ক্যালিডোস্কোপে দেখি – ২
টুকিটাকি || পর্ব – ২ || খেলা
*** ***
করোনাত্রাসে বিশ্ব ত্রস্ত, অবরুদ্ধ। আতঙ্কে আমাদের চিন্তা-চেতনা চূড়ান্ত বিপর্যস্ত।
তনয়া চিকিৎসালয়ে কর্মরতা। ঘরে আবদ্ধ থাকার প্রশ্ন নেই। তাই, তার এবং তার জীবনসঙ্গীর সামাজিক দূরত্বের বেড়া নিশ্ছিদ্র নয়! আমাদের দুজনের অবস্থাও তথৈবচ। বুড়োবুড়ি থাকি তাদের থেকে ঘন্টাখানেকের দূরত্বে। অত্যাবশ্যক পরিষেবায় যুক্ত। অতিরিক্ত শারীরিক ঝুঁকির কারণে আমার কিছুটা ছাড় আছে, সপ্তাহখানেক বাড়ি থেকে কাজ করছি। স্ত্রীকে নিয়মিত ল্যাবরেটরিতে যেতে হয়। দুজনেই এখন ভুগছি শরীরের সেই অংশের ঝামেলায় যেখানে এই মারণবীজ প্রথম ঘাঁটি গাড়ে। গলা। আমি বেশী। দিনের হিসেবে আমার এগারো দিন হয়ে গেল। স্ত্রীর কয়েক দিন কম।
হয়ত আমাদের বিশেষ কিছুই হয়নি – সাধারণ অ্যালার্জী। কিংবা অতি সাধারণ আর কোন কিছু। কিন্তু নিশ্চিৎ করে জানা নেই। এখনও পর্যন্ত জ্বর নেই। সেইটা ভালো। ঝামেলা হল, অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। চিকিৎসকের কাছে যাওয়া বারণ। বিধান দেওয়া হয়েছে – নির্দিষ্ট ফোনলাইনে ফোন করতে। ফোন করার পর জানানো হল, আর তিন-চারদিন দেখে অবস্থার উন্নতি না হলে সার্স ভাইরাসের উপস্থিতির পরীক্ষা করতে হবে। কতটা কঠিন এবার সামনের দিনগুলো? জানা নেই। শুধু প্রতীক্ষা আছে। আশা করি, পরীক্ষা দিতে যেতে হবে না।
আমার সাধ্যের চূড়ান্ত অতীত এ প্রলয়। যা করতে পারি, করতে বলা হয়েছে, করেছি। এ নিয়ে আমার কথা নেই কোন। যাঁরা পারছেন, বলছেন এ নিয়ে। আমি বরং অন্য কথা বলি। প্রায় নিজের মনে, আমার এই প্রতীক্ষার দিনগুলো কাটানোর জন্য। একদিন হয়ত লেখা হবে – করোনার দিনগুলিতে প্রেম – লাভ ইন দ্য টাইম অব করোনা। আমার এ লেখা সে রকম মহৎ কিছু নয়। আমি ডুব দিয়েছি আমার সামান্য সঞ্চয়ে – আমার ছোটবেলায়। যা উঠে এল। খেলা নিয়ে টুকিটাকি, সেই শৈশবের। ভুলে থাকা – এক লহমার।
আমার সেই দূর শৈশবের দিনগুলোতে সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল রাস্তায় রাস্তায় একটা চাকার পিছনে দৌড়নো। নিজের চাকা ছিল না। বন্ধুরা কেউ দিত। তারা কোথা থেকে চাকাগুলো পেত, জানি না। পরনের জামাপ্যান্ট কি পাঠ-পঠনের হিসাবনিকাশে আমরা সবাই হয়ত এক গ্রহবাসী ছিলামনা। কিন্তু, দিনের খন্ড অংশের যূথচারী জীবনে আমরা অবশ্যই একই গোষ্ঠীর সন্তান ছিলাম। তাই আমাদের সব সম্পত্তির উপর সবারই কিছু না কিছু অধিকার থাকত। আর, আমার থেকে বছর খানেকের ছোট আমার মেজ ভাই যে কারো সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলতে অতীব দক্ষ ছিল। সে ছিল আমার সমস্ত কাজের সঙ্গী। তাই চাকা আমার জুটে যেত।
