ক্যালিডোস্কোপে দেখি – ২০

কাল সারাদিন ক্যালিডোস্কোপ ঘুরেছে।

*** ***

স্মৃতির সরণিতে নানা শাখাপ্রশাখার জাফরি দিয়ে ঝুঁজিয়ে আসা আলো আর অফুরান কুয়াশার ঝাপসা বিস্তার সরিয়ে কত যে টুকরো ছবি!

শিশু তার প্রথম খেলা আবিস্কার করে খাবার নিয়ে, মায়ের বুকে। মায়ের কোল থেকে নামার পরেও হয়ত তার খাবার নিয়ে খেলার সাধ থেকে যায়। আমাদের তিন ভাইয়ের, বিশেষ করে আমার – ছিল। কিন্তু বড় হয়ে গেলে তো খাবার নিয়ে খেলতে মানা, তাই খেলতে হত সাবধানে। আমাদের সেই ছোটবেলায় ভাত খাওয়া হত কাঁসার থালায়। আমি খানিকটা ভাত-ডাল-তরকারী একসাথে মেখে নিয়ে ছোট ছোট গোল্লা পাকিয়ে সার দিয়ে থালার ধার ধরে সাজিয়ে ফেলতাম। তার পর এক এক গরাসে একটা করে গোল্লা। আর খেলাটা চূড়ান্তে উঠত যখন মাকে পাশে বসিয়ে মার হাত থেকে গোল্লা গুলো খাওয়া যেত। অমৃত। আমরা তিন ভাই-ই খেলাটা খেলেছি। আমি খেলেছি বহুদিন ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন পার করেও। তার পর আর সে খেলা সম্ভব হয়নি, হবে না আর কোনদিন-ই।

মা খুব সৌখীন মানুষ ছিল। তাঁতের নরম শাড়ী, জবা-কুসুম তেল আর পন্ডস ক্রিমের নিয়মিত যোগান – যাই ঘটুক না কেন বাবার এই ব্যাপারে কখনো ভুল হতনা। আর ছিল বাহারি চিরুনি। কোন কোন বিকেলে মা যখন গা ধুয়ে পাটভাঙা শাড়ী পরে হাল্কা পন্ডসের সুবাসে ঘর ভরিয়ে আলতার শিশি নিয়ে বসত, একঢাল নরম চুলে লাগাত চিরুনির টান, আর আমি তার পায়ের পাতার বেড় ধরে আস্তে আস্তে আলতা-ভেজানো তুলো কি স্পঞ্জের টুকরো দিয়ে রাঙ্গিয়ে তুলতাম দুটি অপরূপ চরণ – সে আনন্দের কোন প্রকাশ আর কোন ভাবেই সম্ভব নয়।

উত্তরবঙ্গের দিনগুলোতে মা ঝলমল করত আবার পড়াশোনার জগতে ফিরতে পেরে। বাড়ির খুব কাছে মেয়েদের এক নামী বিদ্যালয়ে বয়স্কদের জন্য বিশেষ শিক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতিবছর একসাথে দুটি করে ক্লাস – পঞ্চম-ষষ্ঠ, সপ্তম-অষ্টম, নবম-দশম। পরীক্ষা হত নিয়মিত আর বয়স্ক একসাথে। মা দু’বছর পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। দু’বার-ই সবার মধ্যে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। বয়স্কদের বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন সহ-প্রধান শিক্ষক। ছাত্রীর গুণে মুগ্ধ, অবসরের কাছে পৌঁছে যাওয়া মানুষটি চলে আসতেন আমাদের বাড়িতে। বাবাকে বলতেন তাঁর প্রিয় শিষ্যাটি যেন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে। গুরুর সেই উৎসাহ-ভরসা-আবেগ পরবর্ত্তীতে মাকে অনেক কঠিন সাঁকো পার করে দিয়েছিল। আমদেরও।

