ঈশপের গল্প – ৬৬ থেকে ৭০
[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]
(৬৬)
The Wolf and the House-dog
নেকড়ে আর পোষা কুকুর
এক নেকড়ের সাথে একদিন এক কুকুরের দেখা হল। কুকুরের চেহারা বেশ ভাল। দেখলেই বোঝা যায় প্রচুর খাওয়া জোটে তার। কুকুরের গলায় পড়ান রয়েছে একটা শেকল, কাঠের তৈরী। নেকড়ে কৌতুহলী হয়ে কুকুরের কাছে জানতে চাইল যে কে সেই লোক যে তার খাবারের কোন অভাব রাখেনি কিন্তু গলায় পরিয়ে দিয়েছে সবসময় বয়ে বেড়ানোর এই ভারী জিনিষ! “আমার মালিক,” জবাব দিল সেই কুকুর। সেই শুনে নেকড়ে তাকে বলল, “আমার কোন বন্ধুকে যেন কোনদিন এমন দুর্দশায় পড়তে না হয়। এই শেকলের ভার সব ক্ষিধে বরবাদ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”
প্রাচীন বচনঃ স্বাধীনতার বিনিময়ে কোন কিছু পাওয়ার-ই কোন দাম নেই।
আমি বলিঃ কি আর্থিক, কি পরমার্থিক কোন অনুগ্রহই স্বাধীনতার সাথে আপোষ না ঘটিয়ে ছাড়ে না।
(৬৭)
The Eagle and the Kite
ঈগল আর চিলের গল্প
(সবাই তো জান, ঈগল হছে পাখীদের রাজা।) একদিন গাছের ডালে বসে ছিল এক মেয়ে ঈগল। মনে বড় দুঃখ তার। তার পাশেই বসে ছিল এক ছেলে চিল। “কি হয়েছে,” জিজ্ঞেস করল সেই চিল, “এমন দুঃখী দুঃখী মুখ কেন?” “কত খুঁজলাম,” বলল ঈগল, “আমার উপযুক্ত একজন সঙ্গী, যার সাথে ঘর বাঁধতে পারি। কিন্তু কাউকে মনে ধরল না।” “আমায় নাও,” বলল চিল, “জানো আমার গায়ে কত জোর? তোমার থেকে অনেক বেশী।” “কি লাভ তাতে, তোমার এই জোর আমার কোন উপকারে আসবে কি? পারবে কি তুমি আমার রোজকার খাবারের বন্দোবস্ত করতে?” “হুম্, তুমি জান কত সময় আমার এই ধারালো নখে বড় বড় উটপাখী তুলে নিয়ে চলে এসেছি!” ঈগল এই কথায় মুগ্ধ হয়ে গিয়ে সেই চিল-কে তার সঙ্গী করে নিল। বিয়ে হয়ে গেল তাদের। ঈগল তখন বলল তার বরকে, “কই গো ,এবার তবে উড়ে যাও আর আমার জন্য সেই উটপাখী ধরে নিয়ে এস।” চিল তখন সোঁ সোঁ করে উঠে গেল উঁচু আকাশে। তারপর ঝাঁপ দিল নীচে, আর শিকার ধরে নিয়ে এল একটা যদ্দুর সম্ভব হাড় জিরজিরে ইঁদুর। “সে কি,” বলল ঈগল, “এত বড় বড় কথা দিয়ে এই তোমার কথা রাখার নমুনা?” চিল উত্তর দিল, “তোমার মত একজন রাজকুমারীকে বিয়ে করার জন্য আমি যে কোন প্রতিশ্রুতি দিতে রাজী আছি, সে প্রতিশ্রুতি আমি রাখতে পারি আর না পারি। এমন কি যদি নিশ্চিত জানি রাখতে পারবনা, তাতেও কিছু যায় আসে না।”
প্রাচীন বচনঃ বিয়ে করতে চাওয়া লোকের প্রতিশ্রুতি অনেক বুঝে শুনে নিতে লাগে।
আমি বলিঃ বিয়ে আর ভোটের আগের প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি মেটে কম-ই।
(৬৮)
The Dogs and the Hides
একদল কুকুর আর গরুর চামড়া
একদল কুকুর, ক্ষিধের চোটে তাদের মর মর অবস্থা, দেখতে পেল মাঝ-নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে একটা মরা জন্তু। কোনভাবেই সেটার কাছে পৌঁছতে না পেরে তারা ঠিক করল যে নদীর সব জল খেয়ে ফেলা দরকার। তা হলেই নদী শুকিয়ে যাবে আর তারা জন্তুটা পেয়ে যাবে। কিন্তু সেই করতে গিয়ে জন্তুটার ধারে কাছে যেতে পারার অনেক আগেই অঢেল জল খেয়ে পেট ফেটে মরে গেল তারা।
