতিবেশীদের চাপে রাখতে গিয়ে পরিণতি হয় মাতব্বরদের সেবাদাস হয়ে যাওয়া।

[এক আগ্রহী শ্রোতা এই গল্পগুলোর আকঙ্খায় থাকে। আর আমি তাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছি। ঠিক হয় নি। প্রিয় প্রোফেসর হিজবিজবিজ, এই পাঁচটি গল্প অবশ্যই আপনার শ্রীমান-এর জন্য]