গ্লেসিয়ার বে – পর্ব-৩
[প্রথম পর্বে লেখার শেষে এক সাথে সব ছবি দেওয়ায় পাঠকের আপত্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্বে তাই ছবি দিয়েই শুরু করেছিলাম। কিন্তু কারো কারো তাতে আপত্তি হয়েছিল। এবং মত এসেছিল যে ছবির সাথে ক্রম-সংখ্যা যোগ করে দিলে ভালো হয়। যথাসাধ্য চাহিদা মেটালাম][আগের পর্বে লেখার সাথে সাথে ছবি দিয়েছিলাম। কিন্তু আর একজন চেয়েছিলেন লেখা প্রথমে, ছবি শেষে। এবারে তাই থোকায় থোকায় দিলাম]।
মেঘ-মাখান সকাল
জান-এ-মন যেদিন বিবিজান হতে রাজী হলেন সেদিন থেকেই নিজের সৌভাগ্যে আমার প্রবল আস্থা। পরবর্তীতে বহুবার বহু কিসিমের আছাড় খেলেও এই আস্থার ঝান্ডা আজও উঁচু করে রেখেছি। গ্লেসিয়ার বে অভিমুখে নরওয়েজিয়ান ক্রুজ লাইন জাহাজ কোম্পানীর এ বছরের শেষ ক্রুজের সওয়ারী আমরা। আবহাওয়ার ভবিষ্যৎ-বাণী প্রচুর হতাশার কথা বলে রেখেছে। কিন্তু, ঐ যে, আমার আস্থা! আবারো পয়সা উশুল! জাহাজে ওঠার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত বৃষ্টি নামেনি! আবার, তিমি দেখার দিনেও সূর্যের আলোর কোন কৃপণতা ঘটে নি! কিন্তু গ্লেসিয়ার বে!
আজ যে অন্য রকম সেজে আছে চারদিক! তাই হোক, তবে তাই হোক। এই সাজ-ও তো অসাধারণ! জলের বুক থেকে কুয়াশা উঠে আকাশের মেঘে মেশামেশি। ছায়া ছায়া চরাচরে সীমারেখারা ঝাপসা, মুছে মুছে গেছে এখানে ওখানে। জাহাজ ছুটছে স্থির গতিতে। মেঘ আর কুয়াশার মাঝে মাঝে জাদু-আলো। সেখানে ফুটে আছে উপত্যকারা, নানা পরতের সবুজ মেখে। বিষ্ময়ে বসে থাকি চুপ করে – এ কোন দুনিয়া, এ কোন মায়া! এক সময় চেতনা ফেরে। ক্যামেরা তুলে নিই। ঘরের ভিতর থেকেই যতটুকু পারি ধরে রাখি সেই আশ্চর্য অপরূপকে। এদিকে আস্তে আস্তে আলো ফুটতে থাকে। আকাশ পরিস্কার ঝকঝকে হয়ে আসে।
(১)
(২)
হিমবাহ।
হিম। বরফের স্তুপ। সেই স্তুপ স্তুপ বরফের প্রবাহ। জমে হিম হয়ে গেছে নদী। কিন্তু থেমে নেই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে চলেছে আপন ওজনের ভারে। শীত-গ্রীষ্মে বরফের পরিমাণ বাড়ে-কমে। আবার, বরফের গভীরতার সাথে সাথে তার ঘনত্ব, শীতলতা পাল্টায়। এমন-ও হয় – উপরে বরফ, নীচে তখনো বরফ না হওয়া হিমশীতল জল। সেই জল ঢুকে যাচ্ছে নদীর তলদেশের পাথুরে বুকের নানা আনাচে-কানাচে, ফাঁকে-ফোকরে। তীব্র শীতের সময় খাঁজে খাঁজে ঢুকে থাকা সেই জল জমে বরফ হচ্ছে, আয়তন বেড়ে যাচ্ছে তার। প্রবল চাপ পড়ছে অগুন্তি খাঁজ-এর পাথুরে দেয়ালে। একসময় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে নদীর বুকের নরম পাথরের চাদর। বরফের প্রবাহ ঘষটে টেনে নিয়ে চলে সেই চাদরের