ঈশপের গল্প – ৯১ থেকে ৯৫
[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]
(৯১)
The Fowler and the Ringdove
পাখি শিকারী ও রাজঘুঘু
এক পাখী শিকারী একদিন বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে, পাখী মারবে। নজরে এল ওকগাছের আগায় বসে থাকা একটা রাজঘুঘু, গলায় সুন্দর আংটির মত চিত্র করা তার। সেটাকেই সে শিকার করবে বলে ঠিক করল। প্রথমে বন্দুকটাকে কাঁধে আটকে নিল যুত করে, তারপর পাখীটার দিকে নিশানা করল। কিন্তু নিশানা করবার সময় কখন যে ঘাসের নীচে শুয়ে থাকা একটা কেউটে সাপকে সে মাড়িয়ে ফেলেছে সেটা সে বুঝতে পারে নি। ঠিক বন্দুকের ঘোড়াটা টানবার মুহূর্তে কেউটেটা তার পায়ে ভীষণ জোরে ছোবল মারল। ব্যাথার চোটে শিকার করা ভুলে বন্দুক মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল শিকারি। তীব্র বিষ দ্রূত মিশে যাচ্ছে তার রক্তে। গোটা শরীরটা অবশ হয়ে পড়ছে। সে বুঝল, মরণ ঘনিয়ে এসেছে তার, কিন্তু করতে পারল না কিছুই। “আমার ভাগ্য”, বিড়বিড় করল সে, “আমাকেই শেষ করে দিল যখন আমি কিনা অন্য কাউকে শেষ করার যোগাড় করছিলাম। “
প্রাচীন বচনঃ যারা অন্যের জন্য ফাঁদ বানায়, অনেক সময় তারা নিজেরাই তাতে আটকা পড়ে।
আমি বলিঃ লক্ষ্যে স্থির থাকার অর্থ এই নয় যে চারপাশের বিপদ থেকে নজর সরিয়ে রাখতে হবে।
(৯২)
The Kid and the Wolf
রাখাল ছেলে ও নেকড়ের গল্প
এক রাখাল ছেলে একদিন বনের পথ ধরে ঘরে ফিরছিল, একা একা, সাথে অস্ত্র-শস্ত্রও কিছু নেই। এক নেকড়ে তার পিছু নিল। রাখাল ছেলে একসময় বুঝে গেল আর রক্ষা নেই। সে বেচারী তখন ঘুরে নেকড়ের মুখোমুখি হয়ে বলল, “নেকড়ে দোস্ত, আমি বুঝতে পারছি, আজ আমায় তোমার শিকার হতেই হবে। কিন্তু মরবার আগে আমার একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে। তুমি যদি একটু বাঁশী বাজিয়ে শোনাও, আমি তা’হলে তোমার সুরের সাথে সাথে শেষবারের মত একটু নেচে নিই।” নেকড়ে মেনে নিল। তার বাঁশীর সুরের তালে তালে নাচতে থাকল রাখাল ছেলে। এদিকে, একদল শিকারী কুকুরের কানে গেল সেই সুর। তারা ছুটে এসে নেকড়েকে দেখতে পেয়েই তাড়া করল তাকে। নেকড়ে তখন পালাতে পালাতে রাখাল ছেলের দিকে ফিরে বলল, “যেমন কর্ম করেছি, হাতে হাতে তার ফল পেলাম। আমার দরকার ছিল ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমায় খেয়ে ফেলা, তার বদলে তোমায় খুশী করার জন্য বাঁশী বাজাতে বসে গেলাম। একেবারেই ঠিক হয়নি সে কাজটা।”
প্রাচীন বচনঃ যার যেটা কাজ তার সেটাই করা উচিত।
আমি বলিঃ শয়তানের সাথে সোজা পথে চলে নয়, বাঁকা পথে তাকে ফাঁদে ফেলেই তার হাত থেকে বাঁচতে লাগে।
(৯৩)
The Blind Man and the Whelp
এক অন্ধ ও এক নেকড়ের ছানা
এক অন্ধ মানুষের একটা বিশেষ গুণ ছিল। জন্তু-জানোয়ারের গায়ে হাত বুলিয়ে সে বলে দিত পারত কোন প্রাণী সেটা। একদিন একজন একটা নেকড়ের ছানা এনে তার হাতে দিল। অনুরোধ করল যদি সে প্রাণীটার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে দিতে পারে ঠিক কোন জানোয়ার বাচ্চা সেটা। লোকটি প্রাণীটির গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে পরীক্ষা করল। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে না পেরে বলল সে, “বুঝতে পারছি না ঠিক কোন জন্তুর বাচ্চা এটা – শিয়ালের না নেকড়ের। কিন্তু এই ব্যাপারটায় আমার কোন সন্দেহ নেই যে, এটাকে ভেড়ার পালের মধ্যে ছেড়ে দিলে ভেড়াগুলোর বিপদ হয়ে যাবে। “
