প্রথম নারীবাদীরা
গল্পঃ প্রথম নারীবাদীরা
লেখকঃ বার্নার্ডিন এভারিস্টো
*****************************
First Feminists
Written by Bernardine Evaristo
****************************
Bengali translation by Amitabha Chakrabarti
আমরা ছিলাম সেই তখন থেকেই যখন তোমরা সবে মানুষ হতে শুরু করেছিলে, তোমরা তখন জানতে না যে আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি অগণন, অসংখ্য প্রাণের ভবিষ্যৎ, আমাদের তখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত বংশাণুতে, জানতে না যে আমরা বারে বারে জন্ম দিয়ে চলব, ক্রমাগত-বিবর্তিত হওয়া আমাদেরই প্রতিরূপদের, জানতে না যে প্রত্যেক মায়ের জরায়ুতে বেড়ে ওঠা ভ্রূণের কারণ হিসেবে আমরাই ছিলাম মানব বংশাণু তহবিলের প্রতিষ্ঠাত্রী জননী
এই নিয়ে আমরা যে কতটা গর্বিত, বুঝিয়ে বলি, আমরা যখন প্রতিষ্ঠাত্রী জননীদের বার্ষিক পুনর্মিলন উৎসবে যোগ দিই, এই কথাটাই সমস্ত আলোচনায় প্রধান হয়ে ওঠে – এই যে মানুষ জাতটা আজ পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেটা আমাদেরই জন্য সম্ভব হয়েছে, দাপটের সাথে আমরা বলাবলি করি এই কথা, শুধু নিজেদের মধ্যেই বলি অবশ্য, এইটাই দুঃখের, কারণ আর কেউ ত আমাদের দেখতে পায় না, লজ্জার কথা আর কি বলব, এই যে আজকাল পূর্বপুরুষদের বংশগতি জানা নিয়ে এত মাতামাতি চলছে, কি মানে আছে এর, আমরা ত এক পায়ে খাড়া দুনিয়ার সামনে আমাদের নিজেদেরকে তুলে ধরার জন্য, সশরীরে – সময়ের সরণী বেয়ে হাত ধরাধরি করে নেচে নেচে চলে আসার জন্য, খুশীর উত্তরীয় উড়িয়ে, ইতিহাসেরও আগের সময় থেকে বিচিত্র আর অপরূপা আদর্শ পথিকৃৎ হিসেবে
সেই সুদূর অতীত থেকে আমরা হাজির ছিলাম, তোমরা যখন সবে মানুষ হতে শুরু করেছিলে, যদিও সে সময় সে কথা আমাদের জানা ছিল না মোটে, আমরা জানতাম না যে মানুষ তখন তার বিবর্তন শুরু করতে চলেছিল মানুষ হয়ে আবির্ভূত হওয়ার জন্য, এই গ্রহের স্থলভাগগুলো সমুদ্রে ভেসে একে অপরের থেকে সরে গিয়ে তারপর থিতু হয়ে নূতন করে মহাদেশ গড়ে তোলার পরে, হিমযুগে পৃথিবী চূড়ান্ত শৈত্যের কবলে চলে যাওয়ার পরে, বরফের চাদরে ধরিত্রী ঢেকে যাওয়ার পরে, বিশাল বিশাল পর্বতাকৃতির হিমশৈলরা শীতল সুনীল নিসর্গ জুড়ে মাথা ঠেলে উঠে দাঁড়াবার পরে, সমুদ্র থেকে রাশি রাশি জলভার চূড়ায় চুড়ায় জড়ো করে আর তারপর তাদের হিমায়িত করে, জলধারা ঝরিয়ে সেই জল জমা করে নীচুজলা বানানোর পরে, গভীর সমুদ্রের পাতালরাজ্যে বহু মাইল নীচে লুকিয়ে থাকা মহাদেশীয় ভূস্তরগুলিকে তুলে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার পরে, যখন বরফ গলে গিয়ে পৃথিবী আবার তার স্বরূপে ফিরে এল, এবং সাহারার হিমবাহ সমভূমির বরফ গলে গিয়ে সবুজ এবং ক্রান্তীয় তরুলতা আর দুর্ভেদ্য ঘনবর্ষণ বনানীর অজস্র ঝলমলে রং-এ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, ভরে উঠল টুসটুসে পাকা ফলে আর রকমারি বন্যপ্রাণীর সমাহারে