গুঁড়ো। কোন হিমবাহের সব বরফ হয়ত এক সময় গলে গেছে, তারপর সব জল উড়ে গেছে বাষ্প হয়ে; নদী যেখানে একসময় ঝাঁপিয়ে পড়ত অনেক নীচে, সেখানে খাড়াই পাথরের এবড়ো-খেবড়ো গা হিমবাহের শত শত বছরের ঘষায় ঘষায় আজ মসৃণ, সুডৌল। কেমন লাগবে দেখতে সেই পেলব সৌন্দর্য! ক্যামেরায় কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।
গন্তব্য – জন্স হপকিন্স হিমবাহ
হিমের প্রবাহ এগিয়ে চলেছে। শতাব্দী পার হয়ে যাচ্ছে। কিছু বরফ গলে যাচ্ছে, কিছু বাষ্প জমে জল হয়ে আবার বরফ হয়ে যাচ্ছে। যে প্রবাহে জমার ভাগ কম তা আস্তে আস্তে আকারে ছোট হয়ে যাচ্ছে। উষ্ণায়নের প্রভাবে বেশীর ভাগ হিমবাহ-র এই পরিণতিই ঘটছে। কিন্তু প্রকৃতি অদ্ভুত। গতিপথ পাল্টে কোন হিমবাহ, শুরু যার ভীষণ শীতের রাজ্যে, ঝাঁপিয়ে পড়ল এসে আর এক হিমবাহের কোলে। মিলিত হিমবাহের বাষ্প হওয়ার থেকে বরফ হওয়ার পরিমাণ বেশী হয়ে গেল। আমরা তখন পেয়ে গেলাম এমন এক হিমবাহ যা উষ্ণায়নের মুখে তুড়ি মেরে বাড়তে থাকল বছরের পর বছর। এমনই এক হিমবাহ দেখতে চলেছি আমরা – জন্স হপকিন্স হিমবাহ। পশ্চিমা পৃথিবীর ভূপদার্থবিদ্যার জনক হিসেবে স্বীকৃত বিজ্ঞানী হ্যারি ফিল্ডিং রীড আবিষ্কার করেছিলেন এই হিমবাহ। তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল এই নামের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টি। গন্তব্যের কাছেই রীডের নিজের নামে নামাঙ্কিত হিমবাহটিকেও দেখার সৌভাগ্য হয়ে গিয়েছিল।
আহা! আহা!
জন্স হপকিন্স হিমবাহর সামনে পৌঁছে জাহাজ দাঁড়িয়ে গেল। সে দৃশ্য দেখার। উপভোগ করার। অভিভূত হওয়ার। তাকে বর্ণনা করার মত ভাষা আমার কোথায়? জাহাজের চারপাশ দিয়ে যে জল বয়ে চলেছে সেটা বরফে ভরা। জলের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন এক গ্লাস বরফজলে একটা পিঁপড়ে সাঁতার কাটছে। সামনে পাহাড়ের উপরে এই জলের উৎস যে বিশাল নদী সে জমে বরফ হয়ে আছে। তার ঢেউরা জমে আছে। কিন্তু বরফ যেখানে জলে মিশেছে সেখানে সে গলে জল হচ্ছে। সেখানে বরফে অনেক ফাটল। মাঝে মাঝে বরফের চাঙ্গর ভেঙ্গেও পড়ছে। আমাদের জাহাজ অবশ্য মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে আছে নিরাপদ দূরত্বে। আমি থেকে থেকে নিকন ডি৩০০-এর শাটার টিপে চলেছি। মন ভরছে না যদিও। বিশালত্বকে ধরা যাচ্ছে না। একসময় জাহাজ ঘুরতে শুরু করল, ধীরগতিতে। আমরা সবচেয়ে উঁচু তলার কাঁচের দেয়াল ঘেরা লাউঞ্জে উঠে গেলাম। এটা জাহাজের একেবারে সামনের দিকে। জাহাজ ঘুরছে একটু একটু করে। আমরা একতলা নেমে নীচের খোলা ডেকে চলে এলাম। ছবি