প্রাচীন বচনঃ যা অসম্ভব সেই চেষ্টা করা অর্থহীন।
আমি বলিঃ ক্ষমতা লাভের লোভে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে যে কোন উপায়ে গদি করায়ত্ত করার চেষ্টা আর সর্বনাশের পথে এগিয়ে যাওয়া একই কথা।
(৬৯)
The Fisherman and Little Fish
এক জেলে আর একটা ছোট মাছ
এক ছিল জেলে। যে সব মাছ তার জালে ধরা পড়ত সেগুলো বেচেই জীবন চলত তার। একদিন সারা দিন চেষ্টা করে জালে উঠল একটামাত্র মাছ, তাও ছোট একটা। মাছটা খাবি খেতে খেতে প্রাণ বাঁচানোর জেলের কাছে মিনতি করল, “জনাব, আমাকে দিয়ে আপনার কোন কাজ হবে, কি দাম পাবেন আপনি আমায় বেচে! আমি তো এখনো পুরো বড় হই নি। দোহাই আপনার, প্রাণ বাঁচান আমার, আজকে আমাকে সাগরে ফিরিয়ে দিন। খুব তাড়াতাড়ি-ই আমি অনেক বড় হয়ে যাব। বড়লোকদের পাতে দেওয়ার মত হয়ে যাব আমি। তখন আপনি আমায় আবার ধরে ভাল রকম লাভ তুলে নিতে পারবেন।” জেলে উত্তর দিল, “কবে কি পাব তার জন্য যদি আমি এখন যা পেয়েছি তা ছেড়ে দিই, মানতেই হবে আমি একটা আস্ত বুদ্ধু।”
প্রাচীন বচনঃ দূর ভবিষ্যতের প্রচুর পাওয়ার কোন প্রতিশ্রুতির থেকে এখনকার একটা নিশ্চিত পাওনা, যত ছোটই হোক সেটা, বেশী দামী।
আমি বলিঃ ফাটকা খেলে বড়লোক হওয়ার সোনালী প্রতিশ্রুতির পাল্লায় পড়ার থেকে অল্প হলেও নিশ্চিত আয়ের উপর নির্ভর করা অনেক স্বস্তির।
(৭০)
The Ass and his Purchaser
গাধা আর তার খদ্দের
একজন লোক হাটে গেছে গাধা কিনতে। গাধার ব্যাপারী তাকে প্রস্তাব দিল কেনার আগে গাধাটাকে পরখ করে নিতে। সে লোক ত মহা খুশী। যে গাধাটা সে কিনবে বলে ভেবেছে, সেটাকে সে বাড়ি নিয়ে এল। খড় বিছানো আস্তাবলে ঢুকিয়ে ছেড়ে দিল তাকে। খানিক্ষণ বাদে লোকটা দেখে সেই গাধাটা অন্য সব গাধাকে ছেড়ে এমন একটা গাধার পাশে গিয়ে জুটেছে যেটা ছিল সবচেয়ে কুঁড়ে আর হদ্দ পেটুক। গাধার খরিদ্দার এবার গাধাটার মুখে লাগাম পড়িয়ে তাকে ফেরৎ নিয়ে গেল সেই ব্যাপারীর কাছে আর বলল, “আমার আর পরীক্ষার দরকার নেই। আমি বুঝে গেছি কেমন গাধা এ। যেমন সঙ্গী সে বেছেছিল, ও নিজেও ঠিক তাই হয়ে দাঁড়াবে।”
প্রাচীন বচনঃ লোক চেনা যায় তার বন্ধু-বান্ধবদের দেখলে।
আমি বলিঃ বেইমানদের সাথে যারা ওঠাবসা করে তারা বিশ্বাসী বন্ধু হতে পারে না। যুদ্ধাপরাধীদের যারা বুকে টেনে নেয় দেয় তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হতে পারে না।
[৬৮ আর ৭০ নং গল্পে ইংরেজী সূত্র থেকে একটু সরেছি। নীচে মন্তব্যের অংশে ষষ্ঠ পান্ডবের মন্তব্য ও তাতে আমার প্রতিমন্তব্য দ্রষ্টব্য]
ষষ্ঠ পাণ্ডবের মন্তব্য
কয়েকটা অবজারভেশনঃ
৬৭। চিল কি ঈগলের চেয়ে আকারে বড় বা শক্তিশালী? মোটেই না। তাহলে মেয়ে ঈগলটা কি চোখে দেখতে পেতো না, নাকি হাঁদা – যে নিজের সম্পর্কে জানে না!
