পায়ে পায়ে

নদীর পাড়ঘেঁষা এই শহরের এই দিকটায় ব্যস্ততা কম। আমার এখন সেটাই দরকার। বাড়িটার আয়তন অনুসারে ভাড়াটা হয়ত একটু বেশী-ই। কিন্তু আমার এখন এই নির্জনতাটা খুব দরকার। খুব। যে জীবন নিজের পছন্দে বেছেছি, গড়েছি, সেখান থেকে যখন পালাতে হয় সে বড় কঠিন হয়ে পড়ে।

বাড়িটা এই লোকালয়ের একেবারে শেষ প্রান্তে। নদী এখানে এসে গোল করে বাঁক খেয়েছে। বাড়ির চার পাশে বেশ খানিকটা জমি। পূবে, পশ্চিমে দু’পাশের জমির শেষে গাছগাছালির বেড়া এ বাড়িকে প্রতিবেশীদের বাড়ির থেকে আড়াল করে রেখেছে। উত্তরে, পিছনের জমির পরে নদী। বেশ একটু নীচে।

বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণের ঘরে আমার বেশীর ভাগ সময় কাটে। একই সাথে আমার অফিস আর টিভি দেখার ঘর। উত্তর আর পশ্চিমের দেয়াল দুটো প্রায় পুরোটা জুড়ে একটানা বড় বড় জানালা। জানালার ভিতর দিকে কাঁচের পাল্লা। বাইরের দিকের পাল্লায় মশা আটকানোর জন্য তারজাল লাগানো। ভারী পর্দায় জানালা ঢাকা থাকে। কাঁচের পাল্লা খুলে রাখলে নিস্তব্ধ রাতে নদীর ঢেউয়ের আওয়াজ শোনা যায়। মাঝে মাঝে গানের সুর ভেসে আসে। উত্তরের দেয়াল যেখানে পরের ঘরে যাচ্ছে ঠিক সেখানটায় দেয়াল থেকে চার পাঁচ গজ তফাতে বাড়ি আর নদীর মাঝে একটা বিশাল ঝাঁকড়া গাছ। সে গাছে একেক দিন পাখীদের কিচির-মিচির সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের ভিতরেও গড়িয়ে যায়। নদীর বুক থেকে ভেসে আসা আওয়াজ আর পাখীদের কাকলিতে অনন্তকাল ধরে চলা জীবনের স্পন্দন পাই। যে জীবন মানুষের নয়, প্রকৃতির। ভালো লাগে। এক সপ্তাহের কাজে এক রবিবারে এখানে এসে উঠেছিলাম। মঙ্গলবারে লকডাউন ঘোষণা হয়ে গেল। ফিরে যেতে পারতাম, যাইনি। সেই থেকে এখানেই আছি। মনে হচ্ছে ঠিক জায়গাতেই এসেছি। আর ফিরতে চাই না।

গতকাল মেঘলা থাকার পর আজকের দিনটা বেশ ঝকঝকে। তার সাথে পূর্ণিমা। কাজ শেষে পাশের টেবিলে ল্যাপটপ নামিয়ে রেখে টিভিটা চালু করলাম। একটা জানালর পাল্লা খুলে রেখেছি। পাখীদের কিচিরমিচির আজ প্রায় উন্মত্ততায় পৌঁছে গেছে। সেই উন্মত্ততা ছাপিয়ে টিভিতে ন্যাট জিওর একটা শো দেখছি। খাদকের হাত থেকে খাদ্যের বাঁচার অন্তহীন গল্পের টুকরো টুকরো ছবি। মৃত্যু কখনো ছুঁয়ে দিচ্ছে, কখনো এ বারের মত ছেড়ে দিচ্ছে। এই সময় নদীর দিক থেকে একটা হাওয়া আসে। আজকেও আসছে, তবে মাঝে মাঝে পড়ে যাচ্ছে। পাখা চালিয়ে রেখেছি, অল্প করে। হালকা একটা চাদর জড়িয়ে রাখা আমার বরাবরের অভ্যাস। টিভি দেখতে দেখতে হেলানো সোফাটায় আধশোয়া হয়ে কখন কে জানে, ঘুমিয়ে পড়েছি। মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল এক নিঃসীম স্তব্ধতায়। তারপরেই পরিষ্কার শুনতে পেলাম কথোপকথন। মানুষের গলা, আবার মানুষের নয়ও। আমার নাম ধরে ডাকছে। টিভি থেকে নয়, ঘুমের মাঝেই আধো জেগে কখন সেটা থামিয়ে দিয়েছিলাম; ওটা এখন শব্দহীন হয়ে আছে। ডাক এসেছে বাইরে থেকে। আশ্চর্যের হল, আমার একটুও অবাক লাগল না। যেন এমনটাই হবার কথা ছিল। একটা জানালার পর্দা একটু সরে আছে, সেখান দিয়ে গাছটা দেখা যাচ্ছে। গাছের মাথায় পাতার জাফরির মধ্যে বসে আছে তারা। দুই পাখী। আমি খুব সহজেই চিনতে পারলাম। সেই ছোটবেলায় এসেছিল তারা। আবার আজ এসেছে – ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী।