তুললাম, গ্লেসিয়ারের, জাহাজের, আমাদের। সহৃদয় একজন আমাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে নিজেই যেচে তুলে দিলেন যুগলবন্দী। হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে বরফ ভেঙ্গে পড়ার বিরাট আওয়াজ, calving বলে যাকে। একটু একটু করে একসময় ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে জাহাজ একেবারে উল্টো মুখো হয়ে দাঁড়াল। এর পর ফিরে যাওয়ার পালা। আমরা কাফেতে গিয়ে বসলাম। বৌ চা নিল, আমি কফি। কয়েকটা চুমুক দিয়ে সেই ডেকের পিছনের কাফেতে চলে গেলাম। খোলা আকাশের নীচে সামনে হিমবাহ। হঠাৎ-ই মনে হল এই ত আইফোন-এর সময়। রেলিং-এ ভর রেখে প্যানোরামা শট নিতে থাকলাম একটার পর একটা। জাহাজ চলতে শুরু করেছে। একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল সেই অবর্ণনীয় সৌন্দর্য – হিমবাহ। ধরা রইল কিছু সাধারণ ছবি – ক্যামেরায়, সকলের সাথে ভাগ করে নিতে; অজস্র অসাধারণ ছবি মস্তিস্কের ধূসর নিউরনে নিউরনে, একান্ত নির্জনে, সখী, নিরজনে।
(৩) হিমবাহের ঘষায় ঘষায় মসৃণ হয়ে গেছে পাহাড়ের গা। দেখাচ্ছে যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর বিশাল থাবা।
(৪) বারান্দা থেকে হিমবাহ দর্শন। ভেঙ্গে পড়েছে এক চাঙ্গড়। এই হিমবাহটি সম্ভবতঃ ছিল রীড হিমবাহ।
(৫) রীড হিমবাহ। বরফ গলে গুহার মত দেখাচ্ছে।
(৬) জন্স হপকিন্স হিমবাহ নেমে এসেছে পাহাড় চূড়া থেকে।
(৭)
(৮)
(৯)
(১০)
(১১) জাহাজের সর্বোচ্চ ডেক থেকে জন্স হপকিন্স হিমবাহ দর্শন।
(১২) খোলা ডেক থেকে
(১৩)
(১৪) ভাঙ্গনের প্রস্তুতি
(১৫)
(১৬)
(১৭)
(১৮)
(১৯)
(২০) ঘন বরফ-জলের মাঝে
(২১)
(২২) এক উৎসাহী, সহৃদয় সহযাত্রীর সহায়তায়
(২৩) কিছু ছায়া, কিছু মায়া
(২৪) সমস্ত আশ্চর্যই একসময় পিছনে পড়ে থাকে।
(২৫)
মনে পড়ে
আমাদের তরণীবাসের দিনগুলো এখন আশ্চর্য স্মৃতির মত। ঐ দিনগুলোয় সব চেয়ে যা আমাদের আনন্দের লেগেছিল তা হল কোন তাড়া না থাকা। কোন চাপ না থাকা। সাজ-সজ্জা নিয়ে কোন কড়াকড়ি নেই। কেউ কারো দিকে তাকিয়ে বসে থাকছে না। গরমপানির পাত্রে বসে তাপ নিতে নিতে খিদে পেয়ে গেছে এক সুন্দরীর। স্নান-পোষাকের উপর কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে কাফেতে এসে ঘুরে ঘুরে খাবার নিয়ে ফিরে গেছেন পানিপাত্রে। তা দেখে যদি কোনো পুরুষের কোন লালা ঝরে থাকে সমস্যা ঐ তেঁতুল-সর্বস্ব দর্শকের। সেই রমণীর নয়। কেউ তাঁকে ঠুসে দেয় নি কোন বস্তায়।