আমরা ছিলাম আদিমতম উপজাতি, প্রথম গোষ্ঠী, আমরাই সেই মূল প্রবর্তক, আমাদের মধ্যে যথেষ্টসংখ্যক-এর মনে সন্তানের জন্য মাতৃ-প্রবৃত্তির বিকাশ হওয়ার পরে, আমাদের শরীর থেকে যে অসম্ভব কৌতূহলের বস্তুটি নিজে নিজে ঝরে পড়েছে তাকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া থেকে বিরত হওয়ার পরে, আমাদের মধ্যে যথেষ্টজন এই বোধে পৌঁছানোর পরে যে ভাই-বোনের কিংবা জনক অথবা জননীর সাথে মিলন থেকে যে শিশুদের জন্ম হচ্ছিল, তারা পরের দু-তিন প্রজন্মের মধ্যে এমন ভয়ানক অসুখে আক্রান্ত হবে যা চারিয়ে যাবে পরবর্ত্তী বহু অনাগত প্রজন্মের পর প্রজন্মে, আমরা যখন খাবারের খোঁজে চারণ আর শিকার করতে শিখলাম, আর আবিষ্কার করে ফেললাম যে সেই পরম অজানার রাজ্যে আসলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে নূতন অদেখা ভূখণ্ডরা, যখন আমরা ধরে ফেললাম কি করে আগুন জ্বালাতে পারা যায়, পেয়ে গেলাম এক শক্তিশালী, নিজেদের বানানো উত্তাপের ব্যবস্থা, এবং যখন শিখে ফেললাম হাড় আর পাথরের ব্যবহার, আমাদের মগজ যখন আরো প্রসারিত হল, আমাদের বাহু ছোট হয়ে এল, আর আমাদের পাগুলো লম্বা হতে থাকল যতদিন না আমরা পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলাম, এবং একটু একটু করে মানবজাতির মহানিষ্ক্রমণের পথে এগিয়ে চললাম, আর অবশেষে এসে হাজির হলাম তোমাদের কাছাকাছি জায়গায় – এশিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলেশিয়া, উত্তর মেরুপ্রদেশে, ইয়োরোপে, আর হ্যাঁ, আফ্রিকার সমস্তটা জুড়ে, সেই আফ্রিকা, যেখানে আমাদের আদি বাসভূমি, যেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু
কঠিন ছিল সেই সব শুরুর দিনগুলো, প্রতিষ্ঠাত্রী জননীদের দশ বৎসরান্তিক পুনর্মিলন অনুষ্ঠানগুলোয় এইটা আমরা সবসময় একে অপরকে মনে করিয়ে দিতে চাই, একুশ শতকের সামাজিক রীতিনীতি আমরা বেশ পছন্দ করি যেমন ধরো হালফিলের মানুষদের জীবনযাত্রার অভিনয় করে চা-পান কিংবা বিস্কুট খাওয়ার অনুকরণ করা, যদিও এ দুনিয়ায় আমরা আছি যুগান্ত কাল ধরে, এক রূপে কিংবা আরেক রূপে, মনে আছে এই সেদিন বিংশ শতকের একবিংশ শতকে উত্তরণ উপলক্ষে সহস্রাব্দ উদ্যাপনের অনুষ্ঠানের ঘনঘটায়, কি হাসাহাসিই না আমরা করেছিলাম, সবাই এমন ভাব করছিলো যেন এটা একটা বিশাল কিছু ঘটনা, আদপে কিন্তু আমাদের উত্তরপুরুষরা আদৌ সেই জীবনটা কাটায়নি যেটা আমরা কাটিয়েছি
