গ্লেসিয়ার বে – পর্ব-২

প্রথম পর্বের পাঠকের মন্তব্যের উত্তরে বলেছিলাম যে লেখার সাথে সাথে ছবি দেব। সেই জন্য প্রথম থেকেই ছবি চালু করে দিলাম।

দুটি তলা জোড়া এই আড্ডাখানার একতলায় ছোট ছোট নীচু টেবল ঘিরে বিভিন্ন নকশার সোফা। জমিয়ে আড্ডা চলছে সেখানে সারা দিন। আড্ডার জায়গার একদিকে দুটো তলা জোড়া দেয়ালের মাঝামাঝি প্রায় দেড়-তলা উঁচু পর্দা। পর্দার সামনে গান-বাজনার মঞ্চ। পর্দার উল্টোদিকের দেয়ালে অনুসন্ধান-এর দপ্তর-খানা। ঠিক তার উপরে দ্বিতীয়তলায় কাফে, ছবিতে দেখা যাচ্ছে। কাফের সামনের ঢেউ খেলান বারান্দায় কাঁচ-এর বেড়ার গায়ে পর্দার মুখোমুখি অংশে লাগান আছে সরু টেবল, রাখা আছে সারি সারি চেয়ার। কখনো পর্দায় চলেছে – মুভী, অ্যাড, জাহাজের যাত্রাপথের দৃশ্য, কোন শো-এর টুকরো। কখনো বা মঞ্চে আরভিন কি এমিলি গেয়ে চলেছে মন মাতান গান, বিগত শতকের, এই বছরের, একটার পর একটা। শ্রোতা-দর্শকদের কারো কারো হাতে পানীয় – কফি, বীয়ার কি ওয়াইন। কারো হাতে কিছুই নেই, প্রশান্ত মুখ, মুগ্ধ, নিমগ্ন। যেন কোন স্বপ্নদৃশ্য।

ছুঁচ এবং

বেড়াতে গিয়ে ছুঁচ? অই-ই-ই ত! এই তো, ক’দিন আগে কয়েক ঘর বন্ধুবান্ধব মিলে হল্লাগুল্লা হচ্ছিল। ভোর বেলায় আওয়াজ শোনা গেল, কোন একজনের হাত পুড়ে গেছে। আমার বৌ (জনাব আব্দুল্লাহ-র সাথে আমার বাতচিতের বিবরণ শুনে সে জানিয়েছে আমি যেন পড়ুয়াদের পক্ষে সহজে সহনীয় শব্দ ব্যবহার করি) বলল নিশ্চয়ই তার লোকটার-ই হাত পুড়েছে। দেখা গেল বৌ পুরোপুরি ঠিক। যদিও আমি নিজে পোড়াই নি, কিন্তু আমার আঙ্গুল-ই পুড়েছে! সেই রকম-ই।

জাহাজ ছাড়ার উৎসব সেরে ঘরে ফিরেছি। বিছানায় পায়ের দিকে একটা বড় তোয়ালে-চাদর ভাঁজ করে রাখা। তার উপর একটা রাবারের টুকরো পাতা ছিল। সেটায় লেখা ছিল যে লাগেজ ইত্যাদি বিছানায় রেখে খুলতে চাইলে এই রাবারের টুকরোটির উপর রেখে খুলুন। আইডিয়াটা দারুন লাগল। এনসিএল (Norwegian Cruise Line)-এর কথা মত কাজ করে, লাগেজ খালি করে রাবারের চাদর গুটিয়ে ক্লজেটে রেখে দিলাম। এবারে লম্বা তোয়ালে-চাদর-টা ভাঁজ করছি। পট করে আঙ্গুলে কিছু ফুটে গেল। বুঝে ওঠার আগেই হাল্কা করে খানিকটা চিরেও গেল। লাল বিন্দুরা বেড়িয়ে এল। নিওস্পোরিন ইত্যাদি সঙ্গেই ছিল। আঙ্গুলের ব্যবস্থা নিলাম। এবারে সাবধানে ভাঁজ খুলে তোয়ালে-চাদর ছড়িয়ে দিলাম। দেখি, এক জায়গায় সেলাই মেশিনের ছুঁচের এক ভাঙ্গা টুকরো। এখন প্রথম কাজ হল এই স্মৃতিকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা। নিয়ে নিলাম ছবি। তারপর ফোন করলাম। চলে এল এক শ্রীমান। আমাদের ঘর যে ব্লকটিতে সেই ব্লক-এর ঘরগুলির দায়িত্ব তার। সমস্ত শোনার পর করুণ মুখ করে জানাল যে তাকে এর ফলে বিস্তর ঝামেলায় পড়তে হবে। ফোন করে সে ডেকে আনল তার সুপারভাইজারকে।

