পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান

চিঙ্গিস আইতমাতভের বই – পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান

*** ***

স্থান –
পাহাড় আর স্তেপ

দক্ষিণ সাইবেরিয়া থেকে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে ঘুরতে কিরগিজ উপজাতি ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্য এশিয়া জুড়ে। নবম শতাব্দীতে উইঘুরদের পরাজিত করে সম্ভবতঃ তাদের সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত বিস্তার ঘটেছিল। তারপর থেকে মার খাওয়া আর ছুটে বেড়ানোর ইতিহাস। কখনো মঙ্গোল, কখনো চৈনিক, কখনো উজবেক আগ্রাসনে কির্ঘিজরা মিশে গেছে নানা জাতিসত্ত্বায়। এই মিশ্রণ পার করে নিজেদের কির্ঘিজ বলেই পরিচয় দিতে পারা মানুষগুলো অবশেষে জায়গা খুঁজে নিয়েছিল পাহাড় আর স্তেপের চারণভূমিতে।

রেশম ব্যবসার পথ ধরে যুগে যুগে এখান দিয়ে নানা জনজাতির চলাচল, নানা সামরিক অভিযান। কখনো সম্রাট আলেকজান্ডার এসে থেমে গেছে এই কেন্দ্রভূমির কোন শহরে – আলেক্সান্দ্রিয়া এশ্চেট-এ, কখনো তালাশ নদীর প্রান্তরে চৈনিক বাহিনীকে থামিয়েছে আরবের সৈন্য বাহিনী। আগ্রাসন-এর পর আগ্রাসন-এ তাড়া খেয়ে বেড়িয়েছে এখানকার অধিবাসীরা।

এই তাড়া খাওয়া জীবন থেকে উদ্ধার পাওয়ার গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলেছে কির্গিজ মহাকব্যে। মানাস মহাকাব্যে বীরশ্রেষ্ঠ মানাস তিন পুরুষ ধরে লড়াই করেন খিতান আর ঐরাত মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে; সঙ্ঘবদ্ধ করেন চল্লিশটি উপজাতিকে। আজকের স্বাধীন কির্গিজ প্রজাতন্ত্র এই মহাকব্যের আলোয় তুলে ধরে নিজের সত্ত্বাকে। সে দেশের পতাকায় চারণ-জীবনের তাঁবুর প্রতীক-কে ঘিরে থাকা সূর্যের গায়ে ফুটে থাকে চল্লিশ রশ্মি।

কির্ঘিজিয়ার দুই বীর। একজন উপকথার – মানাস – শত্রু সংহার করেন ঘোড়ায় চড়ে তরবারি হাতে। অন্যজন বাস্তবে – চিঙ্গিস আইতমাতভ – লড়ে যান শব্দ সাজিয়ে লেখার পর লেখায়। কির্ঘিজিয়ার রাজধানীতে দু’জনের প্রতিমূর্ত্তি উদ্বুদ্ধ করে আজকের প্রজন্মকে।

কাল –
স্তালিন যুগ এবং তার পর

কির্ঘিজদের মার খাওয়া চারণজীবন মুক্তির আশায় উচ্ছ্বসিত উঠেছিল জার সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার উত্থানে। পরম উৎসাহে তারা বরণ করেছিল সোভিয়েত আদর্শকে। আর তারপর পেয়েছিল চরম বঞ্চনা আর মর্মান্তিক আশাভঙ্গ – স্তালিনের সোভিয়েত রাশিয়ার থেকে।

বাইরের এবং ভিতরের নানা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার পাশাপাশি স্তালিনের রাশিয়া প্রবল গতিতে এগোতে চাইছিল নূতন মানুষ গড়ায় – সোভিয়েত মানুষ গড়ায়। বেরিয়ে এসো অতীতের ছায়া থেকে। যে কোন দেরীকে দেখছিল সন্দেহের চোখে। বিপরীত মত তো পরের কথা, যে কোন প্রশ্নকে ধরা হচ্ছিল দেশদ্রোহিতা হিসেবে – শাস্তি – মরিবে সে জনা, অথবা নির্বাসনে।

অনেক আশা নিয়ে সোভিয়েতে যোগ দেয়া মধ্য এশিয়ার দেশগুলির কাছে এ ছিল হঠকারিতা, আহাম্মুকী! নূতনকে বরণ করতে অতীতকে আমূল ভুলতে হবে, ছুঁড়ে ফেলতে হবে! কেন? এ ত নিজের পূর্বপুরুষদের প্রতি, সত্ত্বার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা!

তারা প্রশ্ন তুলেছিল কেউ কেউ। নীরব সমর্থন ছিল সেই সব প্রশ্নে অনেকের। শাসকের কাছ থেকে নেমে এসেছিল চরম আঘাত। রাজা যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ। হত্যা, নির্বাসন, আর শ্রমশিবির। নির্মূল করে দাও কির্ঘিজিয়ার বৌদ্ধিক অগ্রবাহিনীকে। যাতে কোনদিন আর সেখানে কেউ সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা কথা বলার চিন্তা পর্যন্ত না করতে পারে। কিন্তু, ফাঁক থেকে গিয়েছিল, নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।

লেখক –
চিঙ্গিস আইতমাতভ

চিঙ্গিস তরিকুলোভিচ আইতমাতভ, তরিকুলপুত্র চিঙ্গিস আইতমাতভ।

‘যন্ত্র-বিশারদ’ আইতমাত কিম্বিলদিয়েভ এর ছেলে তরিকুল, তুমুল সাম্যবাদী, সেই তরিকুল-এর ছেলে, যাঁর পাহাড় ও স্তেপ-এর আখ্যান নামে গল্প-ত্রয় পেয়েছিল লেনিন পুরস্কার- সেই চিঙ্গিস আইতমাতভ।

স্তালিন জমানায় দেশের শত্রুদের নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনী এন কে ভি ডি-র হাতে নিহত হয়েছিলেন সোভিয়েত কর্মী তরিকুল আইতমাতভ। সেই তরিকুলের ছেলে চিঙ্গিস আইতমাতভ – যিনি বাবাকে কখনো ভোলেননি।

