ঈশপের গল্প – ৭৬ থেকে ৮০

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(৭৬)
The Fox and the Leopard

শেয়াল আর চিতাবাঘ

এক শেয়াল আর এক চিতাবাঘের মধ্যে তর্ক চলছিল কে বেশী সুন্দর তাই নিয়ে। চিতাবাঘ তার গায়ের একটার পর একটা বাহারী ছবির মত দাগ দেখিয়ে প্রমাণ করতে রইল তাকে দেখতে কত সুন্দর। শেয়াল তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “রাখ তোর গায়ের দাগ, আসল সৌন্দর্য চেহারার নয় মগজের, যেটা আমার আছে, তোর নেই।”

প্রাচীন বচনঃ কে কি পরে আছে তাই দেখে তাকে বিচার করতে নেই।

আমি বলিঃ ধূর্তামিকে মগজের সৌন্দর্য বলে চালানো বিশেষজ্ঞরা যে কোন উপায়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে ছাড়বেই।

(৭৭)
The Mountain in Labour

পাহাড়ের বাচ্চা হবে

একদিন একটা পাহাড় খুব কাঁপছিল। অনেক আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। সব দিক থেকে লোকেরা এসে জড় হল পাহাড়ের নীচে। সবাই চিন্তিত, উদ্বিগ্ন, ঘটনাটা কি? পাহাড়ের ছানা-পোনা হবে নাকি? তবে ত ভয়ংকর কিছু জন্মাবে! কি হবে এখন? একটু পরে সবাই দেখে কিছুই হল না, শুধু পাহাড় থেকে একটা ইঁদুর দৌড়ে বেড়িয়ে এল।

প্রাচীন বচনঃ ফালতু ব্যাপার নিয়ে মাতামাতি করার কোন মানে হয় না।

আমি বলিঃ ফালতু ব্যাপার নিয়ে মাতামাতি করার নাম টক-শো। সেখানে বিশেষজ্ঞরা পাহাড় কাঁপিয়ে ইঁদুর ছাড়েন।

(৭৮)
The Bear and the Two Travelers

এক ভালুক আর দু’জন একসাথে বেড়ানো লোক

দু’জন লোক একসাথে বেড়াতে বের হয়েছিল। হঠাৎ তারা দেখে একটা ভালুক তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গীদের একজন চটপট একটা গাছে উঠে পড়ে ডাল-পালার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। অন্যজন দেখল ভালুকের হাত থেকে আজ আর তার রক্ষা নেই। সে সটান মাটিতে শুয়ে পড়ল। ভালুক এসে তার গায়ে বারে বারে নাক ঠেকিয়ে, সারা শরীর শুঁকে শুঁকে দেখল। লোকটা এই গোটা সময়টা নিশ্বাস বন্ধ করে যতটা পারে মড়ার মত হয়ে পড়ে রইল। ভালুকটা একটু পরে তাকে ফেলে রেখে চলে গেল। এমন হতে পারে যে, ভালুক মরা কোন কিছু খেতে চায় না। একসময়, ভালুকটা চলে গেছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর, গাছে চড়া লোকটা গাছ থেকে নেমে এল। মাটিতে শুয়ে থাকা বন্ধুর কাছে গিয়ে ঠাট্টার সুরে সে জিজ্ঞেস করল যে ভালুকটা তার কানে কানে কি বলে গেল। তার বন্ধু উত্তর দিল, “ভালুক আমায় একটা উপদেশ দিয়ে গেল। সে বলে গেলঃ যেই সঙ্গী তোমায় বিপদের মুখে ফেলে সরে পড়ে, তার সাথে কোথাও বেড়াতে যেও না।”

প্রাচীন বচনঃ বিপদে বোঝা যায় কে সত্যিকারের বন্ধু।

আমি বলিঃ যারা বিপদে পড়ার আগে বুঝতে পারে না কে বন্ধু আর কে বন্ধু নয়, তাদের পক্ষে বাঁচা কঠিন হয়ে যায়।

(৭৯)
The Sick Kite

অসুস্থ চিল

একটা চিলের খুব অসুখ করেছে, বাঁচে কি বাঁচে না অবস্থা। চিল তার মা’কে ডেকে বলল, “মা গো! কেঁদো না, তুমি বরং ঠাকুর দেবতাদের ডেকে বলো আমার অসুখ সারিয়ে দিতে।” তার মা উত্তর দিলো, “হায় রে! এমন স্বভাব তোর! যখন যেই দেবস্থানে খাবার উৎসর্গ করা হত, তুই ছোঁ মেরে নেমে এসে কিছু না কিছু তুলে নিয়ে যেতিস। এমন কোন ঠাকুর-দেবতা নেই যার সাথে তুই এই কাজ করিস নি, যাকে তুই রাগাস নি। এখন কোন দেব-দেবী তোকে দয়া করবে বল?”

প্রাচীন বচনঃ সম্পদের সময়ে বন্ধুত্ব করা থাকলে তবেই বিপদের সময় সেই বন্ধুদের সাহায্য চাওয়া যায়।

আমি বলিঃ ক্ষমতাবানদের পিছনে লাগলে তারা আর দরকারের সময় অনুগ্রহ করবেন না। তাই, যদিও মিডিয়ার কাজ ছোঁ মেরে সব রকম খবর সংগ্রহ করা, তারা আজকাল হিসেব করে খবর যোগাড় করেন।

(৮০)
The Wolf and the Crane

নেকড়ে আর সারসের গল্প

একবার এক নেকড়ের গলায় এক টুকরো হাড় আটকে গিয়েছিল। নেকড়ে তখন এক সারসকে ডেকে আনল। নেকড়ের মুখের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে লম্বা ঠোঁট দিয়ে গলা থেকে হাড় বার করে নিয়ে আসতে হবে। নেকড়ে সারসকে বলল যে কাজটা ঠিক মত করতে পারলে তাকে সে অনেক পুরস্কার দেবে। সারস হাড়টা বের করে এনে তার পুরস্কার চাইল। নেকড়ে তখন শয়তানী হাসি হেসে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “ভাল করে ভেবে দ্যাখ কি বলছিস। নেকড়ের মুখ-এর ভিতর থেকে, তার কামড় না খেয়ে, নিশ্চিন্তে মুন্ডু বার করে আনতে পেরেছিস। তুই ত বিরাট পুরস্কার এর মধ্যেই পেয়ে গেছিস!”

প্রাচীন বচনঃ শয়তানের সেবা করলে পুরস্কারের আশা কোরো না। যদি কোন ক্ষতি না সয়ে বেঁচে যেতে পার, সেটাই সৌভাগ্য মেনো।