ঈশপের গল্প – ১০১ থেকে ১০৫

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(১০১)
The Stag and the Fawn

ধেড়ে হরিণ আর হরিণ ছানা

এক বুড়ো ধেড়ে হরিণ বয়সের সাথে সাথে নানা রকম কায়দা-কসরৎ শিখে নিয়েছিল। এমনভাবে সে পা দাপাত, মাথা ঝাঁকাত, ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলত যে হরিণদের পুরো পাল তার ভয়ে কাঁপত। একদিন হল কি, একটা ছোট্ট হরিণছানা সাহস করে তার কাছে এগিয়ে গেল। ধেড়ে হরিণটাকে সে জিজ্ঞেসে করল,
“দোহাই আপনার, আমার উপরে রেগে যেয়েন না। কিন্তু, একটা কথা বলুনতো, এত দাপট আপনার, অথচ, যেই কোন শিকারী কুকুরের ডাক শুনলেন, মনে হয় পারলে নিজের চামড়াটাও পিছনে ফেলে আপনি একেবারে মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে যাবেন! কেন?”
“ঠিকই নজর করেছিস তুই,” ধেড়ে হরিণটা তখন বলল তাকে, “জানিনা কেন এমন হয়। দুনিয়ার যে কোন কিছুর সাথেই আমি লড়ে যেতে পারি, কোন কিছুরই আমি তোয়াক্কা করি না। কিন্তু, কি যে হয়, শিকারী কুকুরের ডাক শুনলেই আমার ভিতরের সমস্ত জোর উবে যায়! যত তাড়াতাড়ি পারি, দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তখন আমার আর কোন উপায়ই থাকে না।”

প্রাচীন বচনঃ যে যত বড় বড় কথা বলে, সে আসলে তত বড় কাপুরুষ।

আমি বলিঃ নিজের লোকেদেরই উপর অত্যাচার করা ঘাগু কাপুরুষগুলোর মুখোশ খোলার কাজটা বোধ হয় তরুণ-তরুণীরাই সবচেয়ে বেশী করে।

(১০২)
The Partridge and the Fowler

বাতাই পাখী ও পাখী শিকারী

একবার এক পাখী শিকারী একটা বাতাই পাখী ধরেছিল। পাখীটা প্রাণ বাঁচানোর জন্য কাকুতি মিনতি করে শিকারীকে বলল, “হুজুর, রেহাই দেন আমায়। আপনি যদি আমার প্রাণ বাঁচান, আমি নিজে আপনাকে অনেক বাতাই পাখী ধরে এনে দেব।” শিকারী তখন উত্তর দিল, “নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তুই তোর আত্মীয়-বন্ধুদের প্রাণ বলি দিতে চাইছিস, তোর প্রাণ নিতে আমার আর কোন দ্বিধা রইল না।” এর পরে আর একটুও দেরী না করে সে বাতাইটার ঘাড় মুচড়ে তার থলেতে ভরে ফেলল।

প্রাচীন বচনঃ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যারা বন্ধুদের সর্বনাশের মুখে ঠেলে দ্যায়, তারা কোন রকম ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়।

আমি বলিঃ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যারা একদিন নিজের দেশের অগণিত মানুষকে হত্যাকারীদের হাতে তুলে দিয়েছিল, তারা কি কোনরকম, আবারো বলি, কোনরকম ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য?