চিঙ্গিসের পিতা তরিকুল ছিলেন একনিষ্ঠ সোভিয়েত কর্মী, নেতা। কির্গিজিয়ার একাধিক সোভিয়েত-বিমুখ জেলায় তরিকুল-এর বুদ্ধিমত্তা আর দৃঢ়তায় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জোতদার-জমিদার-কুলাকদের হাত থেকে জমি ছিনিয়ে এনে সাধারণ কৃষকের যৌথখামার।

আরাভান-এর গ্রামে গ্রামে তাঁর নামে গান বাঁধা হয়েছিল –

আইতমাতভের শোনো ডাক
নিজের ভাগ্য গড়ো নিজের হাতে
এই দেশ এই জমি তোমার আমার।

সেই তরিকুল-এর অপরাধ? স্তালিন জমানায় সংশয়, ভিন্নমত সকল-ই অপরাধ, শাস্তিযোগ্য, চরম শাস্তিযোগ্য। অপরাধ করতেও লাগত না। যাঁকে জেলে ভরা হয়েছে তাঁর প্রতি খারাপ কথা না বলাই যথেষ্ট হত নিজের জেলে যাওয়ার জন্য – খুন হয়ে যাওয়ার জন্য। আর তার সাথে নিজে যদি অন্যদের ঈর্ষা জাগানোর মত বুদ্ধি-ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন তবে ত হয়েই গেল। পার্জিং। হয়ত বা এর পরেও থাকত দেশদ্রোহী নির্মূলীকরণের কোটা পূর্ণ করার দায়। কোটা পূরণ করে উঠতে না পেরে আজকের খুনি কাল নিজেই খুন হয়ে যেত নূতন খুনির হাতে!

সাধারণতঃ দেশের শত্রু বলে যাঁদের চিহ্নিত করে দেয়া হত তাদের আত্মপরিজনরাও রেহাই পেত না। নিঃশেষে উচ্ছেদ। তরিকুল-এর পরিবার পরিজনদের উপরেও নেমে এসেছিল অত্যাচার আর তুলে নিয়ে গিয়ে হাপিশ করে দেয়ার খড়্গ। নিশ্চিহ্ন হয়ে যান চিঙ্গিস-এর তিন কাকা। একবার, আর একটু হলেই চিঙ্গিস-ও হারিয়ে যেতেন। কির্ঘিজিয়ার সৌভাগ্য, শেষ ধাপটায় পোঁছানোর আগে রেহাই মিলেছিল চিঙ্গিসের। তারপর আর ভুল করেননি চিঙ্গিস। অপেক্ষা করেছেন সময় আসার, স্তালিনের মৃত্যুর। যত্ন করে শিখেছেন রাশান ভাষা, আয়ত্ব করেছেন শব্দের প্রয়োগ। বিষয় উপস্থাপনার কুশলতা আর ভাষার মায়াজালে শাসককে রেখেছেন আপ্লুত করে, মুগ্ধ করে। অবশ্য, রাশিয়াও বদলে যাচ্ছিল। চিঙ্গিস সেই বদলের অন্যতম অগ্র-সৈনিক।

একটা চিঠি, একটা লেখা – রাশি রাশি বুলেট ঝরিয়ে দিত। শব্দ অসীম ক্ষমতা ধরে। চিঙ্গিস আইতমাতভ এটা বুঝেছিলেন খুব ছোটবেলা থেকে, বুঝেছেন বারে বারে। এবং, প্রয়োগ করেছেন এই অমোঘ অস্ত্রকে অতি যত্নে, অব্যর্থ অভিঘাতে।

পাহাড় ও স্তেপ-এর আখ্যান-এর তিনটি গল্প – জামিলা, প্রথম শিক্ষক এবং বিদায় গুলসারি – তিনটি গল্পই এই অস্ত্রচালনার অংশ – শিল্পের দাবী পূরণ করেই তুলে ধরেছেন দেশপ্রেম, জাতিসত্ত্বা, সোভিয়েত মতাদর্শ। আর সেই মতাদর্শের বিচ্যুতির পাশাপাশি মতাদর্শে অবিচল থাকার করুণ পরিণাম। এ তাঁর পিতৃতর্পণ – আরও বেশী কিছুই হয়ত।

স্তালিনোত্তর যুগের মুগ্ধ সোভিয়েত শাসকরা একের পর এক তাঁকে দিয়েছেন চূড়ান্ত সম্মান। স্থানীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধতা হালে পানি পায়নি সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বরাভয় হস্তচালনে। ‘বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ’-এর প্রচারে অভিযুক্ত ‘দেশের শত্রু’ তরিকুল-এর ছেলে চিঙ্গিস আইতমাতভকে – প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত করেছেন সোভিয়েত রাশিয়ার শেষ প্রেসিডেন্ট, মিখাইল গর্বাচেভ। যিনি চিঙ্গিস আইতমাতভ-কে বন্ধু বলে গণ্য করতেন; যিনি এনেছিলেন পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্ত, মুক্ত বাতাস। যে বাতাসে পাল তুলে একদিন স্বাধীন হয়েছিল কির্ঘিজিয়া। স্বাধীন কির্ঘিজিয়ায় চিঙ্গিস আইতমাতভ অপবাদ মুক্ত করেছিলেন বাবার নাম।

গল্প – ১
জামিলা

গল্পটি এত বিখ্যাত যে, আন্তর্জালে সামান্য খোঁজাখুঁজিতেই এর গোটা ঘটনাপ্রবাহটি পেয়ে যাবেন, সব কটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের কে-কোথায়-কখন-কেন কি করেছে সেই বিবরণ সহ। এই লেখায় বিস্তারিত বিবরণ এড়িয়ে চলেছি যাতে ‘স্পয়লার আলার্ট’-এর দরকার না পড়ে।

সম্ভাবনা আছে, গল্পটি আপনার পড়া। আর, যদি সে পাঠ আপনি কৈশোরে কি প্রথম যৌবনে সেরে ফেলে থাকেন তবে তো কথাই নেই, খুবই সম্ভব যে জামিলার প্রেমিকদের বা দানিয়ারের প্রেমিকাদের মধ্যে আপনিও আছেন। কোন এক রম্য সন্ধ্যায় সেই পুরাতন প্রেমের স্মরণে আবার কিছু মুহুর্ত কাটানোর আমন্ত্রণ রইল। আর যদি না পড়ে থাকেন, আমার এই লেখা পড়ুন বা না পড়ুন, গল্পটি পড়ুন। মূল কির্গিজ বা রাশান-এ আপনার দখল থাকলে তো কথাই নেই, না থাকলে প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বাংলা অনুবাদটি পড়ুন – খালেদ চৌধুরীর অসামান্য অনুবাদে রস আস্বাদনে ঘাটতি পড়বে না।