কোন সন্ধ্যায় ডিনার বাদ দেওয়ায় মাঝরাতে খুম ভেঙ্গে খিদে খিদে – চলে আসি কাফেতে। খাদ্য, পানীয় সদা অফুরান। কিংবা, এক ভোরে আর কাফেতে যেতে ইচ্ছে করছে না। অসুবিধা কিছু নেই। একটি ফোন। ঘরেই হাজির প্রাতরাশ। ফুট চারেক উচ্চতার কাঁচের দেয়াল ঘেরা বারান্দা। বারন্দার এপাশে পুরোটাই কাঁচের দেয়াল। দেয়ালের এ পাশে সোফা। গরম কফি। আঃ! প্রণালী বেয়ে জাহাজ এগিয়ে চলেছে স্থির গতিতে। জলের ও পাশে ডাঙ্গা সরে যাচ্ছে পিছনে। যেন কোন চলচ্চিত্রের দৃশ্য। মাঝে মাঝে চটকা ভেঙ্গে খেয়াল পড়ে আমি নিজেও এই চলচ্চিত্রের অংশ। এক দিন গিন্নী বললেন কাল বাফে হয়েছে। আজ এ বেলা অন্য রকম হোক। চলো তবে অন্য কাফেতে। ওয়েটার নিয়ে গিয়ে জায়গায় বসাল। মেনু দেখে ‘স্টার্টার-অন্ত্রে-ডেজার্ট, ফুল-কোর্স’ খানা-পিনা। স্বাদে, সুরতে ও আপ্যায়নে মন তর হয়ে গেল। দাম? সে তো টিকিট-এর মধ্যেই ধরা আছে, টিপ্স/গ্রাচুইটি সুদ্ধ। এবার তবে চলো ‘শো’ দেখতে যাই। পথে বাফে থেকে এক গ্লাস নরম পানীয় সঙ্গে নিয়ে নেব।
(২৬) ঘরে বসে প্রাতরাশ
(২৭) চকলেট বাফের রাতে
এবং এলভিস প্রিস্টলী
তিনটি মঞ্চ। একটি ‘হাই-টেক’ কারিকুরিওয়ালা পর্দা-টানা সুবিশাল নাট্যমঞ্চ। একটি নাচের ‘ফ্লোর’, আর তৃতীয়টিও ‘ফ্লোর’ – সবরকম অনুষ্ঠানের। এই শেষেরটি সর্বোচ্চ তলায় জাহাজের একেবারে সামনে, তিনকোনা লাউঞ্জে। দুপাশের দেয়াল কাঁচের। সেখানে পর্দা উঠিয়ে নামিয়ে বাইরের আলোর প্রবেশের উপর জারী আছে অনায়াস নিয়ন্ত্রণ। পিছনের দেয়ালের সামনে সুদৃশ্য বার। কঠিন পানীয়ের বাহার। নরম পানীয়ের দাম দিতে লাগে না, কিন্তু কঠিন পানীয়ের দাম একটু বেশীই দিতে হবে। লাউঞ্জের একেবারে সামনের জায়গাটিতে গাইয়ে বাজিয়েদের জন্য ছোট্ট ঘরমত এলাকা করা আছে। তার সামনে রকমারী আলোর বাহার নিয়ে গোল মঞ্চ। মঞ্চটি ঘিরে হরেক কিসিমের, নানা আকার, আয়তন আর স্টাইলের বসার এমন কি শুয়ে শুয়ে অনুষ্ঠান দেখার বন্দোবস্ত! জাহাজের ডিরেক্টর পেড্রো সেরার নেতৃত্বে তিন মঞ্চে নানা সময়ে নানা ‘শো’ – ফাটাফাটি কমেডি, অবিশ্বাস্য জাগলারী। বিদেশী ভাষার বাধা অনায়াসে ছুঁড়ে ফেলে হৃদয় আকুল করা গান। রক্তে তুফান তোলা অসাধারণ দক্ষতার নাচ। আর, যে কোন আসনে বসার অধিকার যে আগে এসেছে তার।
যাত্রা শুরুর সময় কমেডি ডিরেক্টর কথায় কথায় জানিয়েছিলেন যে জাহাজে কোথাও এলভিস-কে দেখা গেছে বলে তারা শুনেছেন। তার জোরদার সন্ধান চলছে। ট্রিপ শেষ হবার আগেই সত্যি-মিথ্যে জানা হয়ে যাবে। জানা হলও। কয়েকদিন বাদে।