যেভাবে আমরা বেঁচেছি, বারে বারে মুখোমুখি হয়েছি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার, কখনো খাবার বা জলের অভাবে, কখনো অতিরিক্ত উত্তাপ কিংবা চরম শৈত্যের মুখোমুখি, সেই আমরা, যারা বারে বারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারতাম অবিরাম যুদ্ধগুলোয়, বিশেষ করে যখন আমাদের খাবারের রসদ ফুরিয়ে আসত, কিংবা যে ভূখণ্ড আমরা নিজেদের করে নিয়েছি সেখানে নূতন দখলদার এসে হাজির হত, অথবা আমাদের গোষ্ঠীর মধ্যে কে গোষ্ঠীর মাথা হবে সেই নিয়ে আমাদের অন্তর্দ্বন্দ মারাত্মক, প্রাণঘাতী রূপ নিত, সেই যে আমরা আবিষ্কার করলাম ক্ষমতার কি অসীম শক্তি, এটাও বুঝতে পারলাম যে ক্ষমতার অর্জন এ দুনিয়ায় টিঁকে থাকার লড়াইয়ে আমাদের কতটা এগিয়ে দিয়েছে, আর তার সাথে অনুভব করলাম – ক্ষমতার স্বাদ কতটা নেশা ধরানো
আমরা মেয়েরা সেই সব দিনে সবাই ছিলাম সামনের সারির, নেতৃত্বে দেওয়া মানুষ, টিঁকে থাকতে গেলে আমাদের সেই রকমই হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না, আমরা অতটাই ভয়ঙ্কর ছিলাম, আমাদের কষ্ট দিত এমন যে কারো সাথে আমরা টক্কর নিতে পিছপা হতাম না, সে পুরুষ হোক কি নারী, এবং বলছি তোমাদের, বিশ্বাস করো, প্রতিষ্ঠাত্রী জননীদের, মানবতার প্রথম মহিলাদের সাথে পাঙ্গা নেওয়ার কথা তোমরা চিন্তাতেও আনতে চাইবে না, কারণ আমরা ছেড়ে দেওয়ার লোক ছিলাম না, যতটা জানোয়ারসুলভ ছিলাম আমরা ততটা নির্মমতা নিয়েই আমরা পাল্টা আঘাত করতাম, মানুষ শত্রুদের কাছ থেকে আক্রমণের মুখে আমরা কখনো কান্নাকাটি করে জমি ছেড়ে দিতাম না, এবং আশা করতাম না যে আমাদের পুরুষরা আমাদের রক্ষা করবে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরাই প্রথম আক্রমণ করতাম, আমাদের ভিতরে সেই তেজ ছিল, আমাদের মধ্যে পাল্টা লড়াইয়ের আদিম শক্তি মজুত ছিল, আমাদের শারীরিক শক্তির আমরাই মালিক ছিলাম
সেই দিনগুলোয় নারীত্ব আর পৌরুষের কোন ধারণা ছিল না, মেয়েদের “ভদ্রমহিলাসুলভ” আচরণের কায়দা-কেতা স্বাভাবিক বলে গণ্য হতে তখনও বহু যুগ বাকি, আমরা, পৃথিবী গ্রহের প্রথম মানুষেরা যেখানে বেগ এসেছে সেখানেই হেগেছি, ইচ্ছেমত পেদেছি কি ঢেকুর তুলেছি, শালীনতা তখনও দূর ভবিষ্যতের কোন ধারণা, যৌন মিলনে মেতেছি যখন যেমন মন চেয়েছে, কাপড় পড়িনি কোন, এমনকি কোন পশুর ছাল কি গাছের বাকলও না, অন্তত প্রথম দিককার দিনগুলোতে নয়ই, এবং যখন আমাদের ঋতুস্রাব হয়েছে, চলার পথে রক্তের ধারা রেখে এগিয়ে গেছি