গল্পের কথক – সেইত। গল্প বলছে প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির উপরে উঠে এক নারীর নিজের ভালোবাসাকে মর্যাদা দেওয়ার। বলছে তার নিজের আঁকা একটি ছবিতে ধরে রাখা দুই প্রিয় মানুষ কে নিয়ে।

একজন তার থেকে কয়েক বছরের বড়, তার দ্‌জেনে (বড় ভাইয়ের স্ত্রী) – জামিলা। তার নামের যা অর্থ, বাস্তবেই সে তাই – সুন্দরী। প্রাণচঞ্চল, অক্লান্ত পরিশ্রমী আর দৃঢ়চেতা এক তরুণী। কিন্তু, যুদ্ধরত স্বামীর চিঠিতে তার উল্লেখ থাকে সবার শেষে, কোনরকমে, এক লাইনের মামুলি কথায়। পিপাসিত থেকে যায় জামিলার মন।

অন্যজন যুদ্ধফেরত এক আহত সৈনিক – দানিয়ার। দেশপ্রেমে নিখাদ, বেদনাহত হৃদয় তার যুদ্ধসম্পর্কে একটি কথাও বলতে ইচ্ছুক নয়। পরিশ্রমী, নিজের মধ্যে ডুবে থাকা মানুষটি অন্তর থেকে উঠে আসা গানে চরাচর ভরিয়ে তোলে। ঐ গান যেদিন শোনা যায়না, বিস্তীর্ণ স্তেপের প্রান্তর সেদিন সেইতের কাছে অসহ্য, প্রাণহীন লাগে।

জামিলা আর দানিয়ার প্রেমে পড়েছিল একে অপরের। কুর্কুরেউ গ্রামে তার কিশোরবেলায় দেখা, অনুভব করা এই দুই প্রিয় মানুষের প্রেম সেইতকেও চিনিয়েছিল তার নিজের প্রেম। কি করবে জামিলা আর দানিয়ার? কি করবে সেইত, অন্যরা? সাধারণ ফ্রেমে বাঁধানো ছোট ছবিটি নিয়ে কথা বলতে বলতে সেইত আমাদের নিয়ে চলে যায় সেই ফেলে আসা দিনগুলিতে।

১৯৫৮ সালে মাসিক পত্রিকা নভি মির (Novyj Mir)-এ গল্পটি প্রকাশের সময় লেখকের বয়স তিরিশ। বিস্তর ঝড়ঝাপটা পার হয়ে তিনি ঠিক করে ফেলেছেন লেখক হওয়াটাই তাঁর ভবিতব্য। চেষ্টা করছেন রূপ দিতে সেই সৃষ্টিটিকে যা তাঁকে লেখক হিসেবে শক্ত জমির উপর দাঁড় করিয়ে দেবে। কির্গিজ এবং রাশান দুই ভাষাতেই দক্ষ আইতমাতভ অনেক লেখাই লিখেছেন দুটি ভাষাতেই। জামিলাও। তবে কির্গিজ ভাষায় ঐ একই বছরে আলা-তু (Ala-Too) পত্রিকায় প্রকাশের সময় গল্পটির নাম দিয়েছিলেন ‘মেলোডি’। অন্তরে এটি যথার্থই মেলোডি। স্তেপ আর পাহাড়ের দেশ থেকে ভেসে আসা ভালোবাসার গান। জামিলার গান। দানিয়েরের গান। (মধ্য এশিয়া বিশারদ ইরাজ বসিরি বস্তুতঃ গোটা জামিলা আখ্যানটিকেই আইতমাতভের লেখনীতে প্রাচীন কাজাখ-কির্গিজ চারণ-গায়ক (aqyn)-এর গান হিসেবে দেখেন।)

এই গান ধারণ করেছে সেইতের জীবনের এক বিশেষ সময়কে। কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের দিকে চলেছে সে। এই গান ধারণ করেছে সেইতের দেশ – তার কির্গিজিয়া, তার সোভিয়েত দেশকেও। সেইতের সাথে সাথে তার দেশেরও পর্বান্তর ঘটছে। কির্গিজিয়া এবং আশেপাশের মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে জারতন্ত্রের অবসানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সোভিয়েত শাসন। একসময়ের যাযাবর মানুষগুলি আজ এক সাথে কাজ করে সম্মিলিত মালিকানার যৌথখামারে। পুরাতন মূল্যবোধ এখনও কায়েম। কিন্তু, জায়গা ছাড়তে হচ্ছে নূতনকে। সে বদল ত্বরান্বিত হচ্ছে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র শত্রুর হাতে আক্রান্ত হওয়ায়। প্রাপ্তবয়স্ক সমস্ত পুরুষ যুদ্ধে চলে গেছে – সব্বাই। বাড়িতে রয়েছে মেয়েরা, কিশোররা, আর সামান্য কয়েকজন যুদ্ধফেরত আহত, প্রাক্তন সৈনিক। ঘরগেরস্তালী সামলানোর পাশাপাশি রণাঙ্গনের জন্য রসদ পাঠানোর দায়িত্বও এদেরই। এতাবৎ কাল ধরে অদেখা, অকল্পনীয়, ভয়ানক পরিশ্রমসাধ্য এক ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছে নূতন সোভিয়েত সমাজ। সোভিয়েত মানুষ।

আইতমাতভের কৈশোর কেটেছে এই সময়টাতেই। বড় হয়েছেন এই পরিবেশে। পিতা,  সোভিয়েত তরুণ তরিকুল, শুদ্ধিযজ্ঞে কারারুদ্ধ, নিখোঁজ, সম্ভবতঃ নিহত – সোভিয়েত শাসনের-ই হাতে। তারপরেও মা নাগিমা অবিচল, আদ্যন্ত সোভিয়েত নারী। অসীম প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে কষ্টেসৃষ্টে বড় করেছেন ছেলেমেয়েদের। আইতমাতভ নিজেও সোভিয়েত মানুষ। কাজে ঢুকে গিয়েছিলেন অতি শৈশবেই। যুদ্ধরত সৈনিকদের কাছ থেকে আসা চিঠিগুলি বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ে শোনাতেন কিশোর আইতমাতভ। তাই আজ যখন তরুণ আইতমাতভ লিখছেন জামিলার গল্প, সেই দিনগুলির অভিজ্ঞতায় সাজিয়ে, গল্পের পটভূমি আর তার চরিত্রদের আঁকতে পেরেছেন পরম মমতায়, অনুপুঙ্খ বর্ণনায়।