বড় চাকা হিসেবে ব্যবহার হত বাইসাইকেলের চাকার টায়ার। একটা ছোট কাঠি দিয়ে ক্রমাগত সেটাকে ছোট ছোট পিটুনি দিতে দিতে সেটার পাশে পাশে দৌড়তে থাকা। কখনো একা, কখনো দল বেঁধে, এক চক্কর বা কয়েক। বড় চাকা নিয়ে এই দৌড়টা একটু কম মর্যাদার খেলা ছিল। বড় মর্যাদার খেলা ছিল – ছোট চাকা নিয়ে দৌড়। সম্ভবতঃ সাত-আট ইঞ্চি ব্যাসের ধাতব চাকা, ইঞ্চির আটভাগের এক ভাগ বা তার কাছাকাছি পুরু – নিরেট, একেবারে মাঝখানে একটু ফাঁকা। একটা ধাতব কাঠির এক মাথা বাঁকিয়ে একটা ছোট ইংরেজী ইউ বানিয়ে সেই ইউ-এর ভিতরটায় ঠেকনা দিয়ে চাকাটা দাঁড় করিয়ে তারপর চাকাটা ঠেলে ঘোরাতে ঘোরাতে তার পিছন পিছন দৌড়নো। খুব দক্ষরা মাঝে মাঝে ইউটা চাকার মাঝখানে রেখেও দৌড়তে পারত।
অনেকক্ষণ দৌড়নোর পর সবাই মিলে জিরোতে বসতাম – মাঠে, কারো বাড়ির রোয়াকে বা পুকুরপারের বাঁধানো ঘাটে। অন্ধকার নেমে এসেছে। এই সময় ধাতব কাঠিটা দিয়ে নিরেট চাকাটার গায়ে একটু জোরে মারলে ঠং করে আওয়াজের সাথে আগুনের ফুলকি ছিটকে উঠত, কখনো কখনো একটা হাল্কা পোড়া গন্ধ। বড় হতে হতে চাকা-দৌড়ানোর এই খেলাটা হারিয়ে গেল। নাঃ ভুল হল! এই খেলাটাই জীবন হয়ে গেল – নানা রকমের চাকার সাথে বা পিছনে দৌড়ে চলা।
চাকা নিয়ে দৌড়ানোর খেলা ছাড়া অন্য ছুটোছুটির খেলা ঐ ছোটবেলায় আমার খুব একটা খেলতে ইচ্ছে করতনা। লুকোচুরি, ডাংগুলি, পিট্টু – খেলতাম এসব, অল্প। আসলে বাবার কড়া শাসনে বাইরের সময়টা খুব সংক্ষিপ্ত ছিল। ঘরের খেলায় বেশী সময় কাটত। বারোটা ঘনকের একটা পাজ্ল-গেম ছিল – পাশ পাল্টে পাল্টে ছটা ছবি তৈরী করা যেত। অজস্রবার খেলেও ওটা আমার কখনো পুরনো হত না।
আর একটা ছিল স্থাপত্য বিদ্যার খেলা। অনেকগুলো আয়তঘন, কয়েকটা ঘনক, কিছু কৌণিক, অর্ধগোলক, আর কয়েকটা গোলাকৃতি খিলান নিয়ে বেশ জমজমাট একটা বাক্স। সাথে কয়েকটা ছবি যেগুলো দেখে দেখে বাড়ি, দরজা আরো কি কি সব যেন বানাতে হত। বানাতাম বেশীটাই যদিও – খামখেয়ালীমত। ভারসাম্য রেখে টুকরোগুলোকে দাঁড় করিয়ে রাখা প্রায়ই ইচ্ছের সাথে বাদ সাধত।
তবে এই খেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনারটি ছিল এক যন্ত্রবিদ্যার খেলনা। সেটার নামও বোধ হয় ছিল মেকানিক্স বা ঐরকম কিছু। দুই থেকে ছয় ইঞ্চি লম্বা অনেকগুলো ধাতব পাত ছিল। ধারগুলো গোল, যাতে কেটেকুটে না যায়। পাতগুলোতে ফুটোর সারি। সাথে নানা আকৃতির টুকরো – এল আকৃতির, এক্স আকৃতির, ত্রিভুজ, গোল, পিঠ আর বসার জায়গা জুড়ে চেয়ার, মেঝে আর দেয়াল একসাথে ধরবার জন্য জোড়াপাত। সবার গায়ে সুসমঞ্জস ফুটোর সারি। আর, অনেকগুলো নাট, বল্টু, ওয়াশার। সেগুলো লাগাবার জন্য রেঞ্চ, স্ক্রু-ড্রাইভার, সুতো, কাঁচি – এলাহি ব্যাপার। বেঞ্চ, দোলনা, ঢেঁকি, সেতু, গাড়ি, বাতিস্তম্ভ – কত কি যে বানানো যেত!
