ঈশপের গল্প – ২১ থেকে ২৫

[ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।]

(২১)
The Fox and the Lion

শিয়াল আর সিংহ-র গল্প

বনে ঘুরতে ঘুরতে এক শিয়াল হঠাৎ এক সিংহের মুখোমুখি এসে পড়ল। এর আগে সে কখনো সিংহ দেখেনি। ফলে সে ত ভয়েই মরে প্রায়! তার কিছুদিন বাদে আবার সেই সিংহের সাথে দেখা সেই শিয়ালের। এইবার-ও শিয়াল ভয়ে ভয়ে ছিল, তবে প্রথমবারের মত অতটা নয়। তিন নম্বর বার যখন দেখা হল, শিয়ালের আর ভয় ত করলইনা, সে বরং সিংহের কাছে এগিয়ে গিয়ে গল্প জুড়ে দিল।

প্রাচীন বচনঃ পরিচিতি বাড়লে পুরান সংস্কার কমে।

আমি বলিঃ চালাক শক্তিমান একেবারে শুরু থেকেই হামলা করার ইচ্ছে না দেখিয়ে আস্তে, আস্তে তার শিকার-এর সতর্কতা নষ্ট করে দ্যায়।

(২২)
The Town Mouse and the Country Mouse

শহরের ইঁদুর আর গাঁয়ের ইঁদুর

এক গাঁয়ের ইঁদুর তার জিগরী দোস্ত শহরের ইঁদুরকে বাড়িতে ডেকেছিল নিজের এলাকা ঘুরিয়ে দেখাবে বলে। যখন তারা ফাঁকা ক্ষেতে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আর ঝোপের ধারে ধারে ফসলের ডাঁটি চিবোচ্ছিল বা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে শেকড়গুলো খাচ্ছিল, শহরের ইঁদুর তার বন্ধুকে বলল “পিঁপড়ের মত খুঁটে খেয়ে খেয়ে তোর জীবন কাটে আর, আমার ওখানে জিনিসের ছড়াছড়ি। যত রকমের খাবার ভাবতে পারিস, সব আছে আমার কাছে। একবার যদি আসতে পারতিস, দেখাতাম তোকে, আয়, আয়, চলে আয়, সেরার সেরা খাবার ভাগাভাগি করে খাব আমরা।” গাঁয়ের ইঁদুর সহজেই রাজী হয়ে গেল, বন্ধুর সাথে শহরে বন্ধুর বাড়িতে চলে এল। শহরের ইঁদুর বন্ধুর সামনে এনে হাজির করল রুটি, বার্লি, বীন, শুকনো ডুমুর, মধু, কিসমিস, আর সবশেষে একটা ঝুড়ি থেকে, সেরার সেরা সুস্বাদু খাবার – এক টুকরো চীজ। এত রকমারী সব খাবার দেখে, গাঁয়ের ইঁদুর তো তাজ্জব! সমানে শহরের ইঁদুর-কে বাহবা জানাতে লাগল আর নিজের দুর্ভাগ্যকে দোষ দিতে থাকল। সবে তারা খাওয়া শুরু করতে যাচ্ছে, ঘরের দরজা খুলে একটা লোক ভিতরে ঢুকে এল, আর দুই ইঁদুর এক দৌড়ে এক সরু গর্তে একজন আরেকজনের ঘাড়ের উপর চেপে কোনমতে নিজেদের লুকিয়ে রাখল। একটু বাদে ঠিক যখন আবার তারা খাওয়া শুরু করবে, কেউ একজন ঘরে এসে পড়ল কাবার্ড থেকে কিছু বার করে নেবে বলে। ইঁদুর দুটো আরো ভয় পেয়ে পড়ি-মরি করে লুকিয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ বাদে, গাঁয়ের ইঁদুর, তখনো তার বুক ধড়ফড় করছে, বন্ধুকে বলল, “যদিও আমার জন্য সেরার সেরা খাবারের মেলা বসিয়ে দিয়েছ তুমি, আমি সব খাবার তোমার একলার খাওয়ার জন্যই রেখে যাচ্ছি। আনন্দ করার জন্য আমার পক্ষে এই জায়গা বড়ই বিপজ্জনক। ”