৬৮। গরু কেন কোন পশুর চামড়াই নদীতে ভাসবে না।
৭০। গাধাটা আস্তাবলে ঢুকতে না ঢুকতে কী করে বুঝে গেলো কে সবচে’ বেশি কুঁড়ে আর পেটুক? বেশ এলেমদার গাধা বলতে হয়!
এসবের কোনটার দায় আপনার নয়। সকল দায় ঈশপ বাবাজীর।
আমার মন্তব্য
“এসবের কোনটার দায় আপনার নয়। সকল দায় ঈশপ বাবাজীর।” – হাঃ হাঃ হাঃ।
৬৭। হাঁদা ত বটেই!। তবে, বার-ফট্টাই করা চিলের পাল্লায় পড়ে তাদের বিশ্বাস করে ঠকে ফতুর হওয়া তাদের থেকে অনেক শক্তিশালী মেয়ে ঈগলদের সংখ্যা কি আর কম! তারপরে এ মেয়ে আবার সঙ্গী খুঁজে খুঁজে হয়রাণ হয়ে গিয়েছিল।
৬৮। হয়ত ঈশপ বলেছিলেন নদীতে ভেসে যাওয়া জন্তুর গোটা দেহটার-ই কথা। কিন্তু ইংরেজী অনুবাদে সেটা পশুর চামড়া হয়ে গেছে। এবার আমার বাংলা অনুবাদেও ঐ ভুল-ই চলেছে। দেখি, এটা ঠিক করে দিতে পারি কি না।
৭০। এইটা মনে হয় সময়ের সাথে অনেক সময় গল্প যে সরে সরে যায় সেই ঝামেলায় পড়েছে। গাধাটা ঐ ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সবচে’ বেশি কুঁড়ে আর পেটুক চিনতে পারার বদলে সেই কাজটাই খানিকটা সময় নিয়ে করে থাকলে যুক্তির এই ফাঁকটা সৃষ্টি হয় না। হয়ত মূল গল্পে তাই ছিল। কে জানে! দেখি এটাও একটু পাল্টানো যায় কি না! আমি ত ভাবানুবাদ-ই করছি।
Recent Posts
Categories
- Blog
- Book Chapter
- featured
- অঞ্জলি
- অনুবাদ
- অনূদিত কবিতা
- অনূদিত গল্প
- আলাস্কা গ্লেসিয়ার বে
- ঈশপের গল্প
- কবিতা
- কিছুমিছু
- ক্যালিডোস্কোপ
- ক্রুজ
- গল্পপাঠ
- গুরুচন্ডালি
- ছোট গল্প
- টুকিটাকি
- দুকূল
- নীতিকথার অনুবাদ
- পাঠ প্রতিক্রিয়া
- ফটোগ্রাফি
- বইয়ের হাট
- বাছাই
- বেড়ানোর গল্প
- মৌলিক কবিতা
- রুট ৬৬ গ্রুপ পোস্ট
- রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০
- সচলায়তন
- স্মৃতিকথা