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার বাবার বোধ হয় ইচ্ছে ছিল ছেলে ঘর-বাড়ি-সেতু বানানোর বিশারদ হবে। হলনা। প্রিয় খেলনার টুকরোগুলো আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল। আর আমিও যত দিন গেল, যন্ত্রবিদ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে দূরে সরে গেলাম। অনেক পরে অবশ্য জীবন যাপনের এক পর্যায়ে জৈব অণুর কাটাকুটি আর জোড়া লাগানোকে যন্ত্র প্রকৌশল বলায় চাপা কোন আনন্দ পেয়েছিলাম। শৈশবের দিনগুলোর স্মৃতি তখন হয়ত ভিতরে কোথাও একটু সুর তুলে বেজে গিয়েছিল।
এসব খেলার পাশে অন্যরকম কিছু খেলা ছিল যেগুলো মনে হয় এখন আর কোথাও কেউ খেলে না, খেলবে না।
সেই সময় ভারতে স্বাধীনতা আসার যুগটির কিছু অবশেষ এদিক ওদিকে পাওয়া যেত। যেমন – মাঝখানে বড় ফুটোওয়ালা চাকতির পয়সা। ফুটো পয়সা। প্রায় সমস্ত হামা দেওয়া বাচ্চাদের কোমরে দেখতাম – শক্ত সুতো, আমরা বলতাম কার, দিয়ে একটা ফুটো পয়সা বাঁধা আছে। সময়ের পথ ধরে এই ফুটো পয়সার মত বাতিল হওয়া আর এক বিনিময়-মাধ্যম ছিল কড়ি। এখন অনেকে গয়নায় পড়েন। আচার-অনুষ্ঠানেও ব্যবহার হয় – আধ থেকে দেড় কড় মাপের ছোট সামুদ্রিক শামুকের খোলা। চকচকে, সুদৃশ্য, চ্যাপ্টা-পেট ডিমের মত, পেটের দিকটা মাঝবরাবর লম্বালম্বি খাঁজ কাটা। চ্যাপ্টা হওয়ায় ঐ দিকটা দিয়ে বসালে কড়িটা সুস্থির থাকে।
মা-ঠাকুমার সাথে বসে কড়ি খেলতাম। আরো মেয়েরাও জুটে যেত। কয়েকটা কড়ি মুঠো খুলে উপরে ছুড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ার আগে মাটি থেকে একটু উপরে সোজা বা উল্টো করে মেলা হাতের পাতায় তাদের ধরে রাখা, পড়তে না দেয়া। অথবা মুঠো করে মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে একটা কড়িকে দিয়ে আঙ্গুলের টিপে আর একটা কড়িকে টোকা লাগানো। বড় হয়ে যে বিদ্যেকে ক্যারম খেলায় বড় মাপে পেয়েছি।