প্রাচীন বচনঃ বিপদ-আপদ-এ ঘেরা বিপুল ঐশ্বর্যের চেয়ে নিরাপদে একটু খুদ-কুঁড়ো খাওয়াও অনেক স্বস্তির। (সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।)

আমি বলিঃ মাথা উঁচু রেখে চলা যাদের অভ্যাস, লুকিয়ে-চুরিয়ে বাঁচা, যত কিছুই জুটুক, তাদের তাতে পোষায় না।

(২৩)
The Monkey and the Dolphin

বাঁদর আর শুশুক-এর গল্প

এক নাবিক দূর সমুদ্র যাত্রায় যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে বাঁদরের খেলা দেখে একঘেয়েমি কাটানোর জন্য একটা বাঁদরকে সাথে নিয়ে নিয়েছিল। গ্রীসের সমুদ্রতীরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভীষণ ঝড়ে পরে তাদের জাহাজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সেই নাবিক, তার বাঁদর আর জাহাজের সমস্ত লোকেরা যার যার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ডাঙ্গার দিকে সাঁতরে চলল। একটি শুশুক, যে সব সময় মানুষকে সাহায্য করতে ভালবাসে, এদের বাঁচাতে এগিয়ে এল। বাঁদরটাকে মানুষ ভেবে সেই শুশুক ঐ বাঁদর-এর নীচে চলে এসে তাকে পিঠে করে ডাঙ্গার দিকে সাঁতরে চলল। যখন তারা এথেন্স এর তীরের কাছাকাছি এসে গেছে, শুশুক তার পিঠের সওয়ারীর কাছে জানতে চাইল যে সে এথেন্স-এর লোক কি না। বাঁদর বলল যে, সে এথেন্স-এর লোক, শুধু তাই না, সে এথেন্স-এর সবচেয়ে মহান এক পরিবারে জন্মেছে।

শুশুক এবার তার কাছে জানতে চাইল সে পাইরিয়াস সম্পর্কে কিছু জানে কি না। পাইরিয়াস হচ্ছে এথেন্স-এর বিখ্যাত বন্দরের নাম। বাঁদর ভাবল পাইরিয়াস কোন লোকের নাম। নিজের একটু আগে বলা মিথ্যা কথাকে চালিয়ে যাওয়ার জন্য সে উত্তর দিল যে পাইরিয়াস-কে সে ভালমত চেনে, এমন কি, সেই লোক তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আর তাকে দেখে সে, কোন সন্দেহ নেই, খুব-ই খুশী হবে। বাঁদরের এই জালিয়াতি-তে সেই শুশুক সাংঘাতিক রেগে গিয়ে তাকে জলের নীচে চুবিয়ে মেরে ফেলল।

প্রাচীন বচনঃ একবার একটা মিথ্যা কথা বলা শুরু করলে সেটাকে ঢাকতে আর একটা, এইভাবে ক্রমাগত মিথ্যা বলে যেতে হয় আর তার ফলে, আজ হোক আর কাল হোক, একসময় বিপদ ঘনিয়ে আসে।

আমি বলিঃ অন্যের দয়ায় থেকে মিথ্যে বলেও বেশীদিন বাঁচা যায় না!

