ঈশপের গল্প – ১ থেকে ৫

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(১)
The Wolf Turned Shepherd

রাখাল সাজা নেকড়ে

ধরা খাওয়ার ভয়ে এক নেকড়ে কিছুতেই ভেড়ার পালের কাছ ঘেঁষতে পারে না। তখন জামা-কাপড় চাপিয়ে সে এক রাখাল সেজে নিল। এইবার সে সোজা চলে এল ভেড়াগুলোর পাশে। আসল রাখাল তখন ঘুম লাগাচ্ছে আর ভেড়াগুলো নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। মুস্কিলটা হল ভেড়া পাকড়াতে গেলে অন্ততঃ কোন একটাকে দলছুট করা দরকার! নেকড়ে-রাখাল তাই আসল রাখাল-এর মত হুস-হাস আওয়াজ করে ভেড়াগুলোকে এদিক ওদিক ভাগানোর তাল করল। তাতে লাভ হল এই – গলা দিয়ে নেকড়ের হাউ-হাউ বেরিয়ে এল। ব্যাস, রাখাল গেল জেগে। পিটুনির চোটে নেকড়ে শেষ।

নীতিশিক্ষাঃ ছদ্মবেশ ধরে কাজ করতে গেলে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবেই (আর সব পণ্ড হবে)

আমি আরো বলিঃ মুখ খুলতে দিলেই ধরা পরবে কার ছাল গায়ে কে এসেছে।

(২)
The Stag at the Pool

জলের ধারের শিঙেল হরিণ

মাঠের ধারে দিঘীর জলে নিজের ছায়ায় বাহারী শিং-এর রূপ দেখে দেখে এক শিঙেল হরিণ একেবারে মুগ্ধ। কিন্তু মেজাজ খিঁচড়ে দিল তার কুচ্ছিৎ দেখতে কাঠি কাঠি পা-গুলো। এমন সময় এক সিংহ এসে হাজির সেই জলের ধারে। হরিণ তখন একটু আগে দুচ্ছাই করা ঐ পাগুলোরই ভরসায় দে দৌড়, দে দৌড়। বেঁচে গিয়েওছিল প্রায়। মারা পড়ল জঙ্গলে ঢুকে গাছপালায় শিং জড়িয়ে গিয়ে। সিংহের হাতে মরতে মরতে হরিণ আফশোষ করল – “কী হতভাগা আমি! বুদ্ধুর বুদ্ধু! যে পাগুলো আমায় বাঁচাতে পারত সেগুলোকেই গাল পাড়ছিলাম, আর যে শিংগুলো নিয়ে এত গর্ব করছিলাম সেগুলোর জন্যই শেষে মারা পড়লাম।”

নীতিশিক্ষাঃ আসলেই যা দামী, প্রায়ই তার ঠিকমত কদর হয় না।

আমি আরো বলিঃ অহংকারীরা তাদের দুর্বলতার হদিশ পায় না বলেই তাদের পেড়ে ফেলা যায়।

(৩)
The Fox and the Mask

শেয়াল ও মুখোশ

এক শেয়াল একবার এক নাটুয়ার বাড়ি ঢুকে পড়ল। মাল-পত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে পেয়ে গেল একটা মুখোশ। মানুষের মুখের এক চমৎকার নকল। শেয়ালটা থাবা দিয়ে ঐ মুখোশ নাড়াচাড়া করতে করতে বলে উঠল – “কি সুন্দর মাথা একটা। কিন্তু কোন দাম নেই এর কারণ এটার ভিতরে এক ছটাকও মগজ নেই। ”

নীতিশিক্ষাঃ বুদ্ধি ছাড়া সুন্দর মুখের দাম সামান্যই।

আমি আরো বলিঃ শিল্পের দাম বুঝলে শেয়াল তো মানুষ-ই হয়ে যেত!

(৪)
The Bear and the Fox

ভালুক আর শেয়াল

এক ভালুক-এর খুব ইচ্ছা সবাইকে জানায় কি বিরাট পরোপকারী আর দয়ালু স্বভাব তার। এই নিয়ে বক্তালি করতে গিয়ে সে জানাল যে সমস্ত পশুপাখীর মধ্যে সে-ই মানুষকে সবার চেয়ে বেশী সম্মান দ্যায় কারণ সে কখন-ও কোন মরা মানুষ নিয়ে টানাটানি করে না।

এক শেয়াল সে সব শুনে মুচকি হেসে ভালুকটাকে বলে, “হুঁঃ! সবসময় জ্যান্ত মানুষ খাওয়ার বদলে তুমি যদি মরা মানুষ খেতে সেটাই বরং তাদের পক্ষে ভাল হত।”

নীতিশিক্ষাঃ না মরলে দ্যায় না, অমন সম্মান দেওয়ার কোন মানে হয় না।

আমি আরো বলিঃ শিয়ালের উস্কানিতে মরা সেজেও আর ভালুকের হাত থেকে বাঁচা যাবে না!

(৫)
The Wolf and the Lamb

নেকড়ে ও ভেড়ার গল্প

ঘুরতে ঘুরতে এক নেকড়ে একটা দলছুট ভেড়াকে একলা পেয়ে গেল। নেকড়ের ইচ্ছে হল বেশ মহত্ব দেখায়। ভেড়াটার উপর কোন হামলা না চালিয়ে বরং কিছু যুক্তি-তক্ক দিয়ে সেটাকে বুঝিয়ে দেওয়া যাক যে ভেড়াটাকে খাওয়ার ব্যাপারটা নেকড়ের হক-এর মধ্যেই পড়ে। সে ভেড়াটাকে বলল
“এই যে মশায়, গেল সনে আপনি আমাকে বিস্তর অপমান করেছিলেন।”
ভেড়াটা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল “কিন্তু, আমার তো গত বছর জন্মই হয়নি!”
নেকড়েটা তখন বলে, “হতে পারে। কিন্তু, আমার মাঠের ঘাস খাও তুমি”
“না হুজুর,” ভেড়া উত্তর দ্যায়, “ঘাস খেতে কেমন তাই আমি জানি না এখনো।”
নেকড়ে ছাড়ে না, “তুই আমার কুয়ো থেকে জল খাস। ”
“না, না,” আর্তনাদ করে ওঠে ভেড়াটা, “আমি এখনো এক ফোঁটা জল ও মুখে দিইনি। আমি ত এখনো শুধু মা’র দুধ খাই! ”
“হুম! আমার সব অভিযোগ-এর তুই ভালই জবাব দিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু, তা বললে তো আর আমার পেট চলবে না।” এই বলতে বলতেই ভেড়াটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শয়তান নেকড়ে তাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল।

নীতিশিক্ষাঃ অত্যাচারী সবসময়ই অত্যাচার করার জন্য কিছু না কিছু কারণ খুঁজে বার করে ফেলে।

আমি আরো বলিঃ যারা কোন কথা শুনবে না ঠিক করেই রেখেছে, তাদের সাথে যুক্তি-তর্কে গিয়ে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই।

[প্রকাশিত – সচলায়তন, অগাস্ট ২৫, ২০১৩]