(১০৩)
The Farmer and the Stork

এক চাষী আর এক মানিকজোড় পাখী

( Stork বলতে যে পাখীগুলিকে বোঝায় তাদের বাংলা নাম মানিকজোড়।)।

সদ্য রোয়া বীজগুলো বাঁচানোর জন্য এক চাষী তার জমির উপর জাল বিছিয়ে রেখেছিল। বীজ খেতে আসা একগুচ্ছ সারস ধরা পড়ল সেই জালে। তাদের মাঝখানে সারসের মতই দেখতে অন্য একটা পাখীও আটকা পড়েছিল। তার নাম মানিকজোড়। জালে জড়িয়ে পা ভেঙ্গে যাওয়ায় মানিকজোড় পাখীটা পালাতে পারল না। সে তখন প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে ঐ চাষীর কাছে আবেদন নিবেদন করতে রইল। “হুজুর, আমায় রেহাই দিন,” বলল সে, “অন্ততঃ এইবারটির মত আমাকে ছেড়ে দিন। এই দেখুন, পা ভেঙ্গে গেছে আমার। এই পা দেখে আপনার মনে কি আর দয়া হচ্ছে না, নিশ্চয়ই হচ্ছে। তাছাড়া ভেবে দেখুন, আমি ত আর সারস নই, আমি একটা মানিকজোড়। কখনো কোন খারাপ কাজ করিনা আমি। সব সময় বাবা-মায়ের কথা শুনে চলি, কত ভালবাসি তাদের। দেখুন, দেখুন, আমার পালকগুলি দেখুন, সারসের পালকের সাথে কোন মিলই নেই।” চাষী হাসতে হাসতে বলল, “হতে পারে তোর সমস্ত কথাই ঠিক, তবে আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। আমি শুধু এইটুকু জানি, এই সারসগুলো সব কটা ডাকাত। আর, এদের সাথে ধরা পড়েছিস তুই। তোকে ও তাই এদের সাথে সাথেই মরতে হবে।”

প্রাচীন বচনঃ অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ

আমি বলিঃ ব্যক্তি হোক কি গোষ্ঠী, গণহত্যাকারীদের দলে থেকেও নিজে হাতে খুন না করার সাফাই গাইলে আর কোন আদর্শের দোহাই দিলেই হত্যায় অংশগ্রহণ করার দায় থেকে কারো মুক্তি জুটে যাওয়া উচিত কি?

(১০৪)
The Ass and his Driver

গাধা আর তার চালক

উঁচু পথ ধরে চলছিল এক গাধা। হঠাৎ সে নিজের ইচ্ছে মত ছুট লাগাল। ছিটকে গিয়ে পড়ল এক গভীর খাদের ধারে। হুড়মুড় করে যখন সে খাদের মধ্যে পড়তে চলেছে, তার চালক লোকটি তখন তার লেজ টেনে ধরে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করল। কিন্তু গাধাটার গোঁ চেপে গেছে, সে থামবে না। লোকটা এবার তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “যা ইচ্ছে করগে তুই। শুধু মনে রাখিস, এর ফলটাও তোকেই ভুগতে হবে। “

প্রাচীন বচনঃ গোঁয়ারের বিপদ কেউ আটকাতে পারে না।

আমি বলিঃ পরিণতির হিসাব না করে যে রাজনীতি কেবল নিজের গোঁ ধরে চলতে থাকে, হঠকারিতার খাদে গড়িয়ে যাওয়া থেকে তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না। সে রাজনীতির থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া ছাড়া তখন আর কোন উপায় থাকে না।

(১০৫)
The Hare and the Hound

এক খরগোশ আর এক শিকারী কুকুর

একদিন এক শিকারী কুকুর একটা খরগোশকে তার বাসা থেকে তাড়া করল। বহুক্ষন ছোটার পরও খরগোশটাকে ধরতে না পেরে কুকুরটা হাল ছেড়ে দিয়ে থেমে গেল। সেই সময় একটা লোক সেখানে ছাগল চরাচ্ছিল। সে কুকুরটার অবস্থা দেখে তাকে টিপ্পনী কাটল, “তোমাদের দু’জনের মধ্যে দেখছি কুচোটাই আসলে দৌড়ে বেশী ওস্তাদ।” কুকুরটা তখন তাকে উত্তর দিল, “আসল তফাৎটাই তুমি ধরতে পারনি। আমি শুধু খাবার জোগাড়-এর চেষ্টা করছিলাম। আর, খরগোশটা ছুটছিল প্রাণের দায়ে।”

প্রাচীন বচনঃ কি পাওয়া যাবে তার উপর নির্ভর করে চেষ্টাটা কেমন হবে।

আমি বলিঃ যে সব সমালোচনা শোনা যায় তার অনেকই করা হয় – স্রেফ নিন্দা করার জন্য, অথবা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়ে। কে কি অবস্থায় কি করেছে সে সব আর হিসাবে আনা হয় না।