আমার বুক কেঁপে উঠল। যেন একটা অনন্ত নিদ্রা থেকে জেগে উঠলাম। ঘরে ঢুকে এলো তারা।

“কি চাও?” জিজ্ঞেস করল ব্যাঙ্গমা।

আমি চুপ করে থাকলাম।

“আর ভালো লাগছে না?” আস্তে করে জিজ্ঞেস করল ব্যাঙ্গমী। মনে হল যেন তার ডান হাত দিয়ে সে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিল। জানি, পাখীর হাত নেই। তবু মনে হল।
ব্যাঙ্গমা হাসল একটু। সেই আগের মত। যে রাতে আমি প্রথম দেখেছিলাম তাদের। তার আগের রাতে আমার বারো বছরের জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল। মাঝরাতে জানালার পাশের বটগাছটা থেকে তারা দু’জন নেমে এসেছিল আমার ঘরে। গল্প করেছিল। উড়ে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, “তুমি যাকে ভালবাসবে, সে তোমায় কোনদিন ছেড়ে যাবে না।” আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আমি কি ছেড়ে যাব তাকে?” উড়ে যাওয়া তাদের ডানার আওয়াজে আমার প্রশ্নের উত্তর চাপা পড়ে গিয়েছিল।

আমাদের মেয়ের বয়স এখন বারো বছর। উত্তরটা পরিষ্কার হচ্ছে। অথচ আমি সেটা চাইনি। কিন্তু আমি যে আর পারছি না! রীতেশ আমায় ভালোবাসে। শুধু জানি না তার কতটা আমায় আর কতটা আমার ওকে টেনে নিয়ে যাওয়ায়। একে ওকে পট্টি পরিয়ে অর্ডার যোগাড় করে, ঐটা ও পারে। তারপর, বাকি সমস্ত দায় আমার। গোটা ব্যবসা, ব্যবসা কি, পুরো জীবনটাই এ লোক আমার উপরে ফেলে রেখেছে। দায়িত্ব কি করে ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়, ওর থেকে ভাল কেউ জানে না। কি অবলীলায় গল্প বানায়! আমাদের সমস্ত বন্ধুরাই ওর দিকে। এত প্রেম তারা আর কোথাও দেখেনি। ওর ঐ একটু বিষণ্ণ, মায়াময় প্রেমিক চোখ, সে যে কত বড় ফাঁকি – যে ঘর করে সে জানে। ও যে কোন দিকে তাকায় না, কোন কিছুর হিসেব রাখে না, সেটা যেন ওর মস্ত উদারতা। আর সে উদারতা সামাল দিতে একটা মেয়ে যে তার সব স্বপ্ন গুটিয়ে নিল, সব যেমন-ইচ্ছে-চলাকে বেঁধে ফেলল হিসাবের শিকলে, তার কি হবে? আর কতকাল তাকে এই রকম টেনে চলতে হবে! একজোড়া উজ্জ্বল চোখ তাকে একদিন খুঁজত, সে চোখদুটো এখন আর তার মনেও পড়ে না ঠিকমত। আজকাল বড় মনে হয়, এরকম হওয়ার কথা ছিল না। দমবন্ধ লাগে আমার। শুধু আমাদের মেয়েটা, সে বেচারী এখনও বুঝে উঠতে পারছে না, কোথায় সুর কেটে গেছে।

মার কাছে যে যাব সে উপায়ও নেই। মা আমাদের ছোটবেলার শহরে সেই বাড়িটাতেই রয়ে গেল। বাবার স্মৃতি ও বাড়ির বাতাসে আজও মাকে ঘিরে আছে। আমাদের অবস্থা ফিরতে ঐ ভাড়া বাড়ি-ই মাকে কিনে দিয়েছি। কিন্তু আমার পক্ষে সহজে অত দূরে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফোনেও আজকাল আর রোজ কথা হয় না। তা ছাড়া আমার এ যন্ত্রণার কথা বলে কি করব? সবটাই ত আমি যেমন চেয়েছি। মা আমার ইচ্ছেতেই সায় দিয়েছে। মা নিজে ত গোটা জীবনটা একটা লোকের স্মৃতিতে আর আমায় দাঁড় করানোয় কাটিয়ে দিল। অথচ মার কত গুণ ছিল। বাবা চলে যাওয়ার পর কটা বছর বাবার নাটকের দলটা মা দুহাতে আগলে রেখেছিল। কিন্তু আমার নাটকে মন ছিল না। আস্তে আস্তে আমি নিজের পছন্দের জগতে মেতে উঠলাম। তারপর একসময় রীতেশ এল। একটু একটু করে পায়ে পায়ে আজ এইখানে। কিন্তু এখন?

পাখীরা চুপ করে আমার কথা শুনছিল। না আমি মুখে কিছু বলিনি, বলতে হয় নি। ব্যাঙ্গমী আমার কাছ ঘেঁষে এল। তার মাথাটা আমার ঘাড়ের কাছে নিয়ে এসে আলতো করে আমার গালটা ছুঁয়ে দিল। আর, ব্যাঙ্গমা আমার ল্যাপটপ কম্পিউটারটার দিকে এগিয়ে গেল। সেটা এতক্ষণ খোলাই ছিল, তবে ঘুমিয়ে ছিল। ব্যাঙ্গমা তাকে জাগিয়ে দিল। তারপর আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে পাসওয়ার্ড বললাম। কীবোর্ড আর মাউস নিয়ে নড়াচড়া করে সে একটা ফোল্ডার খুলে ফেলল। একটা মেয়ের ভিডিও। মেয়েটা একবার মুখ ফেরাল। আরে, এ ত আমি! কখন তোলা এ ভিডিও? আমার চোখে জল কেন? কোথায় যাচ্ছি? এই জায়গাটা আমি চিনি। আমার ছোটবেলার মফস্বল শহর। আমাদের বাড়ি ছেড়ে এ রাস্তাটা চলে গেছে বাস গুমটির দিকে। ও দিকে যাচ্ছি কেন আমি?