প্রস্তুতি আর সমাপতনের মেলবন্ধন মানুষের সামনে এনে দেয় স্বপ্ন সফল হওয়ার সম্ভাবনা।

লুই আহাগঅঁ। ফরাসী কবি, ঔপান্যাসিক এবং প্রকাশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মগোপন করে থেকে অনলস লড়াই চালিয়ে যাওয়া বিপ্লবী। বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সের সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা। সাম্যবাদী। সোভিয়েত রাশিয়ার একনিষ্ঠ অনুগামী। প্রকাশ করে চলেছেন ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’-র পতাকা তুলে ধরা লেখকদের লেখা। পঞ্চাশ-এর দশক শেষ হয়ে এল। আহাগঅঁ খুঁজছেন সোভিয়েত মতাদর্শে বিশ্বাসী কিন্তু রাশান জাতিসত্ত্বার বাইরের লেখকদের। কি লিখছেন তাঁরা? আহাগঅঁ নিজে রয়েছেন জটিল টানাপোড়েনে।  একদিকে স্ত্রী-র এবং অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া খবরে স্তালিনের যুগ সম্পর্কে তাঁর মোহভঙ্গ হচ্ছে। অন্যদিকে, সাম্যবাদী মন বিশ্বাস রাখতে চায় সোভিয়েত রাশিয়ার অগ্রগতিতে। সন ১৯৫৯। আগের বছর সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প জামিলা এখন কির্গিজ, রাশান দুই ভাষাতেই বই হয়ে বের হয়েছে। আহাগঅঁর কাছে পৌঁছল সে বই। পড়ে মুগ্ধ, উচ্ছসিত।

আইতমাতভের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রাচীন লোককথাকে ছুঁয়ে যাওয়া। অনাথ হয়ে যাওয়ার কারণে শৈশবে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া দানিয়ার ফিরে এসেছে নানা জায়গা ঘুরে, যুদ্ধক্ষেত্র ফেরত সৈনিক। আইতমাতভ লিখছেন – “বৃদ্ধ আকসাকালেরা (গাঁওবুড়োরা) বললেনঃ তুল্পার নিজের দলে ফিরে আসবেই।” তুল্পার অর্থাৎ কির্গিজ-কাজাখ উপকথার পক্ষীরাজ ঘোড়া। আবার কোথাও যুদ্ধে যাওয়া ছেলেদের মঙ্গলের জন্য তাদের মায়েরা প্রার্থনা করেন – “স্তেপ তোমাদের রক্ষা করুক! আমাদের মহান যোদ্ধা মানাস্‌-এর আত্মা তোমাদের রক্ষা করুক।”

তবে সবচেয়ে মনকাড়া বৈশিষ্ট্য তার লেখার কাব্যগুণ, তার চিত্রময়তা। ঘটনার বিবরণ দিয়ে তুলে ধরি একটুখানি।

[ সেদিন সকালে ওসমান হাত বাড়িয়েছিল জামিলার দিকে। জামিলা তাকে তীব্র ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু ওসমানের কুৎসিত ইঙ্গিৎ আর কথা তাকে বিষণ্ণ করে রেখেছে সারাটা দিন। আবার, জামিলার অপমান তার কিশোর দেওর সেইতের প্রাণের ভিতরে গিয়ে বেঁধে। এ ত তারও অপমান! অথচ এর প্রতিকার-ই বা কি। সে জামিলাকেই বকেছে ওসমানের মত লোককে তার কাছে আসতে দেওয়ার জন্য। যদিও সে জানে যে ওসমানদের আসা জামিলার ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপর নির্ভর করে না।  ফলে সে এখন  অনুতপ্ত। কিন্তু জামিলা সেইতকে একটি কথাও বলেনি। অন্ধকার মুখে নিঃশব্দে কাজ করে গিয়েছে সারাটা দিন। ঘাস কাটা, জড়ো করা, গাড়িতে তুলে দেওয়া। গোটা দিনটায় একবারও হাসে নি সে। এখন কাজ শেষে ঘরে যাবে সবাই। সেইত দেখে – ]

“আমরা শেষ গাড়িটা বোঝাই করার পর সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল জামিলা, মনে হল ও যেন জগতের আর সবকিছু ভুলে গিয়েছে। নদীর ওপারে দূরে,  কাজাখ স্তেপের প্রান্তে নবান্নের নিস্তেজ সূর্যকে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত তন্দুরের মুখের মত। প্রাকসন্ধ্যার নীলাভ ছায়া ছোট ছোট উপত্যকার উপর ছড়িয়ে পড়েছে; ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের গায়ে লাল রঙ মাখিয়ে নীল-বেগনি স্তেপের উপর শেষ রশ্মিমালা ছড়িয়ে সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে দিগন্তের অন্তরালে। জামিলা সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে রইল মুগ্ধ পরমানন্দিতভাবে, যেন কোন অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে। তার মুখ কোমলতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, ঈষৎ ফাঁক করা ঠোঁটে মধুর হাসি শিশুর মত।”

আইতমাতভের লেখনী চলেছে তুলির টানে। (খালেদ চৌধুরীর অনুবাদও অসাধারণ।)

নিজে অসামান্য কবি, কাব্যগুণগ্রাহী আহাগঅঁ-র উচ্ছ্বাস বাঁধ না মানা স্বাভাবিক। সহজ সরল গল্প। কিন্তু, বলার প্রকাশ মুগ্ধ করে রাখে। এদিকে অত্যন্ত শৈল্পিক ভাবে, প্রোপাগান্ডা হয়ে ওঠাকে সযত্নে এড়িয়ে, দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরেছেন পুরাতনকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলার গান। দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সোভিয়েত মানুষ হয়ে ওঠার গান। সাম্যবাদী  কবি-প্রকাশক পেয়ে গেলেন তার লেখককে। দ্রুত প্রকাশিত হল জামিলার ফরাসী অনুবাদ। আহাগঅঁ ঘোষণা করে দিয়েছেন – Djamila est la plus belle histoire d’amour du monde – জামিলা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর প্রেমের গল্প।

