দৃশ্যান্তর – Done

এই পর্বটিকে বলা যেতে পারে ক্যালিডোস্কোপে দেখার আগামী পর্বের প্রস্তুতি। সময়রেখায় এর অবস্থান উত্তরবঙ্গ থেকে চলে আসার পরে।

ছবি আঁকার যে শখ আমার মেটেনি তা পূরণ করে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আরেক রকমের ছবি বানিয়ে – আলোকচিত্র, ফটোগ্রাফ। লেন্সের ভিতর দিয়ে মুহুর্তকে ধরে রাখা। আর এই কাজটি করতে গিয়ে এক নূতন দিগন্ত খুলে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা বেঁচে থাকি মুহুর্তের স্মৃতিতে, আর ফটোগ্রাফ আমাদের সুযোগ করে দেয় সেই স্মৃতির সরণি ধরে ঘুরে বেড়াতে, বেঁচে থাকতে সেই সব হারিয়ে যাওয়া মুহুর্তগুলোয় আবার, আবার …

দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার তিন মাত্রার মূহুর্তকে যে আলোকচিত্রে ধরা হল, সেটি দ্বিমাত্রিক। আলো আর ছায়ার পারস্পরিক অবস্থানে আমাদের বোধে আমরা তাকে  তিন মাত্রায় দেখি। আর, সেখানে এই দেখা ঐ মূহুর্তটির সাথে আরও একটি মাত্রাকে জুড়ে দেয় – সময়। আলোকচিত্রটি স্থিরচিত্র কিন্তু আমাদের সে সওয়ার করে নেয় সময়ের হাওয়াই জাহাজে। একটি মাত্র ছবি আমাদের দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নিয়ে চলে।

ফটোগ্রাফি নিয়ে এই সব উপলব্ধি একসময় আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তবে, সেই দিনগুলির সূচনা হয়েছিল কুচবিহারের এক বিকেলে। প্রতিবেশি এক দাদা সেদিন আমাদের কাছে এসে জানাল, সে আমাদের তিন ভাইয়ের একটি ছবি তুলতে চায়। মায়ের সাথে কথা বলে নেওয়া হয়ে গেছে। মা আমাদের চুল আঁচড়ে দিল, জামা-কাপড় টেনে-টুনে ঠিক করে দিল, যতটা সম্ভব ভদ্রস্থ দেখানো। এরপর আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম বাড়ির সামনের রাস্তায়। পাড়ার ভিতরের রাস্তা, গাড়ির চলাচল নেই বললেই চলে। অনেক বাদে বাদে একটা-দুটো সাইকেল, রিক্সা বা গরুর গাড়ি। দাদা আমাদের এমনভাবে দাঁড় করালো যাতে আমাদের মুখে যথাসম্ভব আলো এসে পড়ে। তারপর সে তাক করলো তার আশ্চর্য যন্ত্রটি – একটি ক্যামেরা। সেই প্রথম আমরা তিন ভাই ক্যামেরা দেখলাম। আমাদের বলা হল ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকাতে। সেইসাথে কি হাসিমুখেও তাকাতে বলা হয়েছিল? মনে নেই।

ফটোগ্রাফার দাদার হাতে ধরা ছোট একটা কাগজের খামে একদিন সেই ফটোগ্রাফ এসে হাজির হল আমাদের বাড়িতে। দেখলাম তিন মূর্তির ছবি। মেজ ভাই একদম স্বাভাবিক, হাসিমুখে সোজাসুজি তাকিয়ে আছে। দেখলেই মন ভরে যায়। আমি ভয়ানক রকম কাঠ-পুতুল, কয়েক বছর বাদে এন সি সি-র প্যারেডে ঐ রকম অ্যাাটেন-শ-ন ভঙ্গিতে যে নিয়মিত দাঁড়িয়েছি, ঐ বিকেলে তার একটা প্র্যাকটিস হয়েছিল মনে হয়। আর ছোট ভাই – দুনিয়ার যত রকমের বিরক্তিকর কাজ থাকতে পারে, তাদের সবগুলিকে এক করলেও ঐ বিকেলের ঐ সময়টায় সে যতটা বিরক্ত বোধ করেছিল তার ধারে-কাছে আসবে না, অন্তত তার মুখের ছবি সোচ্চারে সেটি বলে দিচ্ছিল। হয়ত শরীর ভালো ছিল না তার, কিংবা মেজাজ।