আমরা মেয়েরা পুরুষদের সমান সমান ছিলাম, শুধুমাত্র মাতৃত্বের কারণে আমাদের উচ্চাশায় শিকল পড়েছিল, যখন মাতৃত্বই আমাদের সমস্ত দায়-দায়িত্ব হয়ে উঠল, কারণ পুরুষেরা ক্ষমতার এমন মোহে পড়ল যে তারা এর সমস্তটাই নিজদের কুক্ষিগত করে ফেলতে চাইল, তার আগে কিন্তু শিশু পালনের কাজটা আমরা সবাই সমান ভাবে ভাগাভাগি করে করতাম, গোষ্ঠীর সকলে মিলেই করতাম, যদ্দিন না আমাদের মধ্যে পুরুষরা পেশীর শক্তিকে আরো বাড়িয়ে তুলল, আর লম্বায় আরও বেড়ে উঠল এবং সব ব্যাপারে ছড়ি ঘোরাতে শুরু করল, আর দাবী করল যে খাবারের খোঁজে শিকারে না গিয়ে আমরা যেন এখন থেকে আমাদের বাচ্চাদের সাথে থাকি, আমাদের পরিবারের জন্য, আমাদের গোষ্ঠীর জন্য
আমরা মেয়েরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম, আমরা কখনোই আমাদের পাল্টা লড়াই ছেড়ে দিইনি, জিতেওছিলাম কখনো কখনো আর পুরুষেরা বাধ্য হয়েছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জীবন কাটাতে, অন্য কোন সময় পুরুষেরা জিতেছে আর আমরা দিন কাটিয়েছি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, আবার এমনও হয়েছে, কেউ জেতেনি আর আমরা ছিলাম সমমাত্রিক, সেটাই ছিল আদর্শ ব্যবস্থা, আমরাই ছিলাম প্রথম সাম্যবাদী, কিন্তু সেটা কখনোই বেশীদিন টেঁকেনি, কারণ মানুষের অন্তর্নিহিত প্রভুত্বের আকাঙ্ক্ষা সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল, আমাদের মধ্যে ছিল প্রথম অধিকারসর্বস্ব উন্মাদরা, স্বৈরাচারীরা, আবেগের সুড়সুড়ি দিয়ে স্বার্থসিদ্ধিকারীরা, গার্হস্থ্য অবমাননাকারীরা – এবং আমরা নারীরা এই সব কিছু সত্ত্বেও টিঁকে গেছি, প্রাক-সভ্যতা আমাদের যত কিছু আঘাত করেছিল তার সমস্তটা সহ্য করে আমরা মেয়েরা বেঁচে থেকেছি, আমরাই ছিলাম টিঁকে থাকার লড়াইয়ের চূড়ান্ত পারদর্শী, যৎসামান্য ফলমূল খেয়েও আমরা বেঁচে থেকেছি, মানবতার সেই শুরুর দিনগুলোয়, জল ছাড়া কাটিয়ে দিয়েছি দিনের পর দিন, রুক্ষ মাটিতে ঘুম লাগিয়েছি, বেঁচেছি বিপদ মাথায় নিয়ে, বন্য জানোয়ারের সাথে লড়াই করেছি, বাঁচিয়ে রেখেছি আমাদের কচিকাঁচাদের
মানবজাতির সৌভাগ্য, আমরা আবির্ভূত হওয়ার প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগেই ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, একই গ্রহে আমাদের সহাবস্থান সম্ভব হত না, সমতল জুড়ে দুই পায়ে ঘুরে বেড়ানো আমাদের ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলো তাদের মুখরোচক খাদ্যে পরিণত হত, জীবন্ত খেয়ে ফেলত আমাদের, চিবিয়ে খেয়ে নিত কাঁচা কাঁচা