সেই শুরু। দিন বদলের পালা, চিঙ্গিস আইতমাতভের। বদলে যাচ্ছিল দুনিয়া। বদলে যাচ্ছিল রাশিয়া। বদল আসবে আরও। বদলে যাবে কির্গিজিয়া। আর, আইতমাতভ হবেন কির্গিজিয়ার সেই রূপান্তরের প্রধান স্থপতি।  চলুন, এবারে যাই পরের গল্পে।

গল্প – ২
প্রথম শিক্ষক

এ ও এক প্রেমের গল্প। ভাষার লালিত্যে, টানটান বর্ণনায়, অনুপুঙ্খ চিত্রনির্মাণে আইতমাতভ যে গল্প বুনেছেন তা এক নিঃশ্বাসে পড়ে না ফেলে উপায় নেই। কিন্তু, লেখক যখন চিঙ্গিস  আইতমাতভ, গল্প তখন নিছক প্রেমের গল্পের থেকে আরো বেশী কিছু।

জামিলা গল্পের কথক সেইত-এর মতন এ গল্পের কথক ও একজন চিত্রকর। তবে,  গল্পটি সে নিজে না বলে আমাদের নিয়ে যায় তার গ্রামে। গ্রামের নাম কুর্কুরেউ। সেখানে যৌথখামারীদের নিজের হাতে তৈরী নূতন আবাসিক স্কুলের উদ্বোধন উপলক্ষে  সম্বর্ধনা দেয়া হচ্ছে বৈজ্ঞানিক, বিখ্যাত একাডেমিশিয়ান আলতিনাই সুলাইমানভাকে। কুর্কুরেঊ গ্রামের মেয়ে তিনি, এখানেই লেখাপড়া শুরু করেছিলেন। গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন আর এদিকে আসা হয়নি তাঁর। এবার আসছেন।

অনুষ্ঠান শুরুর মুখে মুখে এসে পৌঁছে গেলেন আলতিনাই সুলাইমানভা। তাঁকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে সবাই আপ্লুত, উদ্বেল। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, অতিথিদের গল্প, ‘বারংবার টোস্ট প্রপোজ’। একসময় এলাকার বুড়ো পিয়ন অনুষ্ঠানের জন্য আসা টেলিগ্রামগুলো নিয়ে এলো। স্কুলের পরিচালক জিজ্ঞেস করলেন

– শোন তো বাপু, টেলিগ্রামগুলো আমাদের বুড়ো দিউইশেন নিয়ে এসেছে, তাই না?

দিউইশেন ঘরে আসেনি। সারাটা পথ চাবুক মারতে মারতে এসেছে ঘোড়াটাকে যাতে  অনুষ্ঠান শুরুর আগে টেলিগ্রামগুলো সবার হাতে পৌঁছে দিতে পারে। তা ও একটু দেরী হয়ে গেল। মন খারাপ তার। অনুষ্ঠানের আয়োজকরা একজনকে পাঠাল তাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে আসতে।

দিউইশেনের নাম শুনে আলতিনাই কি কারণে, কে জানে – চমকে উঠলেন একবার, আর কেমন যেন একটু অদ্ভুতভাবে, যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে এমনিভাবে জিজ্ঞেস করলেন,

– কোন্‌ দিউইশেনের কথা বলা হচ্ছে?
– ও আমাদের খামারের পিয়ন, আলতিনাই সুলাইমানভা, বুড়োকে কি আপনি চেনেন না কি?

দ্ব্যর্থবোধক মাথা নাড়েন আলতিনাই। কিন্তু তিনি উঠে এগিয়ে যাওয়ার আগেই বাইরে ঘোড়ার খুরের খটখট আওয়াজ তুলে ছুটে চলে যায় সেই পিয়ন – আরো চিঠি বিলি করতে হবে তাকে।

লোকেরা দিউইশেনের চলে যাওয়াকে গুরুত্ব দেয় না। একজন বলে –
– অদ্ভুত লোক বটে! যুদ্ধের পর তো হাসপাতাল থেকে বেরুলো, ঘটনাটা ইউক্রেনের, তারপর সেখানেই বসবাস শুরু করলো। বছর পাঁচেক হলো মাত্তর ফিরে এসেছে। বলে যে দেশের মাটিতে মরার জন্যে ফিরে এসেছে। সারা জীবন এরকম একাই কাটিয়ে দিলো
লেখক শুনতে থাকেন। হয়ত আলতিনাইও –
– আচ্ছা, কারো মনে আছে, আমরা কিন্তু সেই কোন্‌কালে দিউইশেনের পাঠশালাতেই পড়তে যেতাম
গ্রামের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের একজন তাঁর গ্লাস  তুলে ধরলেন,
– আর এদিকে নিজে সে বর্ণপরিচয়ের সব ক’টা অক্ষরই চিনতো না।
‘বক্তা ব্যক্তিটি এ-কথা বলেই চোখ টিপে মাথা নাড়াতে লাগলেন। সব মিলিয়ে তাঁর কথায় বিস্ময় ও ব্যঙ্গের ছোঁয়া লাগলো।’ সবাই হাসাহাসি করতে থাকেন দিউইশেনকে নিয়ে। শুধু এক আলতিনাই সুলাইমানভা আরক্তিম হলেন, কেমন একটু হতবিহ্বল। গালগল্পে মশগুল লোকজন অবশ্য সেসব খেয়াল করলনা। আলতিনাই এসেছিলেন কয়েকদিন থাকবেন বলে। তার বদলে সেই দিন-ই শহরে ফিরে যাওয়ার প্রথম ট্রেন ধরে ফেরৎ চলে গেলেন।

কিছুদিন পর লেখক একটি চিঠি পেলেন আলতিনাইয়ের কাছ থেকে। সেখানে তিনি অনুরোধ করেছেন যে, তাঁর এই চিঠির কাহিনী যেন সকলকে, বিশেষ করে তরুণদের জানানো হয়। তারা উপকৃত হবে।

চিঠি পড়ে ঘোর লেগে গেল লেখকের। অনেক ভাবনা চিন্তার শেষে স্থির করলেন, এই চিঠির সবটুকু সুলাইমানভার নিজের জবানীতে বলাটাই উচিত কাজ হবে।