কুচবিহার ছেড়ে আসার পর একদিন সুযোগ এল, নিজেই ছবি তোলার। আমার বয়স তখন এগারো-বারো বছর হবে। দমদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুচবিহার ঘুরে কাঁচরাপাড়ায় এসে ঠাঁই নিয়েছি আমরা। ভাড়া থাকি দোতলা বাড়ির নীচের তলাটিতে। কিন্তু আমার বিচরণ ছিল গোটা বাড়ি জুড়েই। এক মায়াবী দুপুরে, চিলেকোঠার ঘরটা থেকে হাতে এসে গেল আগফার একটি বাক্স-ক্যামেরা, আদিযুগের। তার সবচেয়ে পছন্দের বৈশিষ্ট্য ছিল – দুটি ভিউ-ফাইন্ডার। একটি ক্যামেরার পিছনের দেয়ালে, অন্যটি ক্যামেরার ছাদে। ক্যামেরাটির বহিরঙ্গের রূপে তাকে কোলে তুলে নেওয়ার মত ছিল না। কিছু অকর্মণ্যতাও ছিল হয়ত যা আমার জানা ছিল না, আমি জানতে উৎসুকও ছিলাম না। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম ওটাতে ফিল্ম ভরা যাবে কি না। যাদের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম তাদের ডাকতাম বড়কাকু, ছোটকাকু বলে। আমার প্রতি ছিল তাদের অপার স্নেহ। ফলে ক্যামেরাটা ছোটকাকুকে দেখানোর সাথে সাথেই সেটা আমার হয়ে গেল।

ছোটকাকুর উৎসাহে চলে গেলাম ফটোর দোকানে – জীবনে প্রথমবার। তারপর আর কি – ক্লিক ক্লিক ক্লিক। একসময় পরম উত্তেজনার শেষে হাতে এল শাটার টেপার ফসলগুলি। সেই যে আমি মুগ্ধ হলাম, আমার কাজে নয়, এই শিল্পটিতে, সেই মুগ্ধতা আর কোনদিন কাটল না। মুগ্ধতার শুরু করে দিয়ে ক্যামেরাটি অবশ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল তার পরে পরেই – আমার হাতে। ঠিক কোন কারণে মনে নেই, আমার ধারণা হয়েছিল ক্যামেরাটা একবার পুরোপুরি খুলে ফেলে তারপরে আবার জুড়ে সেটাকে ঠিক করে বানিয়ে নেয়া দরকার!

এরপর দীর্ঘদিনের খরা – পকেট ফুটো। আবার ক্যামেরা পেলাম কুড়ি বছরের পারে আমেরিকায় এসে। আহা সেই ২০ ডলারের তাক-করো-চাবি-দাবাও (তাকচাদা) ক্যামেরায় যে অপার আনন্দ পেয়েছিলাম তার পরিমাণ পরবর্তীকালের যেমন-দাম-তেমন-তোলো (যেদাতেতো) ক্যামেরাগুলির থেকে কোন অংশে কম ছিল না। এর বছরখানেকের মাথায় পেলাম প্রথম এসএলআর, নাইকন ৫, স্ত্রীর কাছ থেকে, তার সাথে আমেরিকায় আসার উপহার হিসেবে – প্রতিশ্রুতিমত! পাশাপাশি ব্যবহার চলল নানারকম তাকচাদা ক্যামেরারও। একসময় সোনির সৃষ্টি হাতে নিয়ে ঢুকে পড়লাম ডিজিটাল ক্যামেরার জগতে – একটা ফ্লপিতে চারটে শট। তার পাশাপাশি এলো আর এক অভিজ্ঞতা – ক্যামকর্ডারে স্ন্যাপশট। অবশেষে আর এক স্বপ্নের ক্যামেরা – নাইকন ডি৩০০। এর পর এক সময় এসেছে স্মার্ট ফোন। আই ফোন, স্যামসাং। পকেটে থাকে। ছবি নিতে হলে বের করে নিই। নাইকন ডি৩০০ পড়ে আছে ঘরের কোণে, ব্যাগের ভিতরে। আমার জন্য দিন গিয়েছে তার।