এখন এই কড়িগুলো বড়দের কাছে যত সুলভ হোক, ছোটদের কাছে তাদের পরিমাণ সীমিত ছিল। তাই ঠাকুমা কড়ির এক বিকল্প শিখিয়ে ছিল আমাদের। অন্য বাড়িতে কি হত জানিনা, আমাদের বাড়িতে কাঁঠালের বীচি শুকিয়ে রেখে দেয়া হত – সাড়া বছর ধরে বাহারি খাদ্য হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য। মা-ঠাকুমার অনুমতি নিয়ে কিছু কাঁঠালের বীচি জাঁতি দিয়ে দু’রকম ভাবে অর্ধেক করে আমরা ছোটরা ব্যবহার করতাম দু রকমের বিকল্প খেলনার জন্য। লাট্টু আর কড়ি।
প্রথমটার জন্য দুই মেরুপ্রদেশ অক্ষুণ্ণ রেখে বিষুবরেখা বরাবর কেটে ফেলতাম। তারপর বিছানা ঝাড়ার জন্য নারকেল শলার যে পরিষ্কার ঝাঁটাটা ব্যবহার হত সেইটার একটা শলা ভেঙ্গে বের করে নিতাম দুটো ছোট টুকরো। দুই শলার টুকরোকে কর্তিত কাঁঠাল বীচির দুই টুকরোর নরম চ্যাপ্টা দিকটার ঠিক মাঝখানটায় অর্ধেকমত গেঁথে দিলেই হয়ে গেল দুটো লাট্টু। এবার মেরু বিন্দুতে ভর করিয়ে, দুই আঙ্গুলে শলা ধরে দাও পাক মেরে। ঘুরতে থাকুক কাঁঠাল বীচির লাট্টু।
কড়ির বিকল্প বানানো আরো সহজ ছিল। ঠিক মাপের কাঁঠাল বীচির দুই মেরুর মধ্য দিয়ে দ্রাঘিমা বরাবর অর্ধেক করলেই পাওয়া হয়ে গেল দুইখানি বিকল্প কড়ি। খেলতে থাকো এবার যত খুশী। কড়ি হারিয়ে ফেলার দুশ্চিন্তা আর রইলনা। বড় হয়ে দেখলাম – বিশ্বজোড়া খেলাঘরে বিকল্পর ছড়াছড়ি।
[প্রকাশিত – গুরুচন্ডালি, মার্চ ২৭, ২০২০]
টুকিটাকি || পর্ব – ২ || খেলা *** *** করোনাত্রাসে বিশ্ব ত্রস্ত, অবরুদ্ধ। আতঙ্কে আমাদের চিন্তা-চেতনা চূড়ান্ত বিপর্যস্ত। তনয়া চিকিৎসালয়ে কর্মরতা। ঘরে আবদ্ধ থাকার প্রশ্ন নেই। তাই, তার এবং তার জীবনসঙ্গীর সামাজিক দূরত্বের বেড়া নিশ্ছিদ্র নয়! আমাদের দুজনের অবস্থাও তথৈবচ। বুড়োবুড়ি থাকি তাদের থেকে ঘন্টাখানেকের দূরত্বে। অত্যাবশ্যক পরিষেবায় যুক্ত। অতিরিক্ত শারীরিক ঝুঁকির কারণে আমার কিছুটা…
Recent Posts
Categories
- Blog
- Book Chapter
- featured
- অঞ্জলি
- অনুবাদ
- অনূদিত কবিতা
- অনূদিত গল্প
- আলাস্কা গ্লেসিয়ার বে
- ঈশপের গল্প
- কবিতা
- কিছুমিছু
- ক্যালিডোস্কোপ
- ক্রুজ
- গল্পপাঠ
- গুরুচন্ডালি
- ছোট গল্প
- টুকিটাকি
- দুকূল
- নীতিকথার অনুবাদ
- পাঠ প্রতিক্রিয়া
- ফটোগ্রাফি
- বইয়ের হাট
- বাছাই
- বেড়ানোর গল্প
- মৌলিক কবিতা
- রুট ৬৬ গ্রুপ পোস্ট
- রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০
- সচলায়তন
- স্মৃতিকথা