বিস্ময় – Done
শৈশবের সম্ভবতঃ সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি – অনন্ত বিস্ময়, সহর্ষ বিস্ময়। যা কিছু করা গেল অথবা গেলনা, সব কিছুই আশ্চর্য লাগে। কিছু কিছু ভয় জাগানিয়া, বেদনার ছোঁয়া লাগা বিস্ময়ও থাকত। কম তারা। বেশীর ভাগ-ই আনন্দের, প্রিয়তার। বড় হতে হতে যাপিত জীবনের পৌনঃপুনিকতায় একদিকে বিস্ময় হয়েছে দুর্লভ, নয়ত বেদনার, অন্যদিকে একসময়ের বিস্ময়ের স্মৃতি, আনন্দের স্মৃতিগুলি ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে গেছে। শুধু কিছু বিস্ময় শত ঝড়-জলে জেগে আছে, বাতিঘরের ঘুরে চলা আলোর রেখার মত। দূর পরিক্রমার শেষে সেই রেখা ধরে ঘরে ফেরা। হয়ত।
দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি। বছর শুরু হয়েছে। শিবানী দিদিমণি আমায় ক্লাস মনিটর করে দিলেন। কোন গুণে জানি না, ১ম শ্রেণী থেকে ১ম হয়ে উঠেছিলাম, সেটা একটা কারণ হতে পারে। সকলের আদর্শ হব এই রকম একটা সরল বিশ্বাস আর কি। কারণ যাই হোক – আমি ক্লাস মনিটর। কে কখন বাথরুমে যাবে, কি থুতু ফেলতে বাইরে যাবে – আমার অনুমতি নিতে হবে। আশ্চর্য! প্রথম ক্ষমতার স্বাদ!
আমার দাম বেড়ে গেল। টিফিনের অনেক আগে থেকেই কারো কারো টিফিনের কৌটো আমার হাতে চলে আসত। প্রয়াত মিত্র সাহেবের লেখনী অনুসারে সে আমার বড় সুখের ঋতু। কিন্তু একদিন একটা অন্য ভেট জুটল। আর জীবনটা বদলে গেল।
দ্বিতীয় পিরিয়ডের শেষ দিকে হাতে হাতে ঘুরতে ঘুরতে অন্য কোন বেঞ্চে বসা কোন ছেলের কাছ থেকে তার একটা খাতা আমার কাছে চলে এল। খাতার মাঝখানে একটা পাতলা বই। সেই প্রথম গোপনীয়তার স্বাদ, সেই প্রথম গল্প বই পড়া।
চমকে গেলাম – কী আশ্চর্য যে সেই বই! এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে লাগে! এই না হলে লেখা! বাকি সারাটা দিন সব কটা ক্লাস কি ভাবে যে কাটল! দেখলাম বন্ধুদের কয়েকজনের ইতিমধ্যেই অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে, বাকিদের মধ্যে অনেকেই অধীর হয়ে আছে পড়বে বলে। তিন চারজন যোগানদার। সেই থেকে কাজের বই পড়ায়, উন্নতির জন্য প্রয়োজনের বই পড়ায় চিরকালের মত আগ্রহ ঘুচে গেল। আসল লেখা তো গল্প বইয়ে!
