ঈশপের গল্প – ১০৬ থেকে ১১০

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(১০৬)
The Kites and the Swans

চিল আর রাজহাঁস-এর গল্প

অনেক আগে চিলরা গান গাইতে পারত, রাজহাঁসরাও। কিন্তু ঘোড়ার চিঁ-হি-হি ডাক শুনে তারা এমন মুগ্ধ হয়ে গেল যে তারাও ঘোড়ার মত করে ডাকার জন্য প্রবলভাবে চেষ্টা শুরু করে দিল। আর, সেই চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেদের গান গাওয়ার ক্ষমতাটাই ফেলল হারিয়ে।

প্রাচীন বচনঃ অজানা ভবিষ্যতের কাল্পনিক সুবিধা জোটাতে গিয়ে লোকে আজকের দামী প্রাপ্তিটা খুইয়ে বসে।

আমি বলিঃ নিজেকে নানা গুণে গুণান্বিত প্রমাণ করতে গিয়ে পুরাই অপদার্থ বনে যাওয়া প্রাক্তন গুণীদের কোনদিনই কমতি পড়ে না। তবে, প্রচার মাধ্যমের দাক্ষিণ্য পেয়ে গেলে ঐ অপদার্থদের বিখ্যাত হওয়া কি বিখ্যাত থাকা অবশ্য আটকায় না।

(১০৭)
The Dog and the Manger

এক কুকুর আর জাবনার ডাব্বার গল্প

একটা কুকুর একদিন খড়ভর্তি এক জাবনার ডাব্বায় গিয়ে চড়ে বসল। যে ষাঁড়গুলোর ঐ ডাব্বা থেকে জাবনা খাওয়ার কথা তারা দাববার কাছাকাছি গেলেই কুকুরটা ভয়ানকভাবে দাঁত-মুখ খিঁচোতে রইল। ফলে ষাঁড়েরা খাবার খেতে পারল না। “কি স্বার্থপর কুকুর দেখো!” একটা ষাঁড় তখন বলল তার সঙ্গীদের, “হতচ্ছাড়াটা নিজে একটা খড়ও খেতে পারবে না, অথচ আমরা যারা এই খড় খেয়েই বেঁচে থাকি, আমাদেরও খেতে দিচ্ছে না। “

প্রাচীন বচনঃ নিজে উপভোগ করতে পারব না বলে অন্য কাউকে কোন ভাল জিনিস থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়।

আমি বলিঃ জাবনা আটকে রাখা কুকুরকে লাথি মেরে তাড়াতে না চাইলে না খেয়েই মরতে হবে কারণ, মারের ভয় না থাকলে বদমাইশ কুকুর জাবনার ডাব্বাতেই চড়ে বসে থাকবে।

(১০৮)
The Crow and the Serpent

এক কাক আর এক সাপের গল্প

একটা কাকের খুব খিদে পেয়েছিল। উড়তে উড়তে তার নজরে পড়ল, একটা দেয়ালের পাশে এক কোণায়, সূর্যের আলোয় একটা সাপ রোদ পোহাচ্ছে। কাকটা হুস করে নেমে এসে লোভীর মত ছোঁ মেরে সাপটাকে তুলে নিল। সাপটা ফুঁসে উঠে কাকটাকে লাগাল এক মরণ-ছোবল। মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে কাকটা তখন বলল, “কি দুর্ভাগা আমি! যা আমি আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে ভাবলাম, তা’ই আমার নিশ্চিত ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াল।”

প্রাচীন বচনঃ উপর উপর দেখে যেটাকে সৌভাগ্য বলে মনে হচ্ছে সেটা আসলে তা নাও হতে পারে।

আমি বলিঃ চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখলেই যারা ভাবে সাপটা মরে গেছে, আর ভয় নেই সেটাকে, তাদের বোকামি তাদের চরম সর্বনাশই ডেকে আনে।