আমরা ছিলাম দুনিয়ার প্রথম নেত্রীরা, প্রথম নারীবাদী, বিবর্তনের জাঁহাবাজ খাণ্ডারনির দল, যাদের নাম কেউ নেবে না কারণ আমাদের কোন নাম ছিল না, আমরা ছিলাম নাম-গোত্রহীন, মানবজাতির এগিয়ে চলাকে সুনিশ্চিত করায় আমাদের দুনিয়াজোড়া দুর্দান্ত সাফল্যের জন্য আমাদের কাউকে কোনদিন ব্যক্তি হিসাবে কোন স্বীকৃতি দেয়া হবে না, যদিও অহংবোধের মানব সত্ত্বার একটি অংশ হয়ে ওঠার অনেক আগে আমরা জীবন কাটিয়েছিলাম, আমরা চাই আমরা যা অর্জন করেছি তার জন্য আমাদের মনে রাখো তোমরা, এবং আমাদের খারাপ লাগে যখন দেখি আমাদের অস্তিত্বকে নামিয়ে আনা হয়েছে সামান্য কয়েকটি জীবাশ্মতে, নামিয়ে আনা হয়েছে সেই সব প্রত্নতাত্ত্বিকদের অলীক কল্পনাতে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই কেমন ছিল আমাদের জীবন, কেমন করে বেঁচেছিলাম আমরা, কত বিচিত্র উপায়ে মরেছিলাম আমরা – রোগে ভুগে, ভেষজ আসেনি তখনো, ঝাড়-ফুঁকে, স্বাস্থ্যরক্ষা আর নিরাপত্তার বিধিনিষেধে, ওষুধে, হত্যায় মৃত্যু, উপজাতি-যুদ্ধে মৃত্যু, মরেছি ধর্মের নামে বলিদানে, যেদিন থেকে পূজা শুরু হয়েছে দেবদেবীদের – জীবন্ত কি নিষ্প্রাণ বস্তুর, দেখা কি অদেখা, যখন থেকে আমাদের যথেষ্ট বুদ্ধি গজিয়েছে যেই জগতে আমরা বেঁচে আছি কিংবা যা আছে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে তার মর্মোদ্ধারের আকাঙ্ক্ষার, খোঁজ পেতে সেই সব সর্বজ্ঞ শক্তির যারা আমাদের বিপদের সময় আমাদের বাঁচাতে পারবে
যুগের পর যুগ কেটে যাওয়া সময়ের বেশীর ভাগটাই আমরা সঙ্গম করেছি কোনরকম প্রেম ছাড়া, আমরা ত এর অর্থই জানতাম না, তারপরে সময়ের সাথে সাথে আমরা বিবর্তিত হয়েছি, পরস্পরের জন্য আমাদের মনে অনুভূতির বিকাশ ঘটেছে, আজকের যুগের প্রেমের ধারণা অবশ্য আমাদের এখনও মজার লাগে, যখন সাহচর্য আর পারস্পরিক সামঞ্জস্য দরকার সবচেয়ে বেশী করে, আমরা সবাই সেটা স্বীকার করি, ভালোবাসা একটা দরদী অনুভূতি কিন্তু, মানবজাতিকে যদি টিঁকে যেতে হয়, পরস্পরের সাথে মানিয়ে চলাটা আমাদের পারতেই হবে
যুগযুগান্ত আগের এই সব কথা এখন তোমাদের কাছে বলাটা অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু আমাদের জন্য আমাদের জীবন খুবই দামী ছিল, এবং এত অবহেলা পেয়েছি আমরা, এত কম বুঝেছে সবাই আমাদের, শুধু আমরাই জানি সে কথা, কখনো কখনো আমাদের, প্রতিষ্ঠাত্রী জননীদের পুনর্মিলন উৎসবে, কয়েক পাত্র জিন আর টনিকের পর পরস্পরের সাহচর্যে মন হালকা করে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার পর আমরা একদম চুপ করে যাই, ফিরে যাই আমাদের সেই ভাষা আবিষ্কারেরও আগের দিনগুলোয়, সেই যখন আমরা মানুষেরা পরস্পরের প্রতি অনেক বেশী সংবেদনশীল ছিলাম, যখন আমরা ভাবতাম যা অনুভব করতাম তার থেকে বেশী, যখন সেটাই যথেষ্ট ছিল, যখন আমাদের উচ্চারিত প্রথম শব্দগুলো ছিল কতকগুলো অসংলগ্ন ঘড়ঘড়ে আওয়াজ মাত্র, শব্দ তৈরী হতে যুগ কেটে গিয়েছিল, আর শয়ে শয়ে সহস্রাব্দ লেগে গিয়েছিল আমাদের ভাষার জন্ম দিতে, শব্দ জুড়ে জুড়ে বাক্য বানাতে, আর তারও পরে লেগেছিল বহু যুগ – লেখা আবিষ্কার করতে