(২৪)
The Game-cocks and the Partridge

লড়ুয়ে মোরগ আর বাতাই পাখীর গল্প
এক লোকের দুটো লড়ুয়ে-মোরগ ছিল। একদিন বাজারে একটা পোষা বাতাই পাখী বিক্রী হচ্ছিল। পাখীটা দেখে লোকটির এত ভাল লেগে গেল, সে ওটা কিনে বাড়ি নিয়ে এল। তার ইচ্ছে, মোরগ দুটোর সাথে থেকে এই পাখীটাও তৈরী হয়ে যায়। যেই মাত্র সে বাতাই-টাকে মোরগের খামারে ছেড়েছে, মোরগ দুটো ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল ওটার উপর। দুটোতে মিলে পাখীটাকে ভয়ানক দৌড় করালো। মনের দুঃখে মুষড়ে পড়ে পাখীটা ভাবতে লাগল যে, সে নুতন এসেছে বলেই তার এমন দুর্দশা ঘটল। খানিকক্ষন না কাটতেই বাতাইটা দেখে মোরগ দুটো নিজেরাই তুমুল লড়াই লাগিয়ে দিয়েছে। যতক্ষণ না একজন আরেকজনকে ভীষণ রকম পিটল, লড়াই চালিয়েই গেল তারা। সেই দেখে পাখীটা নিজের মনেই বলল, “এই লড়ুয়ে-মোরগ দুটো যখন নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া না করে থাকতে পারে না, তখন আমার সাথে কেন তারা লেগে পড়ল সেই নিয়ে ভেবে ভেবে হয়রান হওয়ার কোন অর্থ হয় না।”

প্রাচীন বচনঃ যারা নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া করে, নুতন লোকেদের পক্ষে তাদের এড়িয়ে চলাই মঙ্গল।

আমি বলিঃ যারা নিজেরা নিজেদের দেখতে পারে না, তারা অন্য লোকেদের-ও দেখতে পারবে না।

(২৫)
The Boy and the Nettle

এক বাচ্চা ছেলে আর বিছুটি পাতার গল্প।

একটি বাচ্চা ছেলের হাতে নরম কিন্তু বিষাক্ত শুঁয়ো-ওয়ালা বিছুটি পাতা লেগে যায়। বাচ্চাটি তার মা’র কাছে ছুটে গিয়ে বলে, “এত ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, আমি কিন্তু ওটা আলতো করে ছুঁয়েছিলাম।” “সেটাই তো ব্যাপার,” মা তাকে বোঝায় তখন, “তার ফলেই তো রোঁয়াগুলো তোমার হাতে ঘষে ঘষে গেল আর সেগুলো থেকে হুল ফুটে গিয়ে এখন জ্বলে যাচ্ছে। আবার যদি কখনো বিছুটি পাতা ধরো, সাহস করে, ঠিক মত, শক্ত করে, না ঘষে ধরবে, ঐ রোঁয়াগুলো-ই তখন চুপটি করে নরম রেশমের মত শুয়ে থাকবে, কোন ঝামেলা করবে না।”

(টীকাঃ ইংরেজীতে গাছটির নাম বলা হয়েছে Nettle, আন্তর্জালে অনেক খোঁজাখুঁজি করে বাংলা অনুবাদ-এ বিছুটি পাতার থেকে কাছাকাছি কিছু পাই নি। বিছুটি পাতা এইভাবে শক্ত করে ধরলে জ্বালা-চুলকানির কবলে পড়ার থেকে রেহাই পাওয়া যায় কি না আমার জানা নেই। )

প্রাচীন বচনঃ যা-ই করো, আলগা, আলগা নয়, পুরো শক্তি লাগিয়ে করো।

আমি বলিঃ আগে ভাল করে জেনে নাও কী করতে যাচ্ছ, কি ভাবে করতে হবে, তার পর করো, জ্বালা পোহানোর সম্ভাবনা কম থাকবে।
— — —

২৪ নং গল্পটিতে ইংরেজী অনুবাদে পাখীটিকে বলা হয়েছে Partridge. তারেক অণুর পাখীর নাম সংক্রান্ত লেখার ফলে জেনেছি যে এই পাখীর বাংলা নাম বাতাই। অণুর লেখাটি বাদ দিয়ে এই গল্পটি এ ভাবে অনুবাদ করা সম্ভব হত না।
অণু-দাদা, আজকের পাতাটা তোমার-ও পাতা।