শুরু হল আলতিনাইয়ের জবানীতে তাঁর প্রথম শিক্ষকের গল্প। শিক্ষক দিউইশেনের গল্প।

বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করা আজকের পিয়ন দিউইশেনের নয়। পকেটে সোভিয়েত সরকারের সীল দেওয়া এক চিলতে কাগজ আর সামান্য মাস-মাইনে সম্বল করে যে দুরন্ত আশাবাদী তরুণ একদিন কুর্কুরেউ গ্রামে এসে হাজির হয়েছিল গ্রামের মানুষদের শিক্ষিত করে তুলবে বলে, সেই দিউইশেনের গল্প। সনটা ১৯২৪। ঐ সময়ে ঐ রকমের  গ্রামে শিক্ষকতার কোন দাম-ই ছিল না। নেহাত সোভিয়েত সরকারের ছাপ্পার বিরুদ্ধতা করা যাবেনা, তাই সে টিঁকে যেতে পেরেছিল।

এবং, আলতিনাই সুলাইমানভার গল্প। আজকের বিখ্যাত একাডেমিশিয়ান, বৈজ্ঞানিক আলতিনাই সুলাইমানভার নয়। মা-বাপ হারা, নিত্য মার খাওয়া অনাথ বালিকা আলতিনাইয়ের গল্প। মাত্র পনের বছর বয়সেই যাকে তোকোল – দু নম্বর বউ হিসেবে তার চাচী বিক্রি করে দিলো এক বুড়োর কাছে। দিউইশেনকে পিটিয়ে হাত ভেঙ্গে, মাটিতে শুইয়ে দিয়ে তার স্কুল থেকে আলতিনাইকে তুলে নিয়ে চলে গেল সেই বুড়ো আর তার গুন্ডারা। সেই রাতেই ধর্ষিত হল আলতিনাই। এ গল্প সেখানেই ফুরিয়ে যেতে পারত। কিন্তু আলতিনাই যে ভীষণ ঘৃণা করত তোকোল হয়ে যাওয়া।

ঘেন্না করতেন চিঙ্গিস আইতমাতভ নিজেও। কারণ তাঁর নিজের পিসী। কারাকিজ। লোভী কাকার চক্রান্তে গরীব বাবার অভাবের সংসার থেকে তোকোল হয়ে যাওয়া কারাকিজ। অভিশপ্ত বিয়ের প্রথম রাতেই ধর্ষিত হয় সে। তখন তার বয়স মাত্র তের বছর।

‘তোকোল’ কারাকিজ যখন শ্বশুরবাড়ি চলে যান, সনটা সে বছর – ১৯১৭! বলশেভিক বিপ্লব সে বছর উচ্ছেদ ঘটায় জারতন্ত্রের। বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। পাঁচ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মধ্য এশিয়ার গ্রামে গ্রামে নূতন শাসকেরা তৈরী করে সোভিয়েত – সন, ১৯২২। পৃথিবী শোনে নূতন মূল্যবোধের ডাক। আরো পাঁচ বছরের মাথায় সোভিয়েত সরকার বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার পর কারাকিজ শ্বশুরবাড়ি পরিত্যাগ করে চলে আসেন তার বাপের বাড়ি শেকের-এ। একসময় বিয়ে করেন তার পছন্দের মানুষকে। তার পিঠোপিঠি দাদা তরিকুল তখন সোভিয়েত গড়ার অগ্রসৈনিকদের একজন। সন ১৯২৮ – চিঙ্গিস আইতমাতভ আলো দেখলেন পৃথিবীর।

চিঙ্গিসের দশ বছর বয়সে দেশদ্রোহীর তকমা মাথায় গ্রেপ্তার হলেন তরিকুল। মা নাগিমা ছেলেমেয়েদের নিয়ে শ্বশুরের ভিটেয় চলে এলেন। চিঙ্গিসরা বড় হয়ে উঠলেন মা, ঠাকুমা আর কারাকিজ পিসীর ছত্রছায়ায়।

তাই আইতমাতভ জানতেন তোকোল-এর অভিশপ্ত জীবন। লিখলেন তিনি আলতিনাইয়ের জবানীতে

– ‘তোকোল’ – মানে দু’নম্বর বৌ। উহ্‌, কী ঘেন্নাই না করি এই শব্দটাকে! কে, কখন, কোন্‌ জঘন্য সময়ে যে আবিষ্কার করেছিল একে! দ্বিতীয় পত্নী হওয়ার পরাধীনতা, দেহে মনে ক্রীতদাস হওয়া – এর চেয়ে অপমানকর অবস্থা আর কী হতে পারে? হে হতভাগ্য নারীর দল, তোমরা তোমাদের কবর ছেড়ে উঠে এসো! উঠে এসো, অত্যাচারে নিহতা, ধর্ষিতা, মানুষের যাবতীয় অধিকারবঞ্চিতা নারীর হে প্রেতাত্মারা – তোমরা উঠে এসো! হে শহীদের দল, তোমরা উঠে এসো, ঐ অন্ধকার কালো জগৎ একবার কেঁপে উঠুক! আমি – তোমাদের দলের সর্বশেষ জন্ম, ঐ একই ললাটলিপি পার হয়ে এসেছে যে, সেই আমি ডাকছি তোমাদের!

আইতমাতভ এই বিপ্লবাত্মক ডাক সেদিন দিতে পেরেছিলেন কারণ এই ডাক শোনার পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল সেই সময়। সেই পরিকাঠামো – সোভিয়েত। সেই সোভিয়েতের শক্তিতেই আলতিনাইকে উদ্ধার করেন দিউইশেন।

তারপর? হার না মানা আলতিনাই। হার না মানা দিউইশেন।

পড়ে ফেলুন তা হলে জামিলা গল্পের চার বছর পরে প্রকাশ হওয়া আখ্যান – ‘প্রথম শিক্ষক।’ আলতিনাইয়ের লড়াই আর দিউইশেনের মানুষ গড়ার গল্প। তাঁদের প্রেমের গল্প। সহজ সরল আর চিত্রময় ভাষায় লেখা টানটান কাহিনী। মামুদ হায়াৎ-এর বাংলা অনুবাদ ঝরঝরে।