মা সময় নষ্ট করার মানুষ ছিলনা। মূলধারার লেখাপড়ায় ফিরতে পারার সুযোগ আসার আগে তাই শিখে ফেলেছিল সেই সময়ের মেয়েদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণীয় বিদ্যা – সেলাই মেশিনে সেলাই করা – রীতিমত ‘ক্লাস’ করে। বিদ্যেটা সে আয়ত্ব করেছিল চমৎকার ভাবে। ফলে একটা থান কাপড় কেমন ভাবে নানা মাপের টুকরো হয়ে আবার জুড়ে জুড়ে গড়ে ওঠে একটা আহা-মরি-মরি নূতন জামা, ফ্রক কি ব্লাউজ কিংবা ধরো, সেলাই যন্ত্রটার-ই ফ্রিল দেওয়া একটা বাহারী ঢাকনা – সে এক আশ্চর্য মজা। মার সাথে সাথে আমিও হাত লাগাতাম। মা হাতল ঘোরাচ্ছে, সেলাইয়ের কাপড়টা ঠেলে দিচ্ছে সূঁচ-এর নীচের দাঁত-চাপকের মাঝখানে, আমি উল্টো দিকে সমান টানে টেনে নিচ্ছি সেটা আর সাঁই সাঁই করে সূঁচ উঠছে-নামছে। মা একাই আঙ্গুলের টিপে সবটা করতে পারত; কিন্তু সে আমায় জুড়ে নিত তার সৃষ্টিতে, বোঝাপড়ায়। জীবনের কত সেলাই যে একসাথে করেছি আমরা – কখনো আমি এপাশে কখনো মা।

জীবনের এই যৌথ যাপন আসলে মার জীবনমন্ত্র ছিল। শুধু নিজের ছোট্ট সংসারটিই নয়। তার জীবন সংপৃক্ত ছিল আরো বহু জীবনকে জড়িয়ে নিয়ে। তার ভাইদের কাছে মা’র আদরের ডাকনাম ছিল সৌদামিনী। যথার্থই সৌদামিনী। বিদ্যুৎ ত বটেই, প্রয়োজনে ঐ নরম-সরম মানুষটাই একেবারে বজ্র-বিদ্যুৎ! ফলে আশপাশের মেয়েদের সাথে মা’র প্রবল বন্ধুত্ব। আমাদের বাড়িতে তাই বিভিন্ন বয়সের দিদি-কাকি-মাসি-পিসীদের আড্ডা জমত প্রায় রোজ-ই। তাদের কখনো ফিসফিস কখনো কলকল হাসিতে ভেঙ্গে পড়া। কারও হাতে ঊল কাঁটা আর কোলে উলের গোলা, কারও হাতের গোল ফ্রেমে আটকানো রুমালে এমব্রয়ডারীর সূঁচ রঙ্গিন সুতো নিয়ে উঠছে-নামছে, কেউ এনেছে কুলের আচার, বড়ি কি কাসুন্দি, কেউ এসেছে পরামর্শ চাইতে কিংবা শুধুই গল্পের ঝুলি নিয়ে কি কয়েক ফোঁটা লুকোনো চোখের জল মুছে নিতে। সেইসব রঙ্গিন বিকেল অস্ত গেছে বহুকাল।

বড় হতে হতে আমি তার বন্ধু হয়ে উঠে ছিলাম। আমাদের তিন ভাইয়ের সর্ব কনিষ্ঠটি ছোট থেকেই মজার মানুষ। তার কাছেই, তার পরিবারেই মার থেকে যাওয়া। কিন্তু তাকে নিয়ে মা’র ছিল সর্বদার অহৈতুকী উদ্বেগ। মেজ ভাইটি আমাদের পরিবারের অক্ষদণ্ড। যেখানেই থাক, যতদূরেই থাক শেষ দিন পর্যন্তও তার উপর মার ছিল অসীম নির্ভরতা। আর আমি ছিলাম তার গল্প করার, গল্প শোনার সঙ্গী। সেই সাথে ভাইদের দায়িত্ব। দুর্গাপূজার সময় তিন ছেলেকে নিজের হাতে সেলাই করা নূতন জামাপ্যান্ট পড়িয়ে আমার দুই হাতে ছোট দুই ভাইয়ের হাত ধরিয়ে দিত। পিঠোপিঠি তিন ভাই হাতে হাত ধরে চলো। যতদূর যাও। বড় হতে হতে হৃদয়ের সম্পর্কে আমার প্রাপ্তি হয়েছিল আমার দাদাকে, আমার ছোট আরো পাঁচ ভাই আর দুই বোনকে। মার স্নেহে ভিজেছি সকলে।