ঐ তৃতীয় মঞ্চে সেই সন্ধ্যায় শো শুরু হয়ে গেছে। কঠিন পানীয়ের অর্ডার নিতে ওয়েটার ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। অনেকেই অর্ডার দিয়েছে, দিচ্ছে। নরম পানীয় নিয়েও বসেছে কেউ কেউ। ঘর প্রায় ভর্তি। নজরে এল দ্বিতীয় সারিতে ছ’জন বসার এক টেবল ঘিরে তখনো কয়েকটি চেয়ার ফাঁকা আছে। বসে থাকা একজনের অনুমতি নিয়ে আমরা দু’জন পাশের দুটি আসনে বসে গেলাম । নরম পানীয় নিয়ে এসেছি সাথে করে। দেখলাম আসনের অবস্থান অনুসারে গোটা ঘরের দর্শকদের এগার-বারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মঞ্চে কিছু একটা খেলা-খেলা প্রতিযোগীতা চলছে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে এক তরুণী। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টার বেভার্লি। তার নির্দেশ অনুসারে একেক ভাগের লোকেরা একেক সময় হৈ হৈ করে একেক জন প্রতিযোগীকে সমর্থন জানাচ্ছে। আমরাও হৈ হৈ করে গেলাম আমাদের ভাগের দর্শকদের সাথে সাথে। খেলা একসময় শেষ হল।
এবার ঘোষণা হল এলভিস প্রিস্টলীর খোঁজ পাওয়া গেছে। বেভার্লীর এক চ্যালা মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে এল। দর্শকদের মধ্য থেকে একজনকে ডেকে মঞ্চের মাঝখানে নিয়ে গেল। তাকে নানা প্রশ্ন করা শুরু করল। সে নাকি তিনজন সম্ভাব্য এলভিসের একজন। অন্য দুজনের এখনো খোঁজ চলছে। তিনজনকেই পাওয়া গেলে তাদের মধ্যে প্রতিযোগীতায় ঠিক হবে কে আসল এলভিস। এতক্ষণে বুঝলাম মজাটা। একসময় দ্বিতীয় জনকেও পাওয়া গেল। হঠাৎ দেখি এক চ্যালা সোজা আমার আসনের সামনে এসে আমায় দেখিয়ে ঘোষণা দিল যে আমি-ই তৃতীয় জন, আমায় উঠতে হবে।
আমাকে নিয়ে যাওয়া হল পাশের একটা ঘরে। সেখানে আমায় পরানো হল এলভিস সাজার পরচুলা, জামা-প্যান্ট একসাথে জোড়া পোষাক – আমার থেকে অন্তত এক ফুট লম্বা। একসময় মঞ্চে প্রবেশ ঘটল আমার। অন্য দুজনের পালা তখন শেষ হয়ে গেছে। এলভিসের মত করে কি কি সব যেন করলাম। শেষে নাচ। উদ্দাম। নাচ শেষ হলে বেভার্লি আমার ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল যে এই ভুঁড়ি এলভিসের বলে বিশ্বাস হচ্ছে না, তবে চূড়ান্ত বিচার দর্শকদের হাতে। ইতিমধ্যে আমি এলভিসের রমণীকে খুঁজে বের করতে পারি। সিন্ডারেলার পায়ের জুতোর মত সেই নারী তাঁর বক্ষবন্ধনী ফেলে গেছেন। এই বলে বিশাল আকারের এক অন্তর্বাস আমার সামনে ঝুলিয়ে ধরল। চারপাশে হাসির হুল্লোড়। একসময় দর্শকরা প্রথমজনকেই এলভিস বলে ঘোষণা দিল। আমি ফিরে এলাম সান্ত্বনা পুরস্কার নিয়ে – একটি জলের ফ্লাস্ক, প্লাস্টিকের। এর পর থেকে আমার নাচের ইচ্ছে চলে গেছে। গিন্নী খুশী, আমি আর যত্র তত্র বেতাল নাচানাচি করে তার বিড়ম্বনা ঘটাচ্ছি না।
(২৮) স্পিনাকার লাউঞ্জ। এখানেই এলভিস প্রিস্টলীর খোঁজাখুঁজি ঘটেছিল।
(২৯) কতরকমের বসার এমন কি শুয়ে শুয়ে শো দেখার ব্যবস্থা যে আছে সেখানে!