এই গল্প প্রকাশিত হওয়ার সময় আইতমাতভ আর অজানা লেখক নন। রীতিমত পরিচিত এবং আদৃত। আইতমাতভ তাই সাহস করে তুলে এনেছেন সোভিয়েত কি ছিল, আর কি হয়েছে। যে দিউইশেন একদিন অশিক্ষার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে তুলেছিল গ্রামের প্রথম স্কুল, সেই দিউইশেন-এর অবদান এখন ভুলে গেছে গ্রামের লোকেরা। কিন্তু, তিনি যে চিঙ্গিস আইতমাতভ। আশার আলো ত তাঁকে জ্বালিয়ে  রাখতেই লাগে। তাই লব্ধপ্রতিষ্ঠ একাডেমিশিয়ান আলতিনাই এই গল্পের তরুণ লেখককে বলেন –

– আমার শিক্ষকের কাছে আমাকে ফের যেতে হবে, আমাকে জবাবদিহি করতে হবে তাঁর সামনে। ক্ষমা চাইতে হবে আমাকে। মস্কোর কাজ শেষ হলে কুর্কুরেউ গ্রামে যাবার ইচ্ছে আছে আমার, তখন লোকজনকে অনুরোধ করবো – নতুন এই আবাসিক স্কুলের নাম যেন ‘দিউইশেন বিদ্যাভবন’ রাখে।

আর হ্যাঁ, যদি কখনো কুর্কুরেঊ গ্রামে যান, ধরুন মনে মনেই, সেই গ্রামে ঢোকার মুখে একটা বড় টিলায় পাশাপাশি দাঁড়ানো লম্বা পপলার গাছদুটো নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়বে। দিউইশেন নিজে হাতে পুঁতেছিলেন ঐ গাছ দুটো। ওদের পাশেই ত ছিল দিউইশেনের স্কুল। বলেছিলেন

–   দেখো, কী রকম সুন্দর গাছ হয়ে উঠবে ওরা! এখানেই ওরা দাঁড়িয়ে থাকবে, এই টিলার উপর, পাশাপাশি – যেন দুই ভাই। সবাই ওদের দেখতে পাবে দূর থেকে, যারা লোক ভালো তাদের মন ভরে উঠবে এ দেখে। ততদিনে জীবন অনেক পাল্টে যাবে, আল্‌তিনাই। যা-কিছু ভালো তার সবই তো এখনো সামনে পড়ে আছে …

এবার চলুন তা হলে তৃতীয় গল্পে – বিদায় গুলসারি। সে গল্প প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রথম শিক্ষক’ প্রকাশ হওয়ারও চার বছর পরে।

গল্প – ৩
বিদায় গুলসারি

গুলসারি – সে তো সোনালী ঝুমকা ফুল? প্রায় তাই। ওই রকম সোনালী রং-এর এক ছটফটে ঘোড়া। জন্মের পরেই সে তুলে নিয়েছিল এক দুলকি চাল। জাত দৌড়বাজ। অপেক্ষা শুধু ঠিক লোকটির। এসে গেল সে ও – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত তানাবাই বাকাসভ।

এ সব অবশ্য আমরা জানছি তানাবাই-এর স্মৃতি চারণ থেকে। আজকে দুজনে মিলে চলেছে আলেক্সন্দ্রভকা থেকে তানাবাই-এর বাড়ি, স্তেপের প্রান্তর আর পাহাড় পার হয়ে। কিন্তু পার হওয়া কি আর হয়ে উঠবে? গুলসারি যে বুড়ো হয়ে গেছে, তানাবাইও।

লেখক জীবনে বেছে নেওয়ার আগে চিঙ্গিস পশুপালন বিদ্যায় ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। বংশ পরম্পায় পশুপালকদের ঘরের ছেলে চিঙ্গিস এমনকি লেখক জীবনের প্রথমদেকের অনেকগুলি বছর আশেপাশের গ্রামগুলিতে পশুখামার বিশেষজ্ঞ হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করে গেছেন। তাই ভেড়া প্রতিপালকদের জীবন হোক কি তানাবাই আর গুলসারির সখ্য – চিঙ্গিস সবই ধরেছেন অনায়াস দক্ষতায়।

আজকে তানাবাই চলছে আর ভাবছে – নানা কথা – গুলসারির, নিজের। তার ভাবনার সূত্র ধরে উঠে আসে আদর্শ বাস্তবায়নের নামে নেতৃত্বের অবিমৃষ্যকারী হঠকারী সিদ্ধান্তের পরিণতির বিবরণ। ধান্দাবাজদের হাতে সৎ মানুষদের লাঞ্ছনা আর বিতাড়ন। সাম্যবাদ-এর আদর্শ ধরে রাখার জন্য শেষ নিঃশ্বাসটা পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অবিচারের শিকার হওয়া বন্ধুর জন্য কিছু করতে না পারার যন্ত্রণার কাহিনী।

আইতমাতভের গল্পের অন্যতম সম্পদ তার চিত্রকল্প। কথায় ছবি আঁকেন।
“… পরে সে নদী থেকে আঁজলাভরে জল পান করল। ঠাণ্ডা কনকনে জল, তার সঙ্গে মুড়মুড়ে পাতলা বরফের টুকরো। জল কলকল শব্দে তার কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাচ্ছিল, আবার সে জল তুলে মুখে দিল, জল পড়ে গা ভিজে গেল।” – মনে হয় যেন পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি।

আছে চিরন্তন অসহায়তার গল্প। লেখকের নিজের জীবনের অপূর্ণ প্রেমের বেদনা এ গল্পের কেন্দ্রীয় মানুষটিও ভোগ করেছে। আইতমাতভ প্রেমে পড়েছিলেন কির্গিজ নাট্যমঞ্চের বিখ্যাত অভিনেত্রী বিউবিউসার। কিন্তু বিবাহিত চিঙ্গিস-এর এই বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম দল ভালো চোখে নেবে না তাই আইতমাতভকে বাঁচাতে বিউবিউসা আইতমাতভকে ফিরিয়ে দেন। তানাবাইকেও ফিরিয়ে দেয় বিউবিউজান।

ছোট্ট করে আঁকা হলেও দাগ রেখে যায় তানাবাই-এর স্ত্রী জায়দার। যে রাতে জায়দার জোর করে তানাবাইকে রওনা করিয়ে দেয় তার বন্ধু চোরোকে দেখতে যাওয়ার জন্য – ভোলা যাবে না।