(১০৯)
The Cat and the Fox

এক বিড়াল আর এক শিয়ালের গল্প

এক বিড়াল আর এক শিয়াল কে কত রাজনীতি বোঝে তাই নিয়ে একদিন গল্প করছিল। শিয়াল বলল, “যত বড় বিপদই আসুক, আমার মত লোকের পরোয়া করার কোন কারণ দেখি না। অজস্র কায়দা-কসরৎ জানি আমি। আমার কোন রকম ক্ষতি করবার আগে সেই সব কাটাতে পারতে হবে।” “আমি বরং, আশা করছি তেমন কিছু হবে না, তবু,” বলল সে, “বিড়াল-দিদি, ধরুন এক্ষুনি এখানে একটা আক্রমণের ঘটনা ঘটে গেল। আপনি তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য কোন কোন ব্যবস্থা নেবেন সে নিয়ে ভেবে রেখেছেন কিছু?” “নাঃ, শিয়াল-দাদা”, উত্তর দিল বিড়াল, “আমি ত কেবল একটাই উপায় জানি। সেইটা কাজ না করলে আমি গেছি, শেষ একেবারে।” “খারাপ লাগছে আপনার জন্য,” উত্তর দিল শিয়াল, “মন থেকে বলছি। আর, আপনার কোন কাজে লাগতে পারলে খুবই খুশীও হতাম আমি। কিন্তু কি জানেন, প্রতিবেশী আপনি, বোঝেনই ত, যা দিনকাল পড়েছে এখন, কাউকেই আর বিশ্বাস করা যায়না। সেই যে বলে না, নিজের ব্যবস্থা নিজেরই করে নিতে লাগে।” শিয়ালের কথাগুলো মুখ থেকে খসতে না খসতেই তাদের কানে এল এক পাল শিকারী কুকুরের আওয়াজ। ভীষণ চিৎকার করতে করতে কুকুরের দল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের উপর। বিড়াল, একটা কায়দাই ত জানত সে, দৌড়ে একটা গাছে উঠে পড়ল। অনেক উঁচুতে মগডালের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে দেখতে লাগল শিয়ালের অবস্থা। হরেক রকমের কায়দা কসরৎ করতে গিয়ে শিয়াল আর কিছুতেই কুকুরগুলোর নজরের বাইরে যেতে পারল না। কুকুরগুলো তাকে ঘিরে ধরে টুকরো টুকরো করে ফেলল।

প্রাচীন বচনঃ একটুখানি সাধারণ বুদ্ধি প্রায়ই গাদা-গুচ্ছ কৌশলের থেকে বেশী কাজে লাগে।
(প্রাচীন বচনটিই ভিন্ন বাচনভঙ্গীতেঃ পলাইতে জানে না ক্যার্দানি দ্যাখায়!)

আমি বলিঃ শিয়াল যদি বা ঘিরে ফেলে ধরা যায়, বিড়াল ধরতে গেলে গাছে চড়ার কি গাছ ঝাঁকানোর ক্ষমতা থাকা দরকার হয়। দুর্নীতির আশ্রয়দাতা গাছগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে দুর্নীতির বড় কারবারীদের ধরা যায় না।

(১১০)
The Eagle and the Arrow

এক ঈগল আর এক তীর

অনেক উঁচু একটা পাথরের উপর বসেছিল এক ঈগল। নীচে ঘুরে বেড়ানো একটা খরগোশের উপর নজর রাখছিল সে। ইচ্ছে তার, ওটকে শিকার করবে। এদিকে, ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে এক তীরন্দাজ শিকারী তাক করছিল ঈগলটাকে। একসময় সে নিখুঁত নিশানায় ছেড়ে দিল তার তীর আর ঈগলটাকে বিঁধে ফেলল চরমভাবে। বুকের মধ্যে গেঁথে যাওয়া তীরটার দিকে এক ঝলক তাকাল সেই মরতে বসা ঈগল। দেখল, ঠিকমত হাওয়া কেটে উড়ে যাওয়ার জন্য তীরের লেজে যে পালক লাগানো আছে, তা ঈগলের নিজেরই পালক। “দুঃখটা আমার এখন এই ভেবে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে যে,” অবাক হয়ে বলল সেই ঈগল, “আমায় আজ মরতে হল আমার নিজেরই ডানার পালক বসানো তীরে।”

প্রাচীন বচনঃ নিজের কাজের ফলে ঘটা দুর্দশা সহ্য করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।

আমি বলিঃ শক্তিশালী অত্যাচারীকে বাগে আনতে তার নিজের শক্তিকেই তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে জানতে লাগে।