ক্যামেরার ডিজিটাল দুনিয়ায় যাওয়ার আগেই আর-একটি ডিজিটাল দুনিয়ায় আমি ভিড়ে গিয়েছিলাম – ফটোশপিং। ক্যামেরা থেকে পাওয়া ছবিকে উৎস করে নূতন কোন ফসল তোলা। যা পেয়েছি তার থেকে অন্য কিছু বানিয়ে নেওয়ার এই সৃষ্টিকর্মে আনন্দ পেয়েছি খুব। পেন্সিলে-কলমে-তুলিতে দক্ষতা অর্জন করা হয়ে ওঠেনি। এই ফটোশপিংয়ের কাজে সেই অতৃপ্তি মেটানোর জোরদার চেষ্টা চালিয়েছিলাম কিছুকাল। কত রকমের ফটো সম্পাদনার সফটঅয়্যার যে ব্যবহার করেছি – বিনা দামের, নানান দামের! একটা সময় ছিল যখন ছবি নিয়ে কারিকুরি করব বলেই ছবি তুলতাম। বন্ধুমহলে একটু কদর-ও হয়ে গেল। উৎসাহের চোটে আলো কিনলাম, নানা রংয়ের পশ্চাৎপট, কাঠামো – হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড! এমন কি আইনি নিয়ম-কানুন মোতাবেক ফটো তোলার ব্যবসাও চালু করে ফেললাম। কিছুকাল এক অদ্ভুত আনন্দে কেটে গেল। নিজেরা সারা বৎসর ছবি তুললেও বিশেষ মুহুর্তের, বিশেষ ঘটনার ছবি আমাকে দিয়ে তুলিয়ে রাখা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না তখন। কিন্তু চিরকালের অস্থিরমতি আমি, কতকাল আর আমার উৎসাহ থাকে! আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল মায়াকানন। স্মৃতিতে রয়ে গেল অজস্র মুহূর্ত, আর কত যে ছবি – একক, যুগল, গোটা পরিবার, গোটা দল, দঙ্গল, দৃশ্য – কম্পিউটার-এর হার্ড ড্রাইভের পরতে পরতে।

ফটো তোলার এই গোলচক্করে একটা সার উপলব্ধি আমার ঘটে গেল – আমি ফটোগ্রাফার নই। ফটো তোলা আমার জন্য নয়, যেমন নয় প্রায় কোন কিছুই।

হ-য-ব-র-ল-র কাক্কেশ্বরের হিসেব মত অঙ্ক কষার শেষে হাতে থাকত পেন্সিল। কর্মজীবনের সমস্ত অঙ্কের শেষে আমার আছে এই ক্যালিডোস্কোপ। একে ঘুরিয়েই আমার দৃশ্যান্তরে যাওয়া। আপাতত তাকে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা গেল। সময়-সু্যোগ পেলে আবার নামিয়ে এনে ঘোরানো যাবে কোনদিন।

এই পর্বটিকে বলা যেতে পারে ক্যালিডোস্কোপে দেখার আগামী পর্বের প্রস্তুতি। সময়রেখায় এর অবস্থান উত্তরবঙ্গ থেকে চলে আসার পরে। ছবি আঁকার যে শখ আমার মেটেনি তা পূরণ করে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আরেক রকমের ছবি বানিয়ে – আলোকচিত্র, ফটোগ্রাফ। লেন্সের ভিতর দিয়ে মুহুর্তকে ধরে রাখা। আর এই কাজটি করতে গিয়ে এক নূতন দিগন্ত খুলে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম,…