ব্যাঙ্গমী এবার আমায় ছেড়ে মাউস তুলে নিল। একটা ফাইল খুলল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল খবরের কাগজের কাটিং। আমার নামে। আরে! এ ত আমার ডাকনাম! বাবার খুব পছন্দ ছিল এই নাম। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, যদি কোনদিন খুব বড় কেউ হই এই নামেই সবাই চিনবে আমায়। ইচ্ছেপূরণ হয়নি। আজ আর এ নামে আমায় কেউ চেনে না! কিন্তু, এ সব কি লিখেছে আমার নামে?

নিরুদ্দিষ্ট অভিনেত্রী লিপি-র এখনও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্থানীয় একটি দোকানের সামনে লাগান সি সি টিভির ফুটেজে তাকে বাস গুমটির দিকে হেঁটে যেতে দেখা গিয়েছিল। লিপির কম্পিউটারের একটা ফোল্ডারে কয়েকটি লেখা পাওয়া গিয়েছে। লেখাগুলি দেখে চিঠি মনে হলেও সেগুলি কাউকে ইমেইল করা হয়নি। সেগুলির কোন কোনটিতে সম্বোধন থাকলেও সবগুলিতে নেই।

ব্যাঙ্গমা এতক্ষণ কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার আমার দিকে মাথাটা ফেরাল। চোখে জিজ্ঞাসা। নাকি জিজ্ঞাসাটা সরাসরি আমার মাথায় এল? আমি সায় দিলাম। ব্যাঙ্গমা আর একটা ফাইল খুলে ফেলল। সেটায় তারিখ দিয়ে কতগুলো চিঠির একটা সূচী করা আছে। সূচীর পরে প্রথম চিঠি শুরু হয়েছে। বুঝলাম, সব কটা চিঠি এই ফাইলে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে। কে করল, ব্যাঙ্গমা? সে কোন উত্তর না দিয়ে মাউসটা এনে আমার ডানহাতের আঙ্গুলগুলোর নীচে রাখল। বুঝলাম, পড়তে হবে চিঠিগুলো। আমার নিজেরও তাই ইচ্ছে। পড়তে শুরু করলাম।

(১) (১৭ জানুয়ারী ২০০৪)

এইবার-ই প্রথম, তোমার জন্মদিনে তোমার কাছে থাকা হয়নি। পঞ্চান্ন হলে। তোমার বয়স এখন আমার প্রায় দ্বিগুণ। তোমার অভিজ্ঞতা তার মানে এখন আমার দ্বিগুণ হল। কি, তাই হল? আসলে তোমার অনেক অভিজ্ঞতা। আর তোমার বুদ্ধি ত সব সময়ই আমার বহু গুণ। সমস্ত কিছু তুমি আমার থেকে ভালো পার। কিন্তু মা, তুমি কি আমার মতন সহ্য করতে পার?

তাও পারো নিশ্চয়-ই। বেশী-ই পারো। আমি জানি, আমার মা সব পারে। আমার মার সব কিছু কি সুন্দর! যে যাই বলুক, আমি তো জানি, আজও আমার মা আমার চেয়ে অনেক সুন্দরী। আমার অন্য কথা মানুক না মানুক, এই কথাটা অনুব্রত-ও মানে। এমনকি মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে বলে যে তোমাকে দেখেই নাকি আমার প্রেমে পড়েছে। বলে – ‘তোমার মা-র মত কাউকে তো পাওয়া যাবে না, তাই তোমাকেই পছন্দ করেছি!’ কোন মানে হয়! তবে হ্যাঁ, ওর পছন্দের তারিফ করতেই হয়। যেমন এই কম্পিউটারটা! বিয়েতে আমায় উপহার দিল! ফ্যান্টাস্টিক। কালকে একটা অদ্ভুত সুন্দর বাংলা লেখার সফটঅয়্যার ডাউনলোড করলাম। কি সুন্দর নাম – অভ্র! বাংলাদেশের একটি ডাক্তার ছেলে বানিয়েছে এটা, মেহেদী হাসান। সবার জন্য ফ্রী! এমন হয়! কি সহজে বাংলা লিখতে পারছি। যেমন খুশী লিখতে পারব এবার, যত খুশী।

(২) (২০ জানুয়ারী ২০০৪)

অনুব্রতটা এত ওস্তাদী করে, বরাবর! ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে চলে যাই। সেই উদ্দাম দিনগুলোতেও একেক সময় ইচ্ছে হত, দিই বলে যে কাল থেকে সব কাট। বলতে পারি নি, সত্যি-ই যদি কাট হয়ে যায়! হয়তো হতো না, কিন্তু আমার ভয় হ্ত। অথচ যখন ওর মেসেজের পর মেসেজ উত্তর দিতাম না, ফোন বন্ধ করে রেখে দিতাম, অনুব্রত কিন্ত ঠিক ধৈর্য্য ধরে আমার রাগ ভাঙ্গিয়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যেত। তার পরেও একটা সময় আমার ভয় করত। আসলে বাবা চলে গিয়ে অবধি …

আচ্ছা, মানুষ কখন ঠিক করে বোঝে যে আর থাকা যাবে না, এবার চলে যেতে হবে? না কি যে মানুষগুলো একসাথে থাকে, ভালবাসে, তারা আসলে সেই প্রথম দিন থেকেই দূরে চলে যেতে থাকে? মাকে জিজ্ঞেস করলে, একটা বিষণ্ণ মিষ্টি হেসে মা বলত – ‘আমি কি করে জানব লিপি, আমি তো যাই নি, তোর কাছে-ই আছি!’