প্রাচীন বচনঃ শয়তানীর লক্ষণ ছোট থাকতেই নজরে পড়ে।
আমি বলিঃ এখনো পুরো মুর্ত্তি ধরেনি তাই চিন্তার কিছু নেই, এই ভাবনায় বুঁদ হয়ে নেতৃত্ব যখন শয়তানকে তুচ্ছ বলে হিসাব করে , নেতৃত্বের উপর নির্ভর করা মানুষগুলির জন্য তখন সর্বনাশ ঘনিয়ে আসে।
(৯৪)
The Geese and the Cranes
হাঁস ও সারসের গল্প
এক মাঠে চরে বেড়াত কিছু রাজহাঁস আর সারস। তাদের ধরবে বলে একদিন এক পাখীশিকারী জাল নিয়ে ঐ মাঠে এসে হাজির। সারসদের হাল্কা ডানা। শিকারীকে আসতে দেখেই তারা চটপট উড়ে চলে গেল। রাজহাঁসেরা অত তাড়াতাড়ি উড়তে পারে না। আর, তাদের শরীর ও অনেক ভারী। ফলে, সমস্ত রাজহাঁসেরা জালে ধরা পড়ল, বন্দী হল তারা।
প্রাচীন বচনঃ অনেক সময়ই সবচেয়ে বেশী অপরাধীরাই যে ধরা পড়েছে, ঘটনা তা নয়।
আমি বলিঃ আরামে আয়েসে থেকে থেকে রাজনীতিকরা যখন দ্রুত মাঠ-ঘাটের আন্দোলন গড়ে তুলতে ভুলে যান, আমলা-নির্ভরতার ফাঁদে ধরা পড়া থেকে নিজেদের বাঁচানো তখন তাদের পক্ষে একন্তই কঠিন হয়ে যায়।
(৯৫)
The North Wind and the Sun
উত্তুরে বাতাস আর সূর্যের গল্প
উত্তুরে বাতাস আর সূর্যের মধ্যে প্রবল তর্ক বেধে গেল – কার জোর বেশী তাই নিয়ে। সেই সময় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এক লোক। বাতাস আর সূর্য একমত হল যে, তাদের মধ্যে যে জন ঐ লোকের গা থেকে অন্যজনের আগে জামা-কাপড় খুলে ফেলাতে পারবে, তাকেই বেশী শক্তিমান বলে ধরা হবে। উত্তুরে বাতাস তার সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু বাতাসের পরাক্রম যত বেড়ে উঠল, লোকটি তার পোষাকগুলোকে তত বেশী করে আঁকড়ে ধরল। একসময় বাতাস হাল ছেড়ে দিয়ে সূর্যকে ডাকল তার ক্ষমতার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। সুর্য চড়চড় করে হঠাৎ একেবারে তীব্র গরম হয়ে উঠল। লোকটা সেই গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে একটার পর একটা তার সমস্ত জামা-কাপড় খুলে ফেলতে থাকল। শেষে একসময় রোদের তাপে অস্থির হয়ে গায়ের সমস্ত পোষাক খুলে ফেলে সে পথের ধারের এক জলাশয়ে স্নানে নেমে পড়ল।
প্রাচীন বচনঃ বুঝিয়ে বলায় জোর করার থেকে বেশী কাজ পাওয়া যায়।
আমি বলিঃ হৃদয়ের উষ্ণতা খসিয়ে দেয় অবিশ্বাসের আবরণ। আর, এ ধারা ও ধারার দমন পীড়নে নেতৃত্বের শক্তি প্রদর্শন হয় বটে হুদো হুদো, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়না। মানুষ বরং তাতে আরো দূরে সরে যায়।
Recent Posts
Categories
- Blog
- Book Chapter
- featured
- অঞ্জলি
- অনুবাদ
- অনূদিত কবিতা
- অনূদিত গল্প
- আলাস্কা গ্লেসিয়ার বে
- ঈশপের গল্প
- কবিতা
- কিছুমিছু
- ক্যালিডোস্কোপ
- ক্রুজ
- গল্পপাঠ
- গুরুচন্ডালি
- ছোট গল্প
- টুকিটাকি
- দুকূল
- নীতিকথার অনুবাদ
- পাঠ প্রতিক্রিয়া
- ফটোগ্রাফি
- বইয়ের হাট
- বাছাই
- বেড়ানোর গল্প
- মৌলিক কবিতা
- রুট ৬৬ গ্রুপ পোস্ট
- রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০
- সচলায়তন
- স্মৃতিকথা