সুপারভাইজার কি আর এমনি, এমনি! নানা কথার ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে সে ছুঁচের টুকরোটা হাত করে ফেলল। বিনিময়ে আমায় বিনা খরচে সবরকম চিকিৎসা দিতে চাইল। বললাম, আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা আমিই করে নিয়েছি। চিন্তার কিছু নেই। তবে আমার লেখালেখির ব্যাপার আছে। ঘরে ফেরার পর পুরো ঘটনাটা আমার ব্লগে লিখব। সুপারভাইজারের অবস্থা দেখে মায়া হতে লাগল। বারে বারে জিজ্ঞেস করতে থাকল আমার জন্য কি করতে পারে। কি চাইব আমি! শেষে একটা সৌজন্যমূলক সূত্র মিলল – মদ্য অতি উত্তম বস্তু। পরদিন ডিনার শেষে ঘরে ফিরে দেখি – একটি নধর মার্লোর বোতল, Wine of Chile. বাঃ, বাঃ, বাঃ! এদিকে, আমার আঙ্গুল-ও অনেক সেরে গেছে। কারোই বিশেষ ঝামেলা না হয়ে ভালভাবেই মিটল সব! তবে ফিরে আসার কদিন পরে সেই হল্লাগুল্লার দিন নানা বিষয়ে অভিজ্ঞ কেউ কেউ বললেন, আমি নিতান্ত অল্পেই ছেড়ে দিয়েছি। ঠিকমত দরাদরি করলে আমার পুরো ভ্রমণের খরচটাই হয়ত তুলে নিতে পারতাম। কে জানে, হবেও বা। আমি এতেই খুশী। ইচ্ছে করে তো আর করে নি। পুরো যাত্রা-জুড়ে এই কোম্পানীর যে যত্ন, আন্তরিকতা, যাত্রী নিরাপত্তা আর সচেতনতার আয়োজন দেখেছি, উপভোগ করেছি, তা অসাধারণ। ভাঙ্গা ছূঁচের উপস্থিতি আমাদের কাছে নিতান্তই এক দুর্ঘটনা বলে মনে হয়েছে।

এই যে সেই বোতলের ছবি।

তিমি

সিয়াটল থেকে ছাড়ার পর পার্ল ছুটে চলেছে একটানা। দু’রাত কেটে গেছে। বিস্তর খেয়ে, ‘শো’ দেখে দিন কাটছে ঘোরের মধ্যে। ম্যাকবুক খুলে রাখা আছে কফি টেবল-এ। মাঝে, মাঝে সেখানে লিখে রাখছি কিছু। মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছি – ক্যামেরা নিয়ে বা না নিয়ে। আমাদের প্রথম থামার কথা আলাস্কার রাজধানী জুনোতে, আজকে অর্থাৎ তৃতীয় দিন বিকেলে। সেখানে ডাঙ্গায় নেমে তারপরে শত খানেক কি দেড়েক লোক ধরে এমন কোন কুচো-জাহাজ তথা লঞ্চ-এ চেপে humpback whale দেখতে যাব। এখন সকালে তারই প্রস্তুতি চলছে। নিকন ডি ৩০০ তৈয়ার রহে। আইফোন ৫ সঙ্গে থাকছে, তবে বিশেষ কাজে দেবে না মনে হয়।

খানিকক্ষণ আগে মাথায় বরফের আস্তরওয়ালা এক পাহাড়চূড়ার ছবি নিয়েছি। আবার আকাশে পরিস্কার চাঁদ দেখা যাচ্ছিল বলে তার ছবিও নিয়ে নিয়েছি। আর দু-এক মিনিট, তার পরেই ঘর থেকে বের হয়ে বারো তলায় চলে যাব, সময় থাকতে থাকতে লাঞ্চ খেয়ে নিতে হবে। হঠাৎ ঘরের ছাদের স্পীকার থেকে বার্তা ভেসে এল যে এক তিমি পরিবারকে দেখা যাচ্ছে। আমাদের জাহাজের পাশ দিয়ে চলে যাবে এক্ষুণি। অ্যাঁ? কোন পাশ দিয়ে? উত্তেজনায় সেটাই খেয়াল করা হল না!। তাতে অবশ্য অসুবিধা নেই। যিনি শোনার ঠিক শুনে নিয়েছেন। আমাদের-ই পাশ দিয়ে। বললেন, “বারান্দায়, তাড়াতাড়ি।” ঝটপট দরজা খুলে টেলি বাগিয়ে বারান্দায়। আসছেন তারা, এসে গেলেন, জল ছুড়তে ছুড়তে জাহাজ পেরিয়ে আমাদের গন্তব্যের বিপরীতে চলে গেলেন। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। ক্যামেরায় কিছুই ধরতে পারলাম না। স্মৃতির সহায়ক হিসেবে কাজ করবে, এই আর কি!