এ নিয়ে কথা বলতে বলতে মার গলা আবছা হয়ে যেত। আমি বড় হতে হতে বুঝে গিয়েছিলাম, যা বোঝার একদিন নিজেই বুঝব, তাই মাকে আর নাড়া দিতাম না। শুধু নিজের গভীর গোপনে ব্যথা পেতাম। তবু মাখে মাঝে ঢেউ ভেঙ্গে কথারা উঠে আসত। পুরানো দিনের কথা। মার সাথে সেসব কথার সময় মা যখন আমায় লিপি বলে ডাকে, আমার ভিতরে আর একটা ডাক বেজে ওঠে। একটা আলাদা রকমের ডাক – যেন সমানে-সমানে কথা হচ্ছে, আদরে মাখা অথচ মর্যাদা দিয়ে, একটু ঘন সে ডাক, আমার ভিতরে শির-শির করে। বাবা আমার সাথে ঐভাবে কথা বলত, সব সময়। আমার নামটাও বাবার দেওয়া। কেন চলে গেলে, বাবা!

(৩) (৫ ফেব্রুয়ারী, ২০০৪)

কাল কতবার যে আমায় নাম ধরে ডাকলে, মা! আমার নাম নিয়ে একটা ছোট্ট মজা আমি নজর করেছি। যখন পুরনো কোনো আনন্দের কথা মনে পড়ে, হয়তো বাবার সাথে প্রথম দিনগুলোর কথা, এ কাজে, ও কাজে তুমি আমায় একটু বেশী ডাকাডাকি করো। খুব বেশী না, একটু – আমি ধরতে পারি। বারেবারে লিপি নামটা বলে একটা অন্য সময়কে ছুঁয়ে আসা। যে সময়টা চলে গেছে অথচ কোথাও যায়নি। একটা অদৃশ্য বলয়ের মত তোমাকে আর আমায় ঘিরে রেখেছে।

কাল সে’রকম একটা দিন ছিল। আমার থার্ড অডিশানটা ছিল। দু’ সপ্তাহের মধ্যে তিনটে। তার আগে কতদিন কিচ্ছু আসে নি। তুমি তখন ফোনে, মেসেজে, আমায় উৎসাহ দিয়ে গেছ। গতকালেরটায় বেশ ভাল একটা সুযোগের সম্ভাবনা আছে। তুমি তাই একটু বেশী উৎসুক ছিলে। যখন ফেরার পথে তোমার কাছে গিয়ে জানালাম যে মনে হয় ভালই দিয়েছি, তোমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তাই দেখে আমার-ও। মা-মেয়ে দুজনেই খুব খুশীতে তোমার এঘর ও ঘরে উড়ে বেড়ালাম। মাঝে-মাঝেই তুমি তখন লিপি-লিপি করেছ। বুঝলাম বাবার কথা মনে হচ্ছে। ছোটো ছোটো খুশী, জুড়ে রাখে কত অনন্ত অসহ সময়ের ভেলা। এই খুশীটাতো সেই মানুষটার সাথে ভাগ করে নেওয়ার কথা ছিল!

(৪) (১০ এপ্রিল, ২০০৪)

একজন মানুষ কেন আরেকজনকে কাছে ডাকে? কথা বলে? যাকে বলে, সে কি শোনে? ঠিক শোনে? কতদিন এমন হয়েছে, আমি অত্যন্ত খুশী হয়ে অনুকে কিছু বললাম – অনু শুনল, হয়তো কিছু বললোও। কিন্তু, সুরে বাজল না! কিসে সুরে বাজে? আমি যেদিন প্রথম অনুব্রতকে দেখি, আমার কিছু মনে হয়নি। সত্যি বলতে কি, ঠিক নজরেও পড়ে নি। আর কেউ না জানুক, তুমি তো জানো শ্রীতমাদি। তোমারি বন্ধু সে। আমাদের ক্লাবের নাটকের দলের প্রধান ভরসা ছিলে তুমি। আমার মায়ের স্নেহের নায়িকা, শ্রীতমা। তুমিই ওকে জুটিয়ে এনেছিলে। তারপর ধীরে ধীরে দলটার প্রধানদের একজন হয়ে উঠল সে। মা এই ক্লাব-এর বড় পেট্রন। মায়ের নাটকপ্রীতির কারণে ক্লাব লাইব্রেরীর নাটকের বইয়ের ভাণ্ডার বেশ বড়, আর নাটকের ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও। কিন্তু এত ভিড়ের মধ্যেও অনুব্রত আমার মায়ের নজরে পড়ে গিয়েছিল। আর আমি অনুব্রতর। আমি ধরতে পারিনি। তুমিও পারেনি, শ্রীতমাদি!

তুমি তো জান, আমার নাটকে মন ছিল না। আমি অর্থনীতি ভালবাসতাম। আর গল্প পড়তে। আসলে, কিছু লিখতে ইচ্ছে করত খুব, পারতাম না। তুমি পারতে। কি সুন্দর কবিতা লিখতে। কত গুণ তোমার শ্রীতমাদি! আমাদের ক্লাব-এর লাইব্রেরীতে নাটকের বইয়ের পাশাপাশি কত বিভিন্ন বিষয়ের বই যে ছিল! একদিকে তোমরা নাটকের ঘরে রিহার্সাল করতে। আর একদিকে বই পড়ার ঘরে আমি ডুবে যেতাম পৃথিবীর রহস্য উন্মোচনে। আর সেই রহস্য উন্মোচনের জাদুকাঠি হাতেই ঢুকে এল ও।