আমার বিয়ের পর তার এল মহা খুশীর দিন। দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার মেয়েটি এল তার জীবনে। পুত্রবধূ নয়, কন্যা। দুজনের মনন মিলত এক তারে। একসাথে বসে বাংলাদেশের নাটক দেখা! টিভির পর্দা ছোট, একাত্ম আকাশ অসীম। নিয়মতান্ত্রিক মানুষটির এই কন্যার জন্য ছিল অজস্র ছাড়। আমাদের পরবাসে থিতু হতে গিয়ে এই দুটি মানুষের জীবন আলাদা হয়ে গেল। দূরভাষে আমার থেকে এই কন্যার সাথেই হত তার বেশীরভাগ আলাপচারী। আবার এই কন্যা তাকে উপহার দিয়েছিল তার বিশেষ প্রাপ্তি – তার বড় নাতনী। চোখে হারাত তাকে। পরবাস জীবন একেও নিয়ে চলে এসেছিল তার কোল থেকে। আমাদের পরবাসের প্রথম পর্যায়ে একটি বছর মা-বাবা আমাদের সাথে ছিল। ছোট্ট দুই কামরার ঘরে ছোটবড় মিলিয়ে পাঁচটি মানুষ। তার সাথে প্রায়ই নূতন পাওয়া বন্ধুদের নিয়ে ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে’ দীর্ঘ আড্ডাবাজী। এখন সকলি অতীত।

ধীরে ধীরে তিন ভাইয়ের বিয়ে হয়ে নাতিনাতনী নিয়ে ভরা সংসার। প্রত্যেকের জন্য তার নিজস্ব বিচার, নিজস্ব বোধ। কত যে সম্পর্ক! রক্তের, রক্তের বাইরের, হৃদয়ের! বোন-দিদি-পিসী-মাসি-বৌমা-বৌদি-মা-জেম্মা-বেয়ান-ঠাকুমা – বিস্তৃত জীবন তার। ছড়িয়ে ছিল, ছড়িয়ে রইল অশ্রুসিক্ত অনেক জীবনে!

ক্রমাগত নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া, বিলিয়ে দেওয়া। তারপর কালের অমোঘ নিয়মে সংসার তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলে। শরীর অশক্ত কিন্তু চিন্তা-চেতনা সজাগ, সতেজ। মনোযোগী পাঠক বহমান জীবনপ্রবাহে সংপৃক্ত।

পৃথিবীর অপর প্রান্তের এক ঘাটে ‘সন্ধ্যা’ আজ রাতের আকাশে মিলিয়ে গেল।

যদিও হৃদয় ভেঙ্গে আসে, তবু দীর্ঘ যন্ত্রণা আরো দীর্ঘ, আরো জটীল হয়ে পড়ার আগে চলে যাওয়াটা কাঙ্ক্ষিত ছিল – তার নিজের কাছে, তার প্রিয়জনদের কাছেও।

প্রতি শুক্রবারের সন্ধ্যায় যে সময়-সংকেত বেজে উঠত আমার ফোন-ঘড়িতে – একুশে জানুয়ারী, ২০২০-তে তাকে থামিয়ে দিলাম, আর দরকার নেই।

[প্রকাশিত – সচলায়তন, জানুয়ারী ২৩, ২০২০]

কাল সারাদিন ক্যালিডোস্কোপ ঘুরেছে। *** *** স্মৃতির সরণিতে নানা শাখাপ্রশাখার জাফরি দিয়ে ঝুঁজিয়ে আসা আলো আর অফুরান কুয়াশার ঝাপসা বিস্তার সরিয়ে কত যে টুকরো ছবি! শিশু তার প্রথম খেলা আবিস্কার করে খাবার নিয়ে, মায়ের বুকে। মায়ের কোল থেকে নামার পরেও হয়ত তার খাবার নিয়ে খেলার সাধ থেকে যায়। আমাদের তিন ভাইয়ের, বিশেষ করে আমার –…