আর চোরো। নরম মনের হাল-না-ছাড়া মানুষ। ভালো মানুষ সাম্যবাদী। দলের অনুশাসন মেনেও সোজা কথা সোজা ভাবে বুঝতে অভ্যস্ত তানাবাইকে পার করে নিয়ে চলে যা-হওয়ার-ছিল আর যা-হয়ে-চলেছের দুস্তর ফারাকের দিনগুলো। শেষে আটকে যায় সমাজতন্তের আষ্টেপৃষ্ঠে সেঁটে বসা আমলাতান্ত্রিক ধান্দাবাজদের জটীল গোলকধাঁধায়।

কিন্তু শুধু এইটুকুই নয়। আইতমাতভের আরও অনেক গল্পের মতই বিদায় গুলসারি-ও আমাদের কিছু মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। যে জীবন দোয়েলের, ফড়িং-এর ঘোড়া-চারণের, ভেড়া প্রতিপালনের তার থেকে যে জীবন নাগরিকের, ট্রাকচালকের, পরিকল্পকের, পরিদর্শকের – তা কি প্রকৃতই আরও উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন? না কি আসলেই খারাপ, ফাঁকিবাজি? সত্যি-ই কি যৌথ-ব্যবস্থা ব্যক্তিনির্ভরতার দুর্বলতাকে কাটিয়ে ওঠার উপায়?

তাঁর সব গল্পেই আইতমাতভ নিয়ে আসেন কির্গিজিয়ার কোনও না কোনও লোকগাথা। এই গল্পেও অত্যন্ত কৌশলের সাথে ব্যবহার করেন এক শিকারির কাহিনী। শিকারির পরিণতি লোকগাথাটিতে যেমন বাস্তবেও তাই হয়েছে।

আইতমাতভ এ লেখায় সোভিয়েত ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলিকে, নির্মমতাগুলিকে সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন। কির্গিজ এবং রাশান দুই ভাষাতেই পারদর্শী আইতমাতভ তার আরও অনেক গল্পের মত বিদায় গুলসারিকেও লিখেছিলেন দুটি ভাষাতেই। কির্গিজে এবং রাশান-এ। রাশান ভাষায় ‘বিদায়’ লিখলেও কির্গিজে তিনি ব্যবহার করেছিলেন ‘জানিবারিম’ – আত্মা, জীবন, আত্মশক্তি। কেন? কির্গিজ পাঠককে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করতে? আমার জানা নেই।

রাশিয়ায় দীর্ঘদিন কাটানো ব্রিটিশ সাম্যবাদী লেখক, অনুবাদক, অধ্যাপক জেমস রিওর্ডান লিখেছিলেন ‘আইতমাতভ একটি প্রহেলিকা’। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলেন এই বলে যে উনি দুটি ভাষাতেই গল্প লিখতেন। যেটা বলেননি সেটা হল আইতমাতভ কি করে ক্রুশ্চেভ থেকে শুরু করে ব্রেজনেভ, আন্দ্রপভ হয়ে গর্বাচভ পর্যন্ত সকলের মুগ্ধতা, প্রশস্তি আদায় করে নিয়ে এক-ই সাথে উদারনীতিবাদীদের-ও সোৎসাহ সমর্থন পেয়ে গিয়েছেন।

বলতে থাকলে কথা ফুরাবে না। পাঠক বরং বইটা হাতে নিন। অরুণ সোম-এর অনুবাদ অতুলনীয়।

তিনটি গল্পকে সূত্রবদ্ধ করে অনুভব করুন সেই যাদু যা একই সাথে ভেঙ্গেছে আর গড়েছে। ‘জামিলা’-তে যে বীজ পুঁতেছিলেন চিঙ্গিস, তার পত্রোদ্গম ঘটিয়েছেন ‘প্রথম শিক্ষক’-এ। ‘বিদায় গুলসারি’-তে সে সতেজ বৃক্ষ। পরবর্ত্তীকালে আরো সৃষ্টির মধ্য দিয়ে একসময় সে শিকড় চালিয়ে দেবে আরো গভীরে, ছায়া দেবে উদারনীতিবাদের আরো সাহসী পদক্ষেপকে। ভেঙ্গে যাবে মুক্তিদাতা থেকে নিপীড়কে বদলে যাওয়া এক লৌহকঠিন সমাজব্যবস্থা। সঠিক সোভিয়ত-এর সন্ধানে চলতে চলতে সোভিয়েত একসময় নেই হয়ে যাবে। আর তাই হয়ত বা, গর্বাচভ পরবর্ত্তী রাশিয়ায় চিঙ্গিস আইতমাতভ যদি প্রাসঙ্গিক নাও থাকেন, মুক্ত, স্বাধীন কির্গিজিয়া তাকে হৃদয়ে রেখে দেবে।

[ চিঙ্গিস আইতমাতভ আর তাঁর সৃষ্টিগুলিকে নিয়ে অনেকেই অনেক কথা লিখেছেন। চলচ্চিত্রও হয়েছে। আমি যা লিখলাম তা সবই আন্তর্জাল থেকে পাওয়া। লভ্য তথ্যের/কাহিনীর সামান্যই এখানে এসেছে। আগ্রহী পাঠকের জন্য উইকির বাইরের কয়েকটি সূত্র নীচে দিলাম।

প্রিয় বন্ধু, প্রিয় বোন তৃণা নাহার আর সচলায়তন-এর বন্ধু ষষ্ঠ পাণ্ডব এবং তুলিরেখাকে অজস্র ধন্যবাদ এই লেখাটির জন্য।

উইকির বাইরের তথ্যসূত্র:
Have the Mountains Fallen?: Two Journeys of Loss and Redemption in the Cold War
Jeffrey B. Lilley

The Carl Beck Papers
in Russian and East European Studies
No. 605
Joseph P. Mozur

Parables from the Past: The Prose Fiction of Chingiz Aitmatov
Joseph P. Mozur

[প্রকাশ – গল্পপাঠ, অগাস্ট ২৬, ২০২০]

কির্ঘিজিয়ার দুই বীর। একজন উপকথার – মানাস – শত্রু সংহার করেন ঘোড়ায় চড়ে তরবারি হাতে। অন্যজন বাস্তবে – চিঙ্গিস আইতমাতভ – লড়ে যান শব্দ সাজিয়ে লেখার পর লেখায়।