লাইব্রেরীর তাক থেকে বই নামানোর সময় মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম উজ্জ্বল আকাশী নীল শার্ট পড়া ছেলেটা নাটকের ঘরে রিহার্সাল দিচ্ছে বা রিহার্সাল না থাকলে ক্যারম খেলছে। কখনো-কখনো লাইব্রেরীয়ান সুদীপ-দা কাছাকাছি না থাকলে খেলা ছেড়ে উঠে এসে ফেরৎ বই জমা নিত, পরেরটা লেন্ডিং-এ এন্ট্রি করে দিত। আগে থাকতে চেয়ে রাখা বই রিজার্ভ-স্টক থেকে খুঁজে এনে দিয়ে দিত। তখন কি জানি, ওটা গট্‌-আপ থাকত! সুদীপদার সাথে হিসেব করা থাকত, ঠিক সময়মত লাইব্রেরীয়ান মহাশয় ব্যস্ত হয়ে যেতেন আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট এগিয়ে এসে বই আর বই নিতে আসা মেয়েটা দুজনের-ই দায়িত্ব তুলে নেওয়ার চেষ্টা করত। কিচ্ছু বুঝতে পারি নি আমি। আমি কি খুব বোকা? খুব? ঐ, অনু এলো মনে হয়।

(৫) (১১ এপ্রিল, ২০০৪)

কে যে কখন বোকা হয়ে যায়, শ্রীতমাদি! কখন থেকে যে বই নেয়া-বই ফেরৎ দেওয়ার সময় সেই ঝকঝকে চোখের ছেলেটা সামনে না থাকলে লাইব্রেরীতে যাওয়াটা মিইয়ে যাওয়া মুড়ির মত হয়ে যেত, বাড়ি ফিরে আর গলায় কোন গান গুনগুন করত না, অনেকদিন পর্যন্ত সেটা ধরতে পারি নি! ধরতে পারার আগেই অনেক রাস্তা হাঁটা হয়ে গেল।

সত্যি সত্যিই অনেক রাস্তা হাঁটা হয়ে গেল। লাতিন আমেরিকার উপর একটা বই-এর জন্য ডিমান্ড দিয়ে রেখেছিলাম। বইটা নির্দিষ্ট দিনে আনতে গিয়ে খুঁজে পাওয়া গেলনা। অথচ সুদীপ-দা জানে যে বইটা আমার দরকার। বইটা আমাদের লাইব্রেরীর নয়। অন্য কোথা থেকে সুদীপ-দার যোগাড় করে আনার কথা ছিল। বলেছিল যে এনেছে। আমার হতাশ মুখ দেখে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রস্তাব দিল, “লিপি, এক কাজ করি, চলো।” লিপি আমার ডাকনাম। কিন্তু লাইব্রেরীর রেজিস্টারে ত আমার সেই নাম নেই। এ ছেলে এই নাম ধরে ডাকে কেন?

নামের ভাবনায় ঘুরপাক খেতে খেতে আধা মন নিয়ে শুনলাম, এই ছেলে এই বিষয়টা নিয়ে দু-চার পাতার জ্ঞান রাখে, আমার সাথে সে তা ভাগ করে নিতে পারে যদি সামনের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে ঐদিকের ঐ পার্কটা পর্যন্ত যাওয়া যায় আর তার পর ঐভাবেই হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে ফিরে আসা যায়। কতক্ষণ আর, ঘন্টা খানেক! আমি একবার দ্বিধা করে রাজী হয়ে গেলাম। লাইব্রেরী থেকে বের হওয়ার মুখে কয়েক জোড়া চোখ একবার আমার দিকে একবার অনুব্রতের দিকে তাকিয়ে আবার বইয়ের পাতায় ডুবে গেল। ঘন্টা খানেক, তার মধ্যেই লাতিন আমেরিকা থেকে কলোনিয়ালিজম হয়ে পুঁজির পাহাড়ে চড়ে সেখান থেকে গড়িয়ে নেমে গড়াতে গড়াতে কোথায় চলে এলাম! ফেরার পথে আলতো করে আমায় কানের কাছে মুখ এনে সে জানাল, আমার ডাকনামটা তার খুব ভালো লাগে। আমার ভিতরে কি যেন শিরশির করে উঠল!

বোকা হয়ে গিয়েছিলে তুমিও শ্রীতমাদি। ওদের পাড়া থেকে তোমার ক্লাসমেট অনুব্রতকে তুমি নিজে আমাদের ক্লাবে নিয়ে এসেছিলে। আনার পরের নাটকেই তোমাদের জুটি হিট। আমদের শহরটায় শুধু নয়, যতটা এলাকা জুড়ে লোকেরা আমাদের ক্লাবের নাটকের দলটাকে চেনে সব্বার মুখে মুখে অনু-শ্রী। মা তো একেবারে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি নাটকের লোক ছিলাম না। কিন্তু এইবার ইচ্ছে হল। তোমাদের রিহার্সাল দেখতে শুরু করলাম, আস্তে আস্তে মঞ্চে। তারপর কখন যে জুটি বদলে সময়টা অনু-লিপির হয়ে গেল, সেটা বুঝতে তোমার অনেক দেরী হয়ে গেল! আমি তোমায় কাঁদতে দেখেছি, অনুব্রতর কাঁধে মাথা রেখে, মঞ্চে, সাজঘরে, অভিনয়ে, অভিনয়ের বাইরে। অনু ধীরে সে জল মুছিয়ে দিয়েছে। জল-মোছা চোখ নিয়ে তুমি সরে গেছ। আমি দ্বিধাদীর্ণ হয়েছি, কিন্তু অনুব্রতকে ছাড়তে পারিনি। তোমার চোখের জলও আমায় ছেড়ে গেল না। আমি পরিষ্কার দেখতে পাই।

(৬) (২২ মে, ২০০৪)