কিছুদিনের মধ্যেই মনিটরত্ব ঘুচে গেল। কিন্তু গল্প বই পড়ার নেশা চিরকালের জন্য জীবনে জুড়ে গেল। সেদিনের সেই বইয়ের লেখকের নাম, এ পার বাংলার আমার বয়সী সব পাঠক-ই সম্ভবতঃ জানেন – স্বপনকুমার। ডাক্তার সমরেন্দ্রনাথ পান্ডে। বড় হয়ে অনেক হাসাহাসি হয়েছে স্বপনকুমারের গল্প নিয়ে। কিন্তু সেদিনের সেই প্রথম বারের মত লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পাঠের সেই যে বিস্ময়, যে উত্তেজনা, সেটা আজও প্রায় হাতে ধরতে পারি।
কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের একটা ছোট্ট দল হয়ে গিয়েছিল। সেই দলের একজন একদিন একটা আশ্চর্য বই নিয়ে এলো। বইটার আকার-আকৃতি এখন আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, সেটা পড়বার বই নয়। সেটার পাতার পর পাতায় ছোট-বড় কত যে রঙিন ছবির সমাহার! সেই ছবিগুলো ঐ বইয়ে আটকে থাকবার নয়, সেখান থেকে বের হয়ে অন্য আরও অনেক বইয়ে, কে জানে কত কত জায়গায়, ছড়িয়ে পড়বার, ফুটে উঠবার – একটুখানি জলের ছোঁয়ায়। জলছবি।
সেদিন টিফিন-এর সময়টায় ঐ বই থেকে অনেকগুলো ছবি ছড়িয়ে গেল আমাদের বন্ধুদের বইয়ে বইয়ে। পরের বেশ কিছুদিন সেই বই তার মালিকের ব্যাগ-বাহিত হয়ে আমাদের ক্লাস ঘুরে যাওয়ার সাথে সাথে তার কলেবর ক্ষীণ হতে হতে একসময় ব্যবহারের মত আর কিছু পড়ে রইল না। ঐ ছবির বইয়ের নিশ্চয় অনেক দাম ছিল, একবার ফুরিয়ে গেলে আবার আর একটা বই পাওয়ার সম্ভাবনা কমই ছিল। যতদূর মনে পড়ে, সে ছেলেকে দ্বিতীয় বার আর ঐ রকম বই আনতে দেখিনি। কিন্তু সম্পদ ত তখন-ই সম্পদ যখন তা প্রিয়জনদের সাথে ভাগ করে নিই। অন্ততঃ আমরা তখন তাই ভাবতাম।
পরবর্তীকালে শখে এবং দরকারে, শুকনো এবং ভেজা দু’ভাবেই বিভিন্ন ছবি প্রতিস্থাপন করতে হয়েছে। কিন্তু সেই দিন সেই অপূর্ব রঙ্গিন ছবিগুলো একটু জলের ছোঁয়ায় আমার বইয়ের পাতায় যে ভাবে ফুটে উঠেছিল তা বার বার দেখতে আমার চোখ বন্ধ করতে লাগে না।
একটা মাঠ ছিলো। আমার জন্য অনেক বড়। বাবার হাত ধরে আমি সেই মাঠে যেতাম। আমার হাত ধরে আমার পরের ভাই। বাবা খবরের কাগজ নিয়ে যেত। মনোযোগী পাঠক। পছন্দসই যায়গায় বসে গিয়ে নানা কৌতুহল মেটাত এ পাতা থেকে ও পাতায় বিচরণ করে। আমার কৌতুহল মিটে যেত ঘাসে ঘাসে বিচরণে। আর, নিজের মনের গহনে ভেসে ভেসে।
মনের গহনে ভেসে ভেসে, কারণ, খুব বেশী কৌতুহল আমার ছিলো না। আর ভুলেও যেতাম। আসলে, যত জানা এসে জমা হত, তাদের গুছিয়ে তুলতে তুলতে, আবার যাতে খুঁজে পাওয়া যায় এমন ভাবে সাজিয়ে নিতে নিতে, যে জানারা ক্রমাগত খসে যেত, ঝরে যেত, তাদের খোঁজে মনের পথে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আমি ক্রমাগত হারিয়ে ফেলতাম আমার মুহূর্তগুলোকে।
