হিমালয়ের অন্দরমহলে
সুমন বিশ্বাসের বই ‘হিমালয়ের অন্দরমহলে’
*** ***
পড়ে ফেললাম চরণিক (trekker) সুমন বিশ্বাসের লেখার সংগ্রহ ‘হিমালয়ের অন্দরমহলে’ । হিমালয়ের আনাচে কানাচে ঘুরে-বেড়ানো নিয়ে তাঁর কয়েকটি লেখার একটি গোছা। যেন পাহাড় থেকে তুলে আনা কিছু ফুল-পাতা-ডাল-কুঁড়ি-মঞ্জরীর একটি সমাহার যা প্রিয় মানুষটির হাতে তুলে দিয়ে অপেক্ষায় থাকা যায় তার মুখে ফুটে ওঠা হাসিটির জন্য।
হাসিটি আমার জুটেছিল। পড়ুয়া হিসাবে আমি স্বল্প-সম্বল, বিড়ম্বিত ধরণের মানুষ। লেখা পড়লেই নানা রকম বিঘ্নকর চিন্তায় বিক্ষিপ্ত হয়ে যাই। অকারণে সময় বয়ে যায়। কবিতা শুনতে গেলেও তাই। কিন্তু আমি আকাট অসুর আর ঘরের-কোণ-বিলাসী বলে গান শোনা কি ভ্রমণ কাহিনী পড়ায় – আমি হলে কি করতাম – এইরকমের বাতুল চিন্তা আমার রসগ্রহণে কোন বাধা সৃষ্টি করে না। তবু সাবধানের মার রাখতে নেই বলে আমি সম্ভব হলেই নিজে কোন বই পড়ার আগে আমার মূল চালিকাশক্তিকে বইটি পড়তে ধরিয়ে দিই। তিনি যথার্থ পড়ুয়া। গুণগ্রাহী এবং সত্য উচ্চারণে নির্দ্বিধ। তাঁর কাছ থেকে অনুকূল সংকেত পাওয়া গেলে বইটি পাঠে নিশ্চিন্তে উদ্যোগ করি।
সে পাঠকের মতে এই বই – ‘খুব ভালো বর্ণনা, মনে হল আমিও পায়ে পায়ে যাচ্ছি ওনার সাথে। অনেক কিছু অজানা বিষয় জানলাম, রীতিমত সাহস করে সংগ্রহ করা অন্দরের খবর, অত্যন্ত দরদী মন, গোছানো লেখা।’
তার উচ্ছ্বসিত উৎসাহে, প্রথমেই যা বলেছি, পড়ে ফেললাম এই চমৎকার বইটি। এই বইয়ের গল্প একটি পড়ার পর অন্যটিতে যাওয়ার আগে একটু থামতে লাগে। জিরিয়ে নিতে লাগে। তাই আয়তনে বড় না হলেও বইয়ের পাঠ শেষ করতে সময় লাগল।
সুমন অনুরোধ করে রেখেছেন পাঠ প্রতিক্রিয়ার। তিনি বিনয়ী মানুষ, তা বলিয়া আমি দুর্বিনীত না হইব কেন? অতএব, স্বল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করের স্বাভাবিক বিবেচনায় পাঠ-প্রতিক্রিয়া দিতে নেমে পড়েছি। পাঠ প্রতিক্রিয়ার পাঠে মূল বইটি পাঠের আনন্দ ঘেঁটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই চেষ্টা করব বিস্তারিতে না যাওয়ার।
গল্প – ১ || আনন্দ ||
প্রথম পুরুষে গল্প শুরু হয়ে এক ঝটকায় আমি আর লেখক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্পের মূল চরিত্রকে দেখতে শুরু করে দিলাম। গল্প জমে গেল। অর্থাৎ ভ্রমণ কাহিনীটি একটি গল্পের বয়ানে আমাকে নিয়ে চলতে শুরু করে দিল। ঠিক যেমনটি লেখক চেয়েছেন। আর, এই ভাবে এগিয়ে গল্প যখন শেষ বাক্যে পৌঁছল, পদ্ধতিটির অব্যর্থতায় পাঠকের মুগ্ধতা চূড়ান্তে পৌঁছল।
গল্প – ২ || আলু পরোটা আর ভেড়ার মাংস ||
এই গল্প চরণিক লেখকের নিজের জবানীতে বলা। সাধারণ ঘটনা, কিন্তু সুস্বাদু স্মৃতিমন্থন আর চমৎকার পরিবেষণে পাঠশেষে মুখে তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
গল্প – ৩ || স্যাররর…ধ্রাস.. ||
পরিণতি কি হবে সেটার আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছিল। তা বলে পাঠের উত্তেজনা কম লাগে নি একটুও।
গল্প – ৪ || ভয়ঙ্কর ভানোটি ||
অসাধারণ সৌন্দর্যের আকর হিমালয়ের যে শৃঙ্গগুলি স্বল্প অভিজ্ঞতার সাধারণ মানুষের আরোহণ করার পক্ষে অনুকূল ধরা হয়, ভানোটি তার অন্যতম। তবে সুমন বার বার যেটা ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন সেটা এই যে হিমালয়কে কখনোই অসতর্কতার সাথে নেয়া চলে না। মুখে বলার থেকে ছবি এঁকে বোঝালে কিংবা চলচ্চিত্রে দেখালে যেমন প্রতিপাদ্যটি অনেকক্ষেত্রেই সহজবোধ্য হয়ে ওঠে সুমন এখানে সেই প্রয়াস নিয়েছেন। মুস্কিল এই, আমার এ দুর্বল হৃদয় নিয়ে বড়ই লোফালুফি করেছেন। আর এইসব মাগজিক ব্যাপারস্যাপার বাদ দিলে – অপ্রাকৃতে বিশ্বাসীদের জন্য জমাট বাঁধুনিতে চমৎকার গল্প। কিঞ্চিত ক্লিশে কিন্তু টানটান।
তবে হ্যাঁ, এই গল্প নিয়ে আমাদের দু’জনেরই একটি অনুযোগ আছে। এই গল্পটি বাকিগুলির থেকে স্বতন্ত্র। বাকিগুলিতে ভ্রমণকে কাহিনীর কাঠামোয় নিয়ে আসা হয়েছে। এই গল্পে কাহিনীকে ভ্রমণের খোলে পরিবেশন করা হয়েছে। অমীমাংসিত রহস্য সিরিজের এক বা একাধিক পর্বের চিত্রনাট্য হিসেবে উপভোগে কোন কমতি হবে না। কিন্তু লেখক মশাই, এই বই যে মন নিয়ে পড়ে চলেছিলাম তার সাথে এই ‘গল্প’টি মিশল না; পাঠ চিড় খেয়ে গেল। লেখার শেষে যে নিদায়িকাটি* দিয়েছেন সেটি গল্পের আগে জানা থাকলে এই অনুভূতিটা যে হত না, সেইটি নিশ্চিত করে বলা যায়। [*disclaimer]
গল্প – ৫ || দুর্যোধন ও সোমেশ্বর শিব ||
এই লেখায় অষ্টম অনুচ্ছেদের শেষে সুমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে পাঠ শেষে পাঠক সম্ভবতঃ হতাশ হবেন। কারণ ভ্রমণ শেষে লেখক নিজে তাই হয়েছেন। আশঙ্কা যথার্থ। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বিজেতার ইতিহাসে অপরাধী, অনৈতিক মানুষ হিসেবে চিহ্নিত মানুষটিকে তার অনুগামীরা সেই পৌরাণিক যুগ থেকে এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও যে আদরে, যে সম্মানে স্মরণ করে এসেছেন তার সন্ধান পেতে। লেখকের সাথে সাথে আমরাও বুঝতে পারি, আমাদের সভ্যতা আজ কোন পথে চলেছে, কোথায় এখন অবস্থান আমাদের। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এই উদ্ঘাটন বড় সহজ নয়, হিম্মৎ লাগে। কুর্নিশ।
গল্প – ৬ || হিমালয়ান ভায়াগ্রাকাহিনী ||
জটায়ূ এ লেখার নাম দিলে সম্ভবতঃ বলতেন – কীড়াজোড়ি রহস্য। রীতিমত ন্যাটজিও কাহিনী। অত্যন্ত সুখপাঠ্য, একটানে পড়ে ফেলা ছাড়া উপায় নেই।
গল্প – ৭ || ‘শিবঠাকুরের আপন দেশে/ আইন কানুন সর্বনেশে’ – প্রথম পর্ব মালানা গ্রামের গল্প||
গল্প – ৮ || ‘শিবঠাকুরের আপন দেশে/ আইন কানুন সর্বনেশে’ – দ্বিতীয় পর্ব তশ গ্রামের গল্প ||
মালানা থেকে তশ – গাঁজা আর চরস-এর উপাখ্যান। প্রথমটির পাঁচ-ছয় বছর বাদে দ্বিতীয়টি লেখা। অর্থনীতির বিশেষ স্রোতটি কালের নিয়মে নিজেকে আরো কৌশলী করে নিয়েছে। জমলুদেওর আশীর্বাদ ধন্য দুনিয়ায় নিজের চোখে দেখা আর কানে শোনায় লেখক সংগ্রহ করেছেন এই উন্নতির এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। সাহস করে গিয়েছেন, ঘুরেছেন, লিখেছেন, আবার গিয়েছেন, ঘুরেছেন লিখেছেন। পারেন বটে আপনি!
গল্প – ৯ || পাপসুরা বেস ক্যাম্পে ||
যে বিষাদ-বিন্দুর ভয় ছিল বইটি পড়া শুরু করার পর থেকে, এইখানে এসে সেটি দেখা দিল। লেখক আমাদের নিয়ে চলেন মালতী দাস আর রজার রেডমেইন-এর সমাধিতে। লেখকের দীর্ঘশ্বাসের সাথে সহমত।
গল্প – ১০ || বরাসুতে বিড়ম্বনা ||
চারটি অংশের সমন্বয়ে এক নির্মোহ উপস্থাপন – হিমালয়ের পটভূমিতে লেখকের নিজের দেশের সরকারী ব্যবস্থাপনার। সাথে ঘরের পাশের ছোট্ট দেশ নেপালের সরকারী ব্যবস্থার বিবরণ – পরিস্থিতির একটা তুলনামূলক আন্দাজ পাওয়ার সুবিধার জন্য। লেখা শেষ করার আগে সুমন জানান, “তবু সব ঘটনা মনে রাখার জন্যে লিখে ফেললাম, ভবিষ্যতে পাহাড়ে গিয়ে যদি কখনো বিপদে পড়ি, প্রিয়জনেরা নিশ্চিন্ত থাকেন – সরকারী সাহায্য পৌঁছেছে, নিশ্চয় আমি সমতলে ফিরে আসতে সক্ষম হব, তেমনটা ভেবে যেন অপেক্ষা না করেন। সরকারী সাহায্য মানে ‘ধোঁকার টাটি’, সেই সাহায্যের জন্যে অপেক্ষা না করে কফিন টফিন নিয়ে নিজেদের চেষ্টায় তাঁরা যেন অকুস্থলে পৌঁছন, তাতে অন্তত দেহ পচনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।” লেখকের দেশটি এই পাঠকের জন্মভূমি – মন বিষণ্ণ হয়ে যায়।
অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, এই বইয়ে পাওয়া চমৎকার রঙ্গিন ছবিগুলির কথা। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, আইপ্যাডে ছবিগুলিকে বড় করে নিয়ে তাদের ঠিক ঠিক মর্যাদায় দেখা গেছে। ম্যাকবুকে সেই সুবিধাটি ঘটেনি।
এইপর্যন্ত যদি এসে থাকেন, আর দেরী কিসের, মাননীয় পড়ুয়া, কিনে ফেলুন এই চমৎকার বইটি। ঘরে বসে পেয়ে যাবেন ডিজিটাল সংস্করণ – অশেষ ধন্যবাদ লেখককে আর তাঁর বইয়ের ডিজিটাল প্রকাশক – বইয়ের হাট-কে।
[প্রকাশ – বইয়ের হাট, অগাস্ট ১২, ২০২০]
সুমন বিশ্বাসের বই ‘হিমালয়ের অন্দরমহলে’ *** *** পড়ে ফেললাম চরণিক (trekker) সুমন বিশ্বাসের লেখার সংগ্রহ ‘হিমালয়ের অন্দরমহলে’ । হিমালয়ের আনাচে কানাচে ঘুরে-বেড়ানো নিয়ে তাঁর কয়েকটি লেখার একটি গোছা। যেন পাহাড় থেকে তুলে আনা কিছু ফুল-পাতা-ডাল-কুঁড়ি-মঞ্জরীর একটি সমাহার যা প্রিয় মানুষটির হাতে তুলে দিয়ে অপেক্ষায় থাকা যায় তার মুখে ফুটে ওঠা হাসিটির জন্য। হাসিটি আমার জুটেছিল।…
Recent Posts
Categories
- Blog
- Book Chapter
- featured
- অঞ্জলি
- অনুবাদ
- অনূদিত কবিতা
- অনূদিত গল্প
- আলাস্কা গ্লেসিয়ার বে
- ঈশপের গল্প
- কবিতা
- কিছুমিছু
- ক্যালিডোস্কোপ
- ক্রুজ
- গল্পপাঠ
- গুরুচন্ডালি
- ছোট গল্প
- টুকিটাকি
- দুকূল
- নীতিকথার অনুবাদ
- পাঠ প্রতিক্রিয়া
- ফটোগ্রাফি
- বইয়ের হাট
- বাছাই
- বেড়ানোর গল্প
- মৌলিক কবিতা
- রুট ৬৬ গ্রুপ পোস্ট
- রুট ৬৬ শারদীয়া ২০২০
- সচলায়তন
- স্মৃতিকথা