কালকে অনুর অফিসের কয়েকজন ফেরার পথে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। জ্বর হয়ে ও অফিস যেতে পারে নি ক’দিন। ওরা দেখতে এসেছিল। আসলে ওদের ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। অনুব্রত যখন কথা বলে তখন মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। যত মুগ্ধ হওয়া যায় অনু তত ঝকঝক করতে থাকে, উজ্জ্বল চোখ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। সেই দীপ্তি শ্রোতার চোখে ঘোর লাগায়। তুমি তো জানো মা, আমি কারো কথাই বেশীক্ষণ নিতে পারি না। অনুরও না। অন্যমনস্ক হয়ে যাই। সেই শুরুর দিনগুলোয় কিন্তু, আমার অবস্থা ওর এই অফিস সহকর্মীদের মতন-ই ছিল। অনুব্রতর কথা না শুনতে পেলে মাথার মধ্যে একটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগত। আমি নিজেই নানা কথা ধরিয়ে দিতাম আর অনু, ততদিনে আমার থেকে চার বছরের বড় এই ছেলেটাকে আমি অনু বলে ডাকছি, সমানে কথা বলে যেত।

অনেক কিছু ও জানে, আর যদি ঠিক করে যে আরো জানা দরকার, তবে অবশ্যই আরো জেনে নেয়। যেমন ধরো সেই শুরুর দিনগুলোয়, তখন সুদীপদার কাছ থেকে নিয়ম করে জেনে নিত আমার কোন বইয়ের দরকার। তারপর একদিন ঠিক সময়মত একটা বই দেবার নাম করে আমার সাথে জুড়ে গেল। আর, আস্তে আস্তে আমাকে জড়িয়ে নিল ওর সাথে, নাটকের দলে।

(৭) (১৩ সেপ্টেম্বার, ২০০৪)

গতমাসে আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী গেল। শ্রীতমাদি এসেছিল। নাটক ছেড়ে দেয়ার প্রায় বছরখানেক বাদে সেই যে ও কলকাতা চলে গিয়েছিল, এতদিন বাদে আবার এল। কি মিষ্টি আর দুষ্টু হয়েছে ওর মেয়েটা। আমাকে জড়িয়ে ধরে দুগালে চুমো খেল, খেয়েই গেল। খুব হৈচৈ হল। একগুচ্ছ উপহার দিল শ্রীতমাদি, সাথে একটা বই। ওর প্রথম কবিতার বই, এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। আকাশী নীল মলাটের বইটায় কি অদ্ভুত সুন্দর সব কবিতা লিখেছে শ্রীতমাদি – নরম, বিষণ্ণ, পবিত্র। ও কি মনের গহীনে খুব দুঃখী? ভুলতে পারেনি অনুব্রতকে? আমার জন্য ওর জীবনটা কি এলোমেলো হয়ে গেল? না কি সমস্ত কবিতাই আসলে বানিয়ে তোলা? কিংবা ধরো, আমার এই লেখাটা, অন্য লেখাগুলো? সব ত আমি যেমন দেখছি, তাই না?

(৮) (২৯ ডিসেম্বার, ২০০৮)

এ বছরের আমাদের নাট্যমেলা শেষ হল গতকাল। খুব ভাল হল এবার সব কটা দলের নাটক। আমাদের দলের নাটক ও সবাই ভালো বলেছে। তবে বেশী প্রশংসা হয়েছে মেলার আয়োজনের, মানে অনুব্রতর। অনু এখন আর মঞ্চে অভিনয় করে না। নাটকের সাথে সাথে কেরিয়ারকে এগিয়ে নিতে কোন অসুবিধা হয় নি ওর। তারপর একসময় মসৃণ ভাবে বদলে নিয়েছে পথ। তা বলে নাটক ছাড়েনি। এখন মায়ের সাথে সাথে, অনুও আমাদের নাটকের দলের বড় স্পন্সর, রিক্রুটার। অনুব্রত সমস্ত কিছু বড় ক্যানভাসে দেখতে পায় আর সেইভাবে কাজ করে। আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু মা সমস্তটা বুঝেছিল, সহজ অঙ্কের মত। আর খুশী মনে ওর সাথে তালে তাল মিলিয়েছিল। ঠিক সময়মত তিয়াসকে নিয়ে এসেছিল ও। মঞ্চে আমার নায়ক তিয়াস, মঞ্চের বাইরে অনুব্রত। তারপর এখন যখন কলকাতায় যাতায়াত করে সিরিয়াল সামলাতে সামলাতে মঞ্চে আর সময় দিতে পারছি না, নাটকের দলের অসুবিধা হয় নি। আমার বদলি অনু রিক্রুট করে নিয়েছে। আমি জানি, যদি কোনদিন আমাকে না চায় ও, আমার বদলি রিক্রুট করে নেবে অনু।

(৯) (৩০ ডিসেম্বার, ২০০৮)