যতক্ষণ পারা যায় পড়া শেষে বাবা হাতের কাগজ নামিয়ে ছড়িয়ে নিত ঘাসের উপর। তারপর কাগজে পিঠ রেখে শুয়ে পড়ত। বাবার দু’পাশে আমরা দু’ভাই। কাগজ পিঠের নীচে আমরাও শুয়ে আছি। আকাশে তখন তারারা ফুটে উঠেছে। অন্ধকার গাঢ় হত। তারার মেলা। বাবা আঙ্গুল তুলত তারাদের দিকে, ওটা কালপুরুষ। আমার বুক কেঁপে উঠত। ওটা লুব্ধক, কালপুরুষের শিকারী কুকুর। ওটা … আমার আর দেখতে ইচ্ছে করত না। বড্ড বেশী রহস্যময়, বড্ড বেশী ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমি উপুড় হয়ে যেতাম।
আস্তে, আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসত। একসময় বাবা ডাকত – বাড়ি যাবি? আমরা উঠে পড়তাম। সাঁঝবাতিরা জ্বলে উঠত রাস্তায়-রাস্তায়, বাড়িতে, দোকানে, ক্লাবঘরে, এখানে-ওখানে। কখনো কাগজের শয্যা ছেড়ে ওঠার আগেই, কখনো ঘরে ফিরতে ফিরতে দেখতাম। দেখতে দেখতে ভিতরে একটা নাড়া লাগত। কিরকম এক বেদনার মত। এক আশ্চর্য অনুভূতি! এখনও ফিরে ফিরে আসে।
রাস্তার আলোগুলোর নীচে, দোকানের আলো ঘিরে মানুষের আওয়াজ – বেচাকেনা। কারা ওরা? ওদিকে, বাড়িগুলোর জানালায় জানালায় পর্দা টাঙ্গানো। পর্দার ওপাশে আলো জ্বলছে ঘরে ঘরে। কারা থাকে ঐ সব ঘরে? কেমন লোক তারা? কি করছে এখন? গল্পের পর গল্প ভেসে আসত মনের জানালায়। এও আরেক হারিয়ে যাওয়া। হঠাৎ বাবা ডাকত – সাবধানে, রাস্তা দেখে!
একটু আগের তারা-ভরা আকাশ দেখার ভয়ার্ত বিস্ময় আর এখন নানা গল্পের আনাগোনাকে মনের ভিতরে চেপে রেখে আমি সাবধানে, রাস্তা দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরে আসি। আমার হারিয়ে যেতে ভয় লাগে।
হারিয়ে যেতে ভয় লাগে। আর, ক্রমাগত হারিয়ে চলি। নূতন জরীপ ফেলে যায় পুরাতন জনপদ। প্রতিটি আহরনে ছেড়ে এসেছি কিছু সঞ্চিত অর্জন। আয়নায় তাকালে নিজেকে চিনতে পারি না বহুকাল। মনের আয়নাতেও অচেনা হয়ে পড়ি থেকে থেকে। সামান্য কারণে নিজেকে সঁপে দিই অসামান্য রুক্ষতায়। আমার কাজের প্রতিফলনে নিজেকে দেখে চমকে উঠি। অথচ কোন উপায় নেই, এগিয়ে চলা ছাড়া। ফেলে আসা পথের চিহ্ন কাজে লাগে না, কারণ, ফেরা নেই। বাতিঘরের আলো ঘুরে যায়, ঘুরে যায়।
শৈশবের সম্ভবতঃ সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি – অনন্ত বিস্ময়, সহর্ষ বিস্ময়। যা কিছু করা গেল অথবা গেলনা, সব কিছুই আশ্চর্য লাগে। কিছু কিছু ভয় জাগানিয়া, বেদনার ছোঁয়া লাগা বিস্ময়ও থাকত। কম তারা। বেশীর ভাগ-ই আনন্দের, প্রিয়তার। বড় হতে হতে যাপিত জীবনের পৌনঃপুনিকতায় একদিকে বিস্ময় হয়েছে দুর্লভ, নয়ত বেদনার, অন্যদিকে একসময়ের বিস্ময়ের স্মৃতি, আনন্দের স্মৃতিগুলি ক্রমাগত ঝাপসা…
Recent Posts
Categories
- Blog
- Book Chapter
- featured
- অঞ্জলি
- অনুবাদ
- অনূদিত কবিতা
- অনূদিত গল্প
- আলাস্কা গ্লেসিয়ার বে
- ঈশপের গল্প
- কবিতা
- কিছুমিছু
- ক্যালিডোস্কোপ
- ক্রুজ
- গল্পপাঠ
- গুরুচন্ডালি
- ছোট গল্প
- টুকিটাকি
- দুকূল
- নীতিকথার অনুবাদ
- পাঠ প্রতিক্রিয়া
- ফটোগ্রাফি
- বইয়ের হাট
- বাছাই
- বেড়ানোর গল্প
- মৌলিক কবিতা
- রুট ৬৬ গ্রুপ পোস্ট
- রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০
- সচলায়তন
- স্মৃতিকথা