বরফের চাদর মাথায় পাহাড়

বারান্দা থেকে দেখা তিমির জল ছোঁড়ার দৃশ্য

জাহাজ তীরে ভিড়ল একসময়। ডাঙ্গায় নেমে আমরা বাসে চেপে গেলাম রাজধানী জুনোর আরেক প্রান্তের এক জেটীতে। পথে ড্রাইভার তথা গাইড দিদি, লিন্ডা নানা গল্প করলেন। মজা লাগল যে অজস্র কথার মধ্যেও কিছুতেই মুখে আনলেন না রাজ্যের প্রাক্তন গভর্নরের নাম – যাত্রীদের মধ্য থেকে উৎসাহ আসা সত্বেও। নরম-সরম দেখতে মানুষটি নিজের অবস্থানে দৃঢ়তা বজায় রাখায় এবং পেশাদারীত্বে মুগ্ধ করে রাখলেন।

সেইন্ট গ্রেগরী নামের দু’তলা লঞ্চের উপরের তলায় গিয়ে দেখি ডেকের ধারগুলো সব দখল হয়ে গেছে। কোনরকমে যেখানে দাঁড়াতে পারলাম সেখানে সামনেই মাইক। ফলে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। উপায় নেই। তরুণী ক্যাপ্টেন অ্যাঞ্জি ছুটে চলেছে তার জলযান নিয়ে, সঙ্গে ধারাবিবরণী। একটু পরে ধারাবিবরণীর দায়িত্ব নিল আর এক তরুণী – পরিবেশবিদ এমিলি। এই বাচ্চা মেয়েগুলির প্রাণবন্ত সাহসী কাজ দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। সভ্যতার এমন একটা সময়ে, পৃথিবীর এমন একটা অংশে জীবনটা কাটাতে পারার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে হল। (আর একটা দুনিয়ায় এই সময়েই মেয়েদের খোলসে মুড়ে, গেরস্থালীর অন্দরে, অশিক্ষা-নামমাত্র শিক্ষার অন্ধকূপে পুরে রাখার নিরন্তর প্রয়াস চলছে!)

কিন্তু তিমি কোথায়? এই লঞ্চের এরা পরিবেশ সচেতনতার কারণে তিমি খোঁজার জন্য ‘sonar’-এর সাহায্য নেয় না । ফলে, ভরসা – সমবেত যাত্রীদের সজাগ, সতর্ক নজর। হঠাৎ আওয়াজ উঠল তিমিদের কাউকে দেখা যাচ্ছে – যেদিকে দাঁড়িয়ে আছি, তার উল্টো দিকে। হুড়মুড় করে সব সেদিকে গিয়ে ভিড়লাম। এবারে আমি তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে। ভালভাবে দেখতে পাওয়ার জন্য বাঁ পা নেমে-যাওয়া-সিঁড়িতে ডান পা ডেক-এ রেখে দাঁড়ালাম। এতে করে আমার বাঁ দিকটা পুরো ফাঁকা পাওয়া গেল। ক্যামেরার ওজন রাখলাম রেলিং-এ। ফলে যেদিকে খুশী ক্যামেরা ঘোরাই, কাঁপাকাঁপির গপ্প রইল না। ‘কিট লেন্স’, আহামরি ছবি হবে না। সে আর কি করা যাবে! কিছু তো হবে! লেন্স ঘুরে লম্বা হল – ২০০ মি মি টেলি এখন। শাটার লাগাতার ‘মোড’-এ দেওয়া ছিল। আসছে, আসছে। হুস্-স্-স্। জল ছোঁড়া থেকে বোঝা গেল তিমির অবস্থান। শুরু হয়ে গেল – ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক।

জল ছুঁড়ছে

অনেকটা দেখা গেল একজনকে

কিন্তু ঐ পর্যন্তই। না লাফিয়ে জল ছেড়ে উঠল, না লেজ তুলে জলে ডুব দিল। কি আর করা যাবে! আমি মাঝে মাঝে লঞ্চের পিছনে ভয়ংকর গর্জন করে ছুটে আসতে থাকা শজারুর পিঠের মত দেখতে ফেনার স্তুপ-এর ছবি নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। এই লঞ্চটা একটা jet driven catamaran। দু’খানা সমান্তরাল জলের জেট বেরিয়ে এসে V-এর আকারে তীব্র গতির ঢেউ বানাচ্ছে। দুই V-এর ভিতরের বাহুরা পরস্পরে প্রবল সংঘর্ষ সৃষ্টি করছে। তার ফলে তৈরী হচ্ছে ঐ জল-দানব।