অনু সমস্ত কিছু এত গুছিয়ে করতে পারে, করে, যে ওর সাথে থাকতে থাকতে বোঝাও যায় না কখন কেমন করে ওর গুছিয়ে রাখার ব্যবস্থার জালের মধ্যে একটা মাছির মত আটকে গেছি। আর কোনো ছাড়ান-কাটান নেই! জালটা যে আছে, সেটা ও নিজেও মানে। কিন্তু ওর বিশ্বাস জালটা আসলে আমাদের বাঁচানোর জন্য। ট্রাপিজের খেলায় যেমন সেফটি-নেট থাকে – নিরাপত্তা জাল, আমাদের পড়ে গিয়ে আহত কি নিহত হওয়া থেকে বাঁচাবে। ওর বিশ্বাস এই জালটা খুব দরকার। কারণ আমরা পড়ে যাব, যাব-ই। এতে আমাদের কোন দোষ নেই, এমনকি ভুল-ও নেই। এটা নিছক একটা অপূর্ণতা। মানসিক অপূর্ণতা। যাদের সেই অপূর্ণতাটা আছে, তারা তো ঐভাবেই জন্মেছে। আর সেটা খুব খারাপ ব্যাপার-ও নয়। সব একরকম হলে তো এই পৃথিবীটার কোন বৈচিত্র্যই থাকত না। শুধু মনে রাখতে হবে, যাদের এই অপূর্ণতাটা নেই, যেমন অনুব্রত, যেমন আমার মা, তাদের কাজ আমাকে, আমার বাবার মত মানুষদেরকে সাবধানে ঘিরে রাখা, যত্ন করে, গুছিয়ে।

বাবার জন্য কি জালটা ছিল? কি করে ছিঁড়ে গেল সেটা?

আমি যদি বলি আকাশটা কি সুন্দর, অনুব্রত যা-ই করতে থাকুক, কাজ থামিয়ে আমার দিকে তাকাবে, আকাশের দিকে তাকাবে, তারপর মিষ্টি হেসে বলবে – ঠিক বলেছ। যদি বলি আকাশটা কি বিচ্ছিরি, অনুব্রত কাজ থামিয়ে আমার দিকে তাকাবে, আকাশের দিকে তাকাবে তারপর গম্ভীরভাবে বলবে – খুব খারাপ। আর যদি আমার দিকে তাকিয়ে বুঝে যায় যে আমি উল্টোটা শুনতে চাইছি – একটু কথা কাটাকাটি চাইছি, এবং ঠিক-ঠিক বুঝেও যায়, তা হলে অবশ্যই উল্টোটা বলবে আর তর্কাতর্কির একটা মহা সমারোহ বাধিয়ে তুলে আবার নিজেই একসময় সাবধানে জট ছাড়িয়ে নিজেকে এবং আমাকে তার থেকে বার করে আনবে। আর এই সবটা সময়, আমি জানি, যে জিঙ্গল-টা ও লিখতে লিখতে ছেড়ে এসেছিল সেটা মাথার মধ্যে ঠিক গুছিয়ে রেখেছে। আবার যখন বসবে, যেখানে ছেড়ে এসেছিল সেখানেই ধরে নেবে। আমি কি করব মা?

(১০) (১৭ অগাস্ট ২০০৯)

গতসপ্তাহে অনুব্রতর ঘরে এসেছি ছয় বছর হয়ে গেল। রবিবারের পার্টিতে সবাই আমাদের গোছান সংসারের প্রশংসা করেছে। তাদের বন্ধু অনুব্রত’র বউ-এর যে সুগৃহিনী হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তাই নেই সব্বাই প্রচুর হাসির সাথে সে কথা বেশ মজা করে, গর্ব নিয়ে ঘোষণা করেছে। শুধু রীতেশ-দা বার দুয়েক চেষ্টা করেছিল বোঝানোর যে গুছিয়ে থাকাটাই একমাত্র সুখের থাকা নয়, সকলের সমবেত ঘোষণায় সে প্রস্তাব মাটিতে পা রাখার জায়গা পায় নি। হাওয়ায় ভেসে গিয়েছিল। সেই হাওয়াটাকে কি আমি একটু খোঁজাখুঁজি করেছিলাম, মনে মনে? ঠিক জানি না। আমি ও তো এখন খুবই চেষ্টা করি – গুছিয়ে চলার!

সবাই চলে যাওয়ার পর অনুব্রত ড্রিঙ্কস-এর গ্লাসগুলো ধুয়ে মুছে তুলে রাখতে রাখতে বলেছিল, ‘রীতেশ-এর অবস্থাটা দেখলে, আজো পাল্টালো না। কোথায় কি বলতে হবে, বলতে হয় – শিখল না। ওর জন্য কি না করেছি! এই যে অর্ডারগুলো পায়, আমি-ই ফোন করে-করে সে সময় কমলদা, অবনী সান্যাল, সোম এন্ড রাসেল-এর মিসেস চাওলার কাছে পাঠিয়েছি। সেই কন্‌ট্যাক্টগুলো কাজে লাগিয়েই এই স্ট্রাগ্‌ল্‌-এর বাজারে ওর টিঁকে যাওয়া। আর সেই ছেলে আমার-ই বাড়িতে বসে আমায় জ্ঞান দিচ্ছে, গুছিয়ে কাজ করাটা একটা অপশান মাত্র, লক্ষ্য নয়!’ অতই যদি পারিস, আজও একটা গুছিয়ে প্রেম করে উঠতে পারলি না কেন?

আমার ভিতরে একটা টুপ টুপ জল পড়ার শব্দ। সে কেমন ঠিকমত বোঝাতে পারব না আমি। রীতেশ কখনো আমায় কথাটা বলে উঠতে পারে নি। কিন্তু ওর বিষণ্ণ চোখে কার ছায়া কাঁপে সে আমার চেয়ে বেশী আর কে জানে! ভুল হল, অনু নিশ্চয় জানে। ও সব জানে। অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, অনুব্রত জলের গ্লাস বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলছে, “ওষুধটা খেয়ে নাও।”

জলের গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে আমার চেতনা যেন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ফিরে এল। এক ঝটকায় একটু আগে অন্য মনে শোনা কথাগুলো যেন দ্রুত পার হয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র দৃশ্যের মত মাথার ভিতর ভেসে গেল। অনুব্রত বলেছিল, “এই জন্যই তো দেশ-টার এই হাল। রীতেশ-এর মত লোকেরা একটা কাজও গুছিয়ে করে না, পারেই না আসলে! আর, তাই তেমন কিছু হয়ও না এদের। জাস্ট চালিয়ে যায়। যাক গে। তুমি এসব নিয়ে বেশী ভেবো না। প্রত্যেককে যার যার পূর্ণতা-অপূর্ণতা নিয়েই বাঁচতে হবে, হয়। দুনিয়ায় সব রকম লোক-ই থাকবে। তুমি কিন্তু সব গুছিয়ে রাখা হলেই ঘুমিয়ে পোরো। ভালো হয়েছে যে এখন কোন কাজ নেই। শরীরটা একটু সারিয়ে নিতে পারবে। সামনের মাসের কাজটা যদি হয়ে যায়, একদম রেডি।” সত্যিই ত। অনুব্রতরা তুলে না দিলে রীতেশদের হাতে কিছু আসে না। লিপিরা তাদের অধরাই থেকে যায়।

(১১) (৪ এপ্রিল, ২০১০)

ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। আমি জানি, যতটা গুছিয়ে করা দরকার, আমি ততটা করে উঠতে পারি না। আর, তাই তেমন কিছু একটা হলো-ও না। কোন ভাবে চালিয়ে যাচ্ছি। অথচ দেখো, তুমি কেমন সব দিক গুছিয়ে আমাকে বড় করে তুলেছিলে। আমার জন্য কেমন চমৎকার পার্টনার যোগাড় করে দিয়েছিলে। আমি এখন জানি, অনুর আমাকে পছন্দ করায় তোমার কতটা পরিকল্পনা ছিল। তোমার জহুরীর চোখ বুঝে ফেলেছিল যে, তোমার এই সব বুঝেও না বোঝা, বারে-বারে-ভুলি মেয়েটার জন্য অনুব্রতর চেয়ে যোগ্য ছেলে সহজে মিলবে না। তোমার গোছানো হিসেবে কোন ভুল নেই, মা। বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় পা রেখে কি সুন্দর এগোচ্ছে অনুব্রত! আমি-ও কেমন গুছিয়ে উঠছি! কিন্তু এত ক্লান্ত লাগে কেন গো?

(১২) (১৬ মে, ২০১০)

মা গো, এখন আর আমি যখন-তখন আকাশ দেখি না, বৃষ্টিতে ভিজি না, বইমেলায় হারিয়ে যাই না, লাইব্রেরীতে গিয়ে কোনো অচেনা ছেলের সাথে হাঁটতে-হাঁটতে ঘুরে আসি না একটা জীবন, শতাব্দীর থেকে শতাব্দী, চেনা পৃথিবী থেকে অচেনা পৃথিবী। আমার পৃথিবী এখন সুন্দর করে গোছানো। চিনতে পারি না, কিন্তু সুন্দর করে গুছিয়ে রাখি। এমন কিচ্ছু রাখি না যা দরকার নেই। তোমার মত অনুও আমায় আগলে রাখে, যে সবে আমার মায়া পড়ে গেছে কিন্তু কোন কাজে আসবে না সেগুলো ফেলে দ্যায়না, শুধু একটু দূরে রেখে দ্যায়, তাকে তুলে রাখে। আমার সব কটা লেখা, আমার কাটুম-কুটুম-এর বাক্স, সব গুছিয়ে রেখে দিয়েছে; সেসব নিয়ে তো আর বসা হয় না এখন! আচ্ছা মা, বাবা-র সেই গানের টেপ-গুলো এখনো আছে? ওসব তো আর কোনদিন কেউ বাজাবে না! তবে আছে নিশ্চয়-ই। তুমি ঠিক গুছিয়ে তুলে রেখেছ। আর বন্দুকটা? ওটা বোধ হয় পুলিশ ফেরৎ দেয়নি, তাই না? তুমি যে রকম ভাবছ, সে রকম কিছু নয়, মা। আমি তো তোমার-ও মেয়ে! তাই অত আগোছাল ভাবে জীবন-টাকে ছেড়ে চলে যাব না। তবে যাব। পায়ে, পায়ে, ঠিক বেরিয়ে চলে যাব।

(১৩) ১৪ জুলাই, ২০১৫

মেয়েটা কোলে আসতে গিয়ে এলো না, তিন বছর হয়ে গেল।

(১৪) ২০ জুন, ২০২০

এত মিথ্যে বলে কেন সবাই?

ল্যাপটপের স্ক্রিন এখন অন্ধকার। বাইরের আকাশে চাঁদের আলো হাল্কা মেঘে ঢাকা পড়েছে। পাখীদুটো কখন গাছে ফিরে গিয়েছে খেয়াল করিনি। একটা অপার্থিব ধূসর কূলহীন, তলহীন সমুদ্র আমায় ঘিরে আছে। সেই সমুদ্র থেকে নরম গলায় একটা ডাক ভেসে এল – “লিপি …”

 

[রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০-তে প্রকাশিত]

নদীর পাড়ঘেঁষা এই শহরের এই দিকটায় ব্যস্ততা কম। আমার এখন সেটাই দরকার। বাড়িটার আয়তন অনুসারে ভাড়াটা হয়ত একটু বেশী-ই। কিন্তু আমার এখন এই নির্জনতাটা খুব দরকার। খুব। যে জীবন নিজের পছন্দে বেছেছি, গড়েছি, সেখান থেকে যখন পালাতে হয় সে বড় কঠিন হয়ে পড়ে। বাড়িটা এই লোকালয়ের একেবারে শেষ প্রান্তে। নদী এখানে এসে গোল করে বাঁক…