(৩০)
(৩১)
(৩২)
সেই মানুষেরা
আমাদের ক্রুজের দিনগুলো নিশ্চিন্ততায় ভরপুর ছিল। পেশাদারী দক্ষতায় জাহাজের ক্রুরা নিরলস কাজ করে গিয়েছেন সেই নিশ্চিন্ততাকে নিশ্চিত করতে। আমাদের ঘরের ব্লক-এর দায়িত্বে ছিলেন আর্নল্ড গান্তান। অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন সারাদিন, যত্নের সঙ্গে। দিনে দুবার করে ঘর গুছিয়ে রাখতেন। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে দেখতাম Towel Art-এর চমৎকার কোন এক নিদর্শন রাখা রয়েছে ঘরে – সীল, হাঁস, হাতী । জাহাজে একাধিক দোকান ছিল। সেইসব দোকানে যারা কাজ করতেন, দিনের পর দিন ঘর পরিজন ছেড়ে জলে জলে ভেসে কেটে যায় জীবন তাদের। ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের দ্বীপরাষ্ট্র ডমিনিকার যুবক মার্টিন। একসময়ে তাদের জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলেছে বলে জানাল। এখন জাহাজে উপহার-সামগ্রী বেচার দোকানে খদ্দেরদের জিনিষ দেখাচ্ছে, হাসিমুখে, যত্ন করে। বছরে একবার ছুটি মেলে ঘরে ফেরার। খবর এসেছে, বাচ্ছা অসুস্থ। চিকিৎসা হবে কি? মার্টিন-এর চোখ বিষণ্ণ হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে তরুণ মর্নি। নেচে, অভিনয় করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। কোন সময় আবার সে হয়ে যায় দর্শকদের ডাঙ্গায় নামা বা ডাঙ্গা থেকে উঠে আসার সময় দিকনির্দেশক দলের সদস্য। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জানায় তার স্বপ্ন, সাধ – হলিউডে যাবে সে একদিন। সবাই জানবে তার নাম।
কেমন আছে বেভার্লি বা তার টীম-এর সদস্যরা, স্টিভেন, পাকিতো? জাহাজের প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মী-ই তো তাদের দেশ থেকে। জলের মানুষগুলোর প্রায় দশহাজার-এর মত আত্মপরিজনকে কেড়ে নিয়ে গেছে জলের ঝড় ‘হাইয়েন’। তারা নিজেরাও কি ভেসে গেল কেউ কেউ ছুটি কাটাতে ঘরে ফিরে দ্বীপরাষ্ট্র ফিলিপিন্স-এ? জানি না। আকাঙ্খা রাখি তারা সবাই সুস্থ থাকুক, ভাল থাকুক।
(৩৩) মার্টিন
(৩৪) মর্নি, আমায় চিহ্নিত করেছিল
(৩৫) বেভার্লি, অসাধারণ দক্ষতায় ‘শো’ চালিয়ে যায় অক্লান্ত উৎসাহে
(৩৬) স্টীভ, আমায় এলভিস সাজিয়েছিল
সব শেষে সেই আশ্চর্য সৃষ্টির একটি নমুনা, প্রতি সন্ধ্যায় যা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতাম।
(৩৭) Towel Art.
(সমাপ্ত)
[প্রথম পর্বে লেখার শেষে এক সাথে সব ছবি দেওয়ায় পাঠকের আপত্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্বে তাই ছবি দিয়েই শুরু করেছিলাম। কিন্তু কারো কারো তাতে আপত্তি হয়েছিল। এবং মত এসেছিল যে ছবির সাথে ক্রম-সংখ্যা যোগ করে দিলে ভালো হয়। যথাসাধ্য চাহিদা মেটালাম][আগের পর্বে লেখার সাথে সাথে ছবি দিয়েছিলাম। কিন্তু আর একজন চেয়েছিলেন লেখা প্রথমে, ছবি শেষে। এবারে…
Recent Posts
Categories
- Blog
- Book Chapter
- featured
- অঞ্জলি
- অনুবাদ
- অনূদিত কবিতা
- অনূদিত গল্প
- আলাস্কা গ্লেসিয়ার বে
- ঈশপের গল্প
- কবিতা
- কিছুমিছু
- ক্যালিডোস্কোপ
- ক্রুজ
- গল্পপাঠ
- গুরুচন্ডালি
- ছোট গল্প
- টুকিটাকি
- দুকূল
- নীতিকথার অনুবাদ
- পাঠ প্রতিক্রিয়া
- ফটোগ্রাফি
- বইয়ের হাট
- বাছাই
- বেড়ানোর গল্প
- মৌলিক কবিতা
- রুট ৬৬ গ্রুপ পোস্ট
- রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০
- সচলায়তন
- স্মৃতিকথা