ইতিমধ্যে এমিলি জানাল যে টাকমাথা ঈগল দেখা যাচ্ছে। আমি দেখতে পাওয়ার আগেই লঞ্চ এগিয়ে গেল। ঈগল দেখা হল না। ক্রমে নজরে এল সীল-দের দ্বীপ। কাতারে কাতারে সীল। বাতাসে তাদের তীব্র কটু গন্ধ। কেউ রোদ পোহাচ্ছে, কেউ জলে ঝাঁপাচ্ছে। আর, মুষকো মুষকো একদল পরস্পরের উদ্দেশ্যে তারস্বরে এলাকার দখলদারি ঘোষণা করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সেগুলি গলা উঁচু করে পেট ঘষটাতে ঘষটাতে একে অন্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার পর সংঘর্ষ লাগে লাগে অবস্থায় গতি থামিয়ে চিৎকার চালিয়ে যাচ্ছে। দেখে হাসি পেয়ে গেল। দু’পায়েই হাঁটো, কি পেট ঘষটিয়ে, আদিম স্বভাব জারি-ই আছে। এমিলির ধারাবিবরণী থেকে মনে হল লড়ুয়েরা বেশীরভাগ-ই পুরুষ সীল। বিচিত্র কি! খানিকক্ষণ দেখা হল সীলদের হৈ চৈ। লঞ্চ আর এগোবে না। একসময় মুখ ঘুরিয়ে সীল দ্বীপ পিছনে ফেলে ফিরিয়ে নিয়ে চলল আমাদের। হঠাৎ – নাঃ তার আগে সীল-দ্বীপের ছবি দেখে নি-ই!

সীল দ্বীপে

সীল দ্বীপ পিছনে ফেলে ফিরে চলেছি আমরা

যে কথা বলছিলাম। হঠাৎ আওয়াজ উঠল, আবার তিমি দেখা যাচ্ছে। এবারে আমার অবস্থা করুণ – কোন দিক দিয়েই রেলিং-এর কাছে পৌঁছান গেল না। কি আর করা যাবে, দু’একজন সহৃদয় সহযাত্রী-যাত্রিণী একটু সরে আমায় একটু জায়গা বার করে দিলেন। খুব-ই টলটলায়মান অবস্থায় ক্যামেরা চলতে রইল। এবারেও তিমিরা কেউ জলের উপর লাফিয়ে উঠল না। কিন্তু অন্য কাজটা করল। লেজ তুলে জলে ডুব দিল। কয়েকবার। ফলে সেই স্বপ্নের ছবিরা ধরা পড়লো আমার ক্যামেরায় একটার পর একটা।

(উপরের ছবি ‘ক্রপ’ করে)

তিমি দেখা শেষে আমরা আবার ফিরে এলাম পার্ল-এ।

পরের দিন জাহাজ থামল স্ক্যাগওয়েতে। বৃষ্টি-ভেজা ছায়া-ছায়া সকাল। অনেকে এখানে তীরে নেমে ট্রেনে করে ঘুরে এলেন একসময়ে সোনার সন্ধানে আসা মানুষগুলোর অভিযান-পথ ধরে। আমরা আর তীরে নামিনি। বেশী ধকল সইবে না। দুজনে সমস্ত মন সংহত করে রেখেছি এই ভ্রমণ-এর চূড়ান্ত আকর্ষণ-এর উদ্দেশ্যে – হিমবাহ, গ্লেসিয়ার।

আগামী পর্বে সমাপ্য।

প্রথম পর্বের পাঠকের মন্তব্যের উত্তরে বলেছিলাম যে লেখার সাথে সাথে ছবি দেব। সেই জন্য প্রথম থেকেই ছবি চালু করে দিলাম। দুটি তলা জোড়া এই আড্ডাখানার একতলায় ছোট ছোট নীচু টেবল ঘিরে বিভিন্ন নকশার সোফা। জমিয়ে আড্ডা চলছে সেখানে সারা দিন। আড্ডার জায়গার একদিকে দুটো তলা জোড়া দেয়ালের মাঝামাঝি প্রায় দেড়-তলা উঁচু পর্দা। পর্দার সামনে গান-বাজনার…