কল্পনা করো এমন এক দুনিয়ার যেখানে কোন শব্দ লাগে না তোমার সাথের মানুষদের বর্ণনা দিতে, পশুপাখিদের বর্ণনা দিতে, গাছেদের, অরণ্যানীর, সমুদ্রের, একটি শিশুর বর্ণনা দিতে, কল্পনা করো এক জগতের যেখানে একটিও শব্দ লাগে না পরিবারের ধারণার জন্য, এখন আমরা সমস্ত ভাষার সমস্ত শব্দ জানি, হাজার হাজার শব্দ, আমাদের অসীম স্মৃতিভাণ্ডারগুলোয় এখন এত বিপুল জ্ঞান জমা হয়েছে, আমরাই জ্ঞান, আর যেহেতু আমাদের দূর দৃষ্টি আছে, ভবিষ্যতে কি ঘটতে চলেছে সেটা নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় থাকি, বিস্ফোরিত হওয়া তারাদের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকি এমন এক সমাজ থেকে যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি আর বিস্ময়ে ফেটে পড়ে বলে উঠি – কি হবে এই মানব জাতির? কি ভাবে এগোব আমরা?
আমরা আতঙ্কিত হয়ে আলোচনা করি যে আর বেশীদিন কাটবার আগেই মানবজাতি নিজে নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, জলশূন্য করে ফেলবে গ্রহটাকে যাতে সে আরও একবার তৃষ্ণায় মারা পড়ে, সমস্ত প্রাণী আর গাছপালা উত্তাপে শুকিয়ে যাবে, আমরা আশঙ্কা করি যে মানুষের স্বজাতির মাংস খাওয়ার দিন আবার ফিরে আসবে, ক্ষুধার্ত মানুষ যখন খাবারের অভাবে মরিয়া হয়ে উঠবে তখন এমনটা ঘটতেও পারে, আমরা আশঙ্কায় থাকি যে এমন সব নতুন অসুখ এসে হাজির হবে বিজ্ঞান যাদের নিয়ন্ত্রণ করে উঠতে পারবে না, আমরা আতঙ্কিত হয়ে থাকি যে এই সভ্যতার শেষ মহাযুদ্ধে মানুষ নিজেই নিজেকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেবে, মুছে দেবে নিজের অস্তিত্ব, সম্ভবতঃ এক বিশ্বব্যাপী সর্বগ্রাসী মহাবিধ্বংসী যুদ্ধ পাকিয়ে উঠবে সেই সব অতিআত্মম্ভরী যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে যারা মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ক্ষমতা ধরে, পুরো গ্রহটাকে শেষ করে দিতে পারে, আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি যে তথ্য-লুটেরাদের লুকোনো সংকেতের আক্রমণ একদিন ধ্বসিয়ে দেবে আমাদের পুরো সাইবার-কাঠামোটাকে যেটা ছাড়া আজকের সমাজ অচল, আসবে সেই অন্তর্জাল ভাইরাস যা শেষ পর্যন্ত পুরো দুনিয়াটার পতন ঘটিয়ে ছাড়বে, এই চেনা সভ্যতাটাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না
আমরা আশঙ্কা করি যে আমাদের যা কিছু অর্জন, যার জন্য এত যুদ্ধ করেছি, একদিন আর থাকবে না, শুধু আমরা ছাড়া, বাতাসে ঘুরে বেড়ানো এক অশরীরী উপস্থিতি, যা অতীন্দ্রিয় বোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা আজকের যুগের মানুষদের পক্ষে দেখা, শোনা বা অনুভবের অতীত এবং আমরা ভীষণ দুঃখ পাব যে আমাদের লক্ষ লক্ষ বছরের প্রচেষ্টা হয়ত একদিন ফুরিয়ে যাবে, এবং তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, অতীত দিনের মধুর স্মৃতিকে উদ্ধার করে এনে তাই দিয়ে নিজেরাই নিজেদের উৎসাহ দিতে হবে, কারণ আমাদের সেই পুরানো দিনগুলোতেই আমরা সবচেয়ে সুখী ছিলাম, যখন আমাদের বয়স অনেক কম ছিল, অনেক বেশী তীব্রভাবে বেঁচেছিলাম আমরা, আর দুনিয়ার সবকিছুই ছিল নূতন
অন্তর্জাল-এর আগের সেই দিনগুলোর কথা ভাবি আমরা, কম্পিউটার আসার আগে, আইনের আগে,
গাড়ির আগে, বিমান, বাইসাইকেল, সিকি-আধুলি, ঘোড়ায় টানা গাড়ি,
কারখানার আগে, রাজনীতির আগে, স্বত্বমূল্যর আগে, টাকাপয়সার আগে, ঘরবাড়ির আগে,
চাষবাসের আগে, শ্রমের ধারণার আগে, বিয়ের আগে, মানুষকে ক্রীতদাস বানানোর আগে,
দেশ সৃষ্টির আগে, সরকার, অবসর আর সামাজিক জীবনের আগে,
রান্না করা খাবারের আগে, পরিশীলিত বৌদ্ধিক যুক্তির আগে, বিজ্ঞানের আগে
পরিবেশ দূষণের আগে, কারিগরির আগে, শিক্ষা, নৃত্যকলা, কবিতার আগে,
আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখতে পারার আগে, নিজেদের বাইরে কিছু ভাবতে শেখার আগে
আমাদের নিজেদের গল্পগুলোকে বলতে পারার আগে,
আমাদের গানগুলো কেউ গাইবার আগে
আমরা ছিলাম
আমরা ছিলাম
আমরা ছিলাম
[প্রকাশ – গল্পপাঠ, মার্চ ১৭, ২০২১]
আমরা ছিলাম সেই তখন থেকেই যখন তোমরা সবে মানুষ হতে শুরু করেছিলে, তোমরা তখন জানতে না যে আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি অগণন, অসংখ্য প্রাণের ভবিষ্যৎ, আমাদের তখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত বংশাণুতে, জানতে না যে আমরা বারে বারে জন্ম দিয়ে চলব,
Recent Posts
Categories
- Blog
- Book Chapter
- featured
- অঞ্জলি
- অনুবাদ
- অনূদিত কবিতা
- অনূদিত গল্প
- আলাস্কা গ্লেসিয়ার বে
- ঈশপের গল্প
- কবিতা
- কিছুমিছু
- ক্যালিডোস্কোপ
- ক্রুজ
- গল্পপাঠ
- গুরুচন্ডালি
- ছোট গল্প
- টুকিটাকি
- দুকূল
- নীতিকথার অনুবাদ
- পাঠ প্রতিক্রিয়া
- ফটোগ্রাফি
- বইয়ের হাট
- বাছাই
- বেড়ানোর গল্প
- মৌলিক কবিতা
- রুট ৬৬ গ্রুপ পোস্ট
- রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০
- সচলায়তন
- স্মৃতিকথা