ক্যালিডোস্কোপে দেখি – ১৯

ক্যালিডোস্কোপ-১৩ || বর্ষশেষ, নববর্ষ *** *** কাল যতিহীন, তবুও। বছরের শেষ সপ্তাহটিতে ঠাকুমা বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিত – ছাতু এনে রাখার জন্য। দু’রকমের – যবের এবং ছোলার। তারপর বছরের শেষ দিনটিতে – চৈত্র সংক্রান্তির সকালে অনুষ্ঠিত হত এক মজার লোকাচার। অবশ্য, তখন সেটা মজার ছিল না। বাড়ির সামনের রাস্তায় তিন ভাই এক হাতে মুঠোভর্তি ছোলার ছাতু আর এক হাতে মুঠোভরতি যবের ছাতু নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়তাম, যথা সাধ্য পা দু’টো ছড়িয়ে। এর পর মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি এনে ঠাকুমার সুরে সুর মিলিয়ে বলতাম ‘যা শত্রু পরে পরে’। (এই রকম-ই কিছু, যতটা মনে পড়ে।) আর, পায়ের তলা দিয়ে মুঠো খুলে ছাতুর পুঁটুলি ছুঁড়ে দিতাম পিছনের দিকে। হাওয়ায় ছাতু উড়ে যেত – কে জানে কোন শত্রুকে নিকেশ করতে। এবার এক-ই জায়গায় উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আবার শত্রুর উদ্দেশ্যে ছাতু নিবেদন। তারপর আরও একবার প্রথমবারের মত করে। কোথা থেকে কি ভাবে ঠকুমা এই নিয়ম পেয়েছিল – জানি না। কুচবিহারের জীবনের তিনিটি বছরে ত বটেই তার পরেও চার-পঁচ বছর চলেছিল এ নিয়ম পালন। লজ্জা লাগত – আর কাউকে দেখতামনা এই রীতি পালন করতে। নিজেরাও করতাম অন্যদের নজর এড়িয়ে। এইভাবে সাফল্যের সাথে শত্রুনাশ-এ সফলতা অর্জনের পরেই আসত চৈত্র সংক্রান্তির বিশেষ আকর্ষণ – লম্বা পিরামিডের মত দেখতে লাল-সাদা-সবুজ রং-এর ‘মঠ’ – যেন মঠের চূড়া – চিনি দিয়ে তৈরী মিষ্টি, বেজায় শক্ত। আর, গোল গোল সাদা কদমা – সেও চিনির তৈরী, নরম, যেন জমাট ফেনা। আর পেতাম পয়সার মত আকৃতির তিলা – চিনি আর তিল থেকে বানানো। এক এক বাটি মুড়ির সাথে এইসব অমৃতদ্রব্যের সদ্বব্যবহার করার যে বিপুল আনন্দ লাভ হত তার কাছে রাস্তায় গিয়ে ছাতু ওড়ানোর লাজুক দ্বিধা চাপা পড়ে যেত। এরপর বড় হতে হতে কখন কিভাবে আমাদের লজ্জাবোধও বড় হয়ে গিয়ে এ নিয়ম উঠে গেল এখন আর মনে পড়ে না। এইমাত্র মার সাথে দূরভাষে কথা হ’ল। মনে করিয়ে দিল যে আমাদের বাড়িতে সংক্রান্তির দিন তেতো আর টক খাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। সেই সাথে এও মনে করিয়ে দিল যে এই সপ্তাহের এই শনিবারের গল্প-টা সংক্রান্তির গল্প। কাল, রবিবারে নববর্ষের আমি যেন তাকে দূরভাষে প্রণাম জানাতে ভুলে না যাই। সেই ত – এই প্রতীক্ষা জানে সেই জন যে থাকে অপেক্ষায়। সংক্রান্তির পরের দিনটিতেই আসত সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকা – নূতন বৎসর, নতুন বছর, নববর্ষ, পয়লা বৈশাখ।এই পর্যন্ত আসার পর স্মৃতি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। মহালয়ার দিন যে ঘটনা ঘটত সেটা এই দিনটাতে সমাপতিত হয়ে গেল। ঐ দিনের ভুরিভোজের গল্পকে ঠেলে নিয়ে এলাম এই দিনের কাছে। মহালয়ার দিনটিতে আমাদের বাড়িতে একটা নিজের ধরণের গল্প ছিল – বাবার কারণে। এই মানুষটির কয়েকটি নিজস্ব রীতি বা আচার ছিল – তার একটি ছিল ঐ দিনটিতে একজন ব্রাহ্মণ অতিথিকে ভোজন করানো। ভুরিভোজের বিশেষ ব্যবস্থা – অতিথির সাথে আমাদেরও। ব্রাহ্মণকেই কেন নেমন্তন্ন করা হবে এই প্রশ্নের জবাব ছিল – তাঁর অকালে হারানো বাবা সেইরকম-ই করতে বলে গেছেন। একটা সময়, শুধুমাত্র ব্রাহ্মণকেই নিমন্ত্রণের জড়তাটা বাবা কাটিয়ে উঠেছিলেন। পরে জীবন আরও কঠিন হয়ে যাওয়ায় অতিথি আপ্যায়ণের অংশটুকু আর টানতে পারেন নি। যাক, এই দিনের সুবাদে সেই দিনের গল্প হয়ে গেল যৎকিঞ্চিত। পয়লা বৈশাখের দুপুরেও ভাল মতই ভোজ হত। তবে, সেই ভোজের থেকে বেশী আকর্ষণের ছিল – বিকেলবেলার ‘হালখাতা’ – বাবার সাথে দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে। ছোট, বড়, মাঝারি কোন না কোন মিষ্টির বাক্সে রকমারি মিষ্টি আর নোনতা। আর সেই সাথে একটা ক্যালেন্ডার। কোন দোকান কি ক্যালেন্ডার দিল বা কোন বাড়িতে কি ক্যালেন্ডার এলো – সেইটা একটা নজর করার মত ব্যাপার ছিল। কাল ত অনন্ত, বহমান, যতিহীন। আমরা তাতে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন বসিয়ে আমাদের কাছে তাকে অনুভবযোগ্য করে তুলি। কালের ধারায় অনুভবের ধারাও পাল্টায়। সংক্রান্তি থেকে পয়লাতে পদার্পণের অনুভব একটা নূতন মাত্রার আনন্দে উত্তীর্ণ হয়েছিল এক আশচর্য অভ্যুদয়ে – বাংলাদেশের সৃষ্টিতে। নিতান্তই ছায়া ছায়া মৃদু আলোয় দোকানীর অনুগ্রহের সান্ধ্য মিষ্টির হালখাতাকে ছাড়িয়ে সে পৌঁছে গিয়েছিল নিজেকে সগর্বে উপস্থাপন করার ঝলমলে রাজপথে। ১লা বৈশাখ আর মোটেও একলা নয়, অনেককে জড়িয়ে নিয়ে। নববর্ষের এই প্রবল উপস্থিতিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল দূরদর্শন। প্রথম দিকে সীমিত সম্প্রচার, কিন্তু আকর্ষণ-এর কোন কমতি ছিল না। কলকাতার সম্প্রচার, বাংলাদেশের সম্প্রচার – যে বাড়িতে এই দুই-ই হাজির তাদের ব্যাপার-স্যাপার-ই আলাদা। তারপর ত এসে গেল আর এক যুগ – চ্যানেল এর পর চ্যানেল। নববর্ষের বিপুল উদযাপন। সেই যুগটাকে আমার কাছে থেকে দেখা হয়নি। বাংলাভাষার দুনিয়া থেকে সরে আসা মানুষ দূর থেকে শুনি সে কলকল্লোল। দূর থেকে হলেও ভাল লাগে। সেই ভাল লাগা আমাদের পৌঁছে দেয় আরেক অনুভবে। পৃথিবীর মুখ একটুখানি দেখে ফেলেছি বলে, বাংলার মুখ দেখা মুছে যায় না। নিতান্ত সাধারণ মানুষগুলো তাই জড়ো হয়ে যায়, যাই, সাধ্যমতো, সেই অসাধারণ উদযাপনে – বাংলা ননবর্ষের – দুনিয়া জুড়ে। আজকের ক্যালিডোস্কোপে কোন মন খারাপের কথা নেই। সে সব অন্য আরেকদিন হবে। আজ সকলকে আনন্দ-অভিবাদন।Top of Form [প্রকাশিত – সচলায়তন, এপ্রিল ১৪, ২০১৮]
ক্যালিডোস্কোপ-১৩ || বর্ষশেষ, নববর্ষ *** *** কাল যতিহীন, তবুও। বছরের শেষ সপ্তাহটিতে ঠাকুমা বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিত – ছাতু এনে রাখার জন্য। দু’রকমের – যবের এবং ছোলার। তারপর বছরের শেষ দিনটিতে – চৈত্র সংক্রান্তির সকালে অনুষ্ঠিত হত এক মজার লোকাচার। অবশ্য, তখন সেটা মজার ছিল না। বাড়ির সামনের রাস্তায় তিন ভাই এক হাতে মুঠোভর্তি ছোলার…
Recent Posts
Categories
- Blog
- Book Chapter
- featured
- অঞ্জলি
- অনুবাদ
- অনূদিত কবিতা
- অনূদিত গল্প
- আলাস্কা গ্লেসিয়ার বে
- ঈশপের গল্প
- কবিতা
- কিছুমিছু
- ক্যালিডোস্কোপ
- ক্রুজ
- গল্পপাঠ
- গুরুচন্ডালি
- ছোট গল্প
- টুকিটাকি
- দুকূল
- নীতিকথার অনুবাদ
- পাঠ প্রতিক্রিয়া
- ফটোগ্রাফি
- বইয়ের হাট
- বাছাই
- বেড়ানোর গল্প
- মৌলিক কবিতা
- রুট ৬৬ গ্রুপ পোস্ট
- রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০
- সচলায